মজলিসে শূরা গঠনে রাসূল (সা.) এর কৌশল ছিলো এই যে, তিনি মুহাজির ও আনসারদের থেকে বিজ্ঞ সাহাবীদেরকে পরামর্শ সভার সদস্য করেছিলেন। রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ, প্রশাসনিক কাঠামোর রূপরেখা দান, শাসন প্রণালী প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ শূরা নির্ণয় করত। রাসূল (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর অনুসারী সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করতেন। তবে আল্লাহ তা‘য়ালার পক্ষ থেকে নাযিল করা সংবিধান কুরআনে কারীমে তাকে যে ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে তার প্রেক্ষিতে তিনি যে কোন বিষয় পরামর্শ গ্রহণ বা বর্জন করার এখতিয়ার রাখতেন। তিনি সাহবীদের সঙ্গে পরামর্শ করার পর যে মতটি অধিক সঠিক ও কল্যাণকর মনে করেছেন সেটিই গ্রহণ করেছেন। যেমন, হযরত সালমান ফারসির পরামর্শে খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খনন এবং তায়েফে অভিযান চলাকালে অবরুদ্ধ শত্রুদের বিরুদ্ধে মিনজানিক ব্যবহার করা সংক্রান্ত পরমর্শ রাসূল (সা.) গ্রহণ করেছেন। সম্প্রদায়গত স্বার্থ, ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ক প্রশ্নে প্রতিনিয়ত পরামর্শ সভা চলত। কখনো কখনো পরামর্শদাতাদের পরামর্শ শুনেছেন কিন্তু সুদূর প্রসারী চিন্তা-ভাবনা ও সময়োপযোগী কৌশল অবলম্বন করে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেননি। যেমন, হুদায়বিয়ার সন্ধির ব্যাপারে সমস্ত সাহাবী মক্কার কাফিরদের সাথে সন্ধি করার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি সন্ধি করেছেন এবং তা কার্যকর করলেন। আর সে সন্ধিই পরবর্তীকালে প্রকাশ্য বিজয় নিয়ে আসে। অনুরূপভাবে উসামা বিন যায়েদ (রা.) কে সেনাপতি বানানোর বিরুদ্ধে বড় বড় সাহবীগণ মতামত দেন। কিন্তু রাসূল (সা.) এ বিষয়ে তাদের বিরোধিতা পরোয়া না করে হযরত উসামা (রা.)-কে নিজ হাতে পতাকা দিয়ে বললেন, “তুমি রওয়ানা হয়ে যাবে সেখানে, যেখানে তোমার পিতা শহীদ হয়েছেন এবং সে স্থানের লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। আমি তোমাকে এ বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত করলাম।” এসব ঘটনা থেকে পরামর্শ গ্রহণের ব্যাপারে নবী কারীম (সা.) এর নীতির সন্ধান মিলে যে, নেতা পরামর্শ চাইবেন সংশ্লিষ্ট লোকেরাও পরামর্শ দিবে, কিন্তু তার নিকট যে পরামর্শ অধিক সঠিক ও কল্যাণকর মনে হবে তা তিনি গ্রহণ করবেন। রাসূল (সা.)-এর এতটা দূরদর্শিতা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ ছিলো যে, আপনি আপনার রাষ্ট্রের সব কার্যাবলীর ক্ষেত্রে আপনার লোকজনের সাথে পরামর্শ করে কার্য সম্পাদন অব্যাহত রাখুন। কারণ, মুসলিম সমাজের কার্যাবলীল উপর কারও একক কর্তৃত্ব নেই। শূরার সদস্যগণের দায়িত্ব কোন বিষয় নিজস্ব স্বাধীন মতামত পেশ করা আর শাসকের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হচ্ছে শূরার থেকে পরামর্শ নেয়া। শূরা শুধুমাত্র জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণের অংশগ্রহণই নিশ্চিত করে না-একই সাথে তা স্বৈরাচারী শাসন প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে। স্বেচ্ছাচারী হবার পথ রুদ্ধ করে দেয়। ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরকার শুধুমাত্র আইনের মাধ্যমেই শাসনকার্য পরিচালনা করবে না, একই সাথে জনগণের আশা-আকাংখা ও ইচ্ছা পুরণে সিদ্ধান্তসমূহ পরামর্শের ভিত্তিতে গ্রহণ করবে এবং তা বাস্তবায়ন করবে। পরামর্শের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তে আল্লাহ তায়ালার রহমত থাকে।
রাসূল (সা.) অহী দ্বারা সরাসরি নির্ভুল জ্ঞান লাভ করতেন এবং ঐ জ্ঞানের আলোকে তাঁর কার্যাবলী পরিপূর্ণভাবেই নির্ভুল সম্পাদিত হতো। তিনি অন্যের কোন পরামর্শ গ্রহণের মুখাপেক্ষী ছিলেন না, তবুও বিষয়টির গুরুত্বের কারণে তিনিই সর্বাধিক পরামর্শ গ্রহণ করতেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়শা (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর চেয়ে অধিক পরামর্শ করতে আর কাউকে দেখিনি। অহী ও রাসূলের অবর্তমানে জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য পরামর্শ করা অতীব জরুরী। কেননা আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীতে আর কোন নবী ও রাসূল আসবে না। কোন বিষয় সঠিক কি বেঠিক তা জানানোর জন্যও আর জিব্রীল (আ.) এ পৃথিবীতে অবতরণ করবে না। আমরা মানুষ, আমাদের রয়েছে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। এ অবস্থায় একটি ভালো সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য পারস্পরিক আলোচনা পর্যালোচনা, পরামর্শ দেওয়া-নেয়া ও মত বিনিময় করা একান্ত জরুরী। সকলে মিলে পরামর্শ করে কাজ করলে অনেক জটিল ও কঠিন বিষয়ও সহজে আঞ্জাম দেয়া সম্ভব। পারস্পরিক পরামর্শ দুনিয়ার জীবনে কল্যাণ ও সৌভাগ্যের উৎস। রাসূল (সা.) এর বাণী, “দুনিয়ার জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি ও কল্যাণ তিন জিনিসের সমন্বয় পাওয়া সম্ভব। তন্মধ্যে পারস্পরিক পরামর্শ হলো অন্যতম। এ প্রসঙ্গে হাদীসের ভাষ্য হচ্ছে, “ যখন তোমাদের নেতারা হবেন সর্বোপরি ভালো মানুষ, ধনীরা হবেন সর্বোচ্চ দানশীল এবং তোমাদের সামগ্রিক কার্যক্রম চলবে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে, তখন তোমাদের জন্য মাটির উপরিভাগ নিচের ভাগ থেকে উত্তম হবে। অর্থাৎ দুনিয়ার জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণকর ও সুখময় হবে।