হিব্রু ভাষার ‘হা-শাটান’ ইব্রাহিমী ধর্মের এমন এক চূড়ান্ত বিরুদ্ধবাদী শক্তি যা স্বর্গীয় এবং মানব সম্প্রদায়ের সকল অশুভ স্বত্বার এক সাধারণ শিরোপা যারা মানুষের স্রষ্টাবিশ্বাসকে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন করে। খ্রিস্টধর্মে শাটান একটি একক নাম যে ঈশ্বর কর্তৃক অভিযুক্ত এবং মানুষের বিশ্বাস যাচাইয়ের কাজে নিয়োজিত। র্যাবিলিকের দর্শনে শাটান বিশ্বাস পরিমাপক নিক্ষিপ্ত দেবতাদের মধ্যমনিতে পরিণত হয়েছে। খ্রিস্টানদের ডেভিল বা পাপাত্মাকে আরব খ্রিস্টান এবং মুসলমানরা একবাক্যে শয়তান বলে। ইসলামে শাটান একটি অসৎ সৃষ্টি (মানুষ, পশু এবং আত্মা) যার অপর নাম শয়তান, ইবলিস বা ডেভিল।
পৌরাণিক কাহিনীতে শাটান বিপথে চালনাকারী শক্তি। জরাথ্রুষ্ট্রের ধর্মে যাকে বলা হয় ‘লাই’, যে অন্ধকারের দিকে মানুষের ইচ্ছাকে গতিমান করে। ইহুদীদের প্রাচীন বাইবেলীয় রচনায় শাটানকে বর্ণনা করা হয়েছে মানুষের প্রতিপক্ষীয় শত্রু হিসেবে। বাইবেলের ব্যাখ্যায় ইহুদী পন্ডিতরা শাটানকে মানুষের ভেতরে ক্রিয়াশীল অপপ্রবণতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। টেনাখের তিন স্থানে শাটানকে অভিযোক্তা, বিপথে ইন্ধনদাতা এবং পক্ষপাতদুষ্ট জুলুমবাজ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তার খারাপ গুণাবলীর জন্য ট্যানাইটিক লিটারেচারে তার প্রসঙ্গ খুব একটা উল্লেখ করা হয়নি।
ইন্দো-ইউরোপিয়ান মন্দিরের জন্য মালেক তাস ইয়াজিদী কতৃক পরীক্ষামূলকভাবে রচিত ডকুমেন্টের প্রধান দেবতা হল শাটান। ইয়াজিডিজমকে মধ্যপ্রাচ্যে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ধর্মের ইসলামপূর্ব অবশিষ্ট রূপ বলে মনে করা হয়। পরবর্তী সময়ে শেইখ আদি কতৃক প্রবর্তিত পৈশাচিক সুফীতত্ত্বে শাটানী কিংবদন্তীর সংমিশ্রণ ঘটে। এসব জঘন্য আকিদা এবং কর্মকান্ডের সাথে নামমাত্র মুসলমানদের অংশগ্রহণের কারণে ঊনিশ শতকের ইউরোপীয় পরিব্রাজক ও রহস্য লেখকরা অনাহুতভাবে আনাগোনা শুরু করে।
বাহাই ধর্মে শাটানকে কোন একক স্বাধীন স্বত্তা বলে গণ্য করা হয়না। বরং তাকে এক নিম্নতর মানবিক চরিত্র বলে অভিহিত করা হয়। আবদুল বাহা মানুষের হীন মনোবৃত্তিকে শাটান বলে সনাক্ত করেন। যা একটি আভ্যন্তরীণ অশুভ অহংবোধ। অন্যসব ক্ষতিকর স্বত্বা যা বিভিন্ন ধর্ম এবং বিশ্বাসে অনুসৃত হয়; যেমন নির্বাসিত ফিরিশতা, পিশাচ এবং জ্বীন নিম্নতর মানবিক চরিত্রের প্রলক্ষণ। যা অর্জন বা আয়ত্ত করে মানুষ সৃষ্টিকর্তা থেকে দূরে চলে যায়।
শাটান সম্পর্কে স্যাটানিষ্টদের মধ্যে নানাপ্রকার মতবাদ প্রচলিত আছে। তারা তার ঔদ্ধত্যকে দেবতুল্যঞ্জানে পূজা করে। তাদের মন্তব্য হল কোনকিছু গ্রহণ বর্জনে ব্যক্তিপছন্দের স্বাধীনতা থাকা উচিত। অনেক শাটানী মতবাদ স্যাটানিষ্টদের দ্বারা সৃষ্টি হয়নি বরং তা প্রবর্তিত হয়েছে প্রগতিশীল খ্রিস্টানদের মাধ্যমে। এর প্রকৃষ্ট উপমা হল মেডিভ্যাল লোকাচারবিদ্যা এবং ঈশ্বরতত্ত্ব। যা পিশাচ এবং ডাইনিভূতের কাল্পনিক গল্প দ্বারা পরিপূর্ণ। এর সমকালীন উদাহরণ ১৯৮০ সালের শাটানী ধর্মাচার এবং তদ্সংক্রান্ত আজগুবী নিয়মকানুনের চমকপ্রদ পরিবেশনা।
সংস্কৃতি উইকিপিডিয়াতে শাটানকে অভিহিত করা হয় নারদ মুনি হিসেবে। নারদ দেবতাদের সভার একজন বিচক্ষণ এবং সম্মানিত সদস্য। ইসলামে শাইতান সাটানেরই অনুরূপ এক প্রতিবাদী জঘন্য স্বত্বা। যার অর্থ astray -বিপথে পরিচালনাকারী, distant -বহু দূরবর্তী এবং devil -অশুভ অস্তিত্ব। যা মানব এবং জ্বীন উভয়ের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য।
আল্লাহপাক মানবজাতিকে বৈধ এবং পবিত্র বস্তু ভক্ষণ করার অধিকার দিয়েছেন কিন্তু শয়তানকে অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। কারণ শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। আল্লাহপাক বলেন, ‘হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যে সকল বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা হতে তোমরা আহার কর কিন্তু শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করনা। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সূরা বাকারা ঃ ১৬৮)
মানুষ যখন আল্লাহর করুণারাশি ভুলে যায়, তার শান্তিময় স্মরণ থেকে গাফিল হয়ে অশুভ চর্চার দিকে ধাবিত হয় তখন আল্লাহপাক তার জন্য একজন শয়তান নিযুক্ত করেন। যে তাকে প্রতিদিন মন্দ সংসর্গ দিয়ে অন্যায় অশ্লীলতা এবং আল্লাহদ্রোহিতার মধ্যে নিমগ্ন রাখে। আল্লাহপাক বলেন, ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হয় আমি তার জন্য নিয়োজিত করি একজন শয়তান, অতঃপর সে হয় তার সহচর।’ (সূরা যুখরুফ: ৩৬)
যারা কাফির তারা কুচক্রী শয়তানের ক্রীড়নক। তাদের অবাধ্যতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতার বেপরোয়া গতিধারা শয়তানই নিয়ন্ত্রণ করে। শয়তান তাদের মনোলোকে মন্দকাজের প্রেরণা সৃষ্টি করে। মিথ্যা স্বপ্নের প্রহেলিকা সাজিয়ে তাদের অসার দর্শনের ভিত্তিহীন ইমারত বিমূর্ত করে তোলে। আল্লাহপাক বলেন ঃ ‘তুমি কি লক্ষ্য করনা যে, আমি কাফিরদিগের জন্য শয়তানদেরকে ছেড়ে দিয়েছি মন্দ কাজের দিকে তাদেরকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করার জন্য।’ (সূরা মারয়াম: ৮৩)
শয়তান তার প্রহশন বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করে। সে মেঘমালার আড়ালে লুকিয়ে ফিরিশতাদের নিকট থেকে আল্ল¬¬াহর ফায়সালা সম্পর্কীয় কথাবার্তা শুনে নিয়ে তার সাথে মিথ্যার রঙ মেখে মানুষের কাছে প্রচার করে। হযরত ওরওয়াহ ইবনে যোবায়ের (রা.) নবী সহধর্মিনী হযরত আয়শা (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, ফিরিশতারা মেঘরাশির অন্তরালে অবতরণ করে আসমানে আল্লাহর ফায়সালাকৃত বিধান সম্পর্কে আলোচনা করে থাকে। শয়তানরা গোপনে চুরি করে তা শুনবার চেষ্টা করে এবং কিছুটা শুনে ফেলে। অতঃপর সেই সত্য কথার সাথে নিজেদের বানানো মিথ্যার মিশ্রন ঘটিয়ে মানুষের নিকট কল্যাণপ্রসূত অলীক তথ্য প্রকাশ করে। (বুখারী)
শয়তান হল এক রহস্যময় আল্লাহদ্রোহী স্বত্বা। নিজ অবাধ্যতার জন্য আল্লাহর নিকট সে অভিশপ্ত হয়েছে। আল্লাহর করুণা হতে বিতাড়িত হয়ে সে মানুষকে পথভ্রষ্ট করার শপথ গ্রহণ করেছে। আল্লাহপাক বলেনঃ ‘যখন ফিরিশতাদের বললাম, ‘আদমকে সিজদা কর’ তখন ইবলিস ব্যতীত সকলেই সিজদা করল। সে অমান্য করল এবং অহংকার করল। সুতরাং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হল।’ ( বাকারা ঃ ৩৪)
আদম সৃষ্টি করে আল্লাহ তায়ালা তাকে নিজ স্বত্বা এবং বিশ্বজাহানের জ্ঞান-পান্ডিত্যে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তার প্রতিনিধি হওয়ার সর্ববিধ যোগ্যতায় বিভূষিত করার পর ফিরিশতাদের আদেশ করলেন সিজদার দ্বারা তাকে সম্মান দেখাতে। সকল মালায়কা এ আদেশ সাগ্রহে পালন করলেও ইবলিস ঔদ্ধত্য সহকারে অস্বীকৃতি জানাল। কুরআন বলেঃ ‘আল্লাহ বললেন, হে ইবলিস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি সিজদাবনত হতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে, না তুমি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন?’ সে বলল, আমি তার থেকে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং ওকে সৃষ্টি করেছেন কর্দম থেকে।’ (সূরা সাাদ: ৭৫-৭৬ )
পবিত্র কুরআনের একশত স্থানে শয়তানের ঘৃণ্য পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। খান্নাস নামে একবার, ইবলিস নামে এগার বার এবং শয়তান নামে আটাশি বার। যে শয়তান জান্নাত থেকে বিবস্ত্র করে আদম-হাওয়াকে বের করেছিল, সে এবং তার দল মর্তলোকে মানুষকে পথভ্রষ্ট করার কাজে তৎপর। আল্লাহ বলেনঃ ‘হে বনি আদম! শয়তান যেন তোমাদের কিছুতেই প্রলুব্ধ না করে যেভাবে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল; লজ্জাস্থান উম্মুক্ত করে তাদের করেছিল লজ্জিত। সে নিজে এবং তার দল তোমাদের এমন ভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাওনা। যারা ঈমান আনেনা শয়তানকে আমি তাদের অভিভাবক করেছি।’ (সূরা আরাফ : ২৭)
শয়তান আল্লাহকে বলেছিল তার বান্দাদের এক বিপুল অংশকে নিজের অনুসারী বানাবে। মিথ্যাবাসনার প্রহেলিকায় ঘুরপাক খাওয়ায়ে তাদের দ্বারা পৃথিবীময় অপকর্মের নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে। এভাবে আদম সন্তানকে নরকের ইন্ধনে পরিণত করে সে তার জঘন্য অভিলাষ করবে চরিতার্থ। মানুষের ভেতরে এমন এক প্রবৃত্তি বিদ্যমান যার উপর যুগপৎ শয়তান এবং ফিরিশতার প্রভাব প্রকটিত হয়। প্রবৃত্তির আসক্তি অনুযায়ী কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, কেউ আবার ফিরিশতার সমুজ্জ্বল সান্নিধ্যে পুলকিত হয়ে আল্লাহপুরস্তির দিকে ধাবিত হয়।
হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন: মানুষের সাথে শয়তানের একটি ছোঁয়াছ এবং ফিরিশতার একটি ছোঁয়াছ রয়েছে। শয়তানের ছোঁয়াছ হল অমঙ্গলের ভীতি প্রদর্শন এবং সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা। পক্ষান্তরে ফিরিশতার স্পর্শ হল মঙ্গলের সুবার্তা প্রদান এবং সত্যের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন। সুতরাং যে ব্যক্তি ফিরিশতার আবেশ অনুভব করবে সে যেন মনে করে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে। এর জন্য যেন সে শুকরিয়া আদায় করে। আর যে ব্যক্তি বিপরীত অবস্থা অনুভব করবে সে যেন দাগাবাজ শয়তান হতে আল্লাহর নিকট পানাহ চায়। অতঃপর রাসূলে কারীম (সা.) এ আয়াত পাঠ করলেন ঃ আশ্ শাইত্বানু ইয়াদিকুমুল ফাকরা ওয়া ইয়ামুরুকুম বিল ফাহ্শা-‘। অর্থাৎ শয়তান তোমাদেরকে অভাবের ভয় দেখায় এবং অশ্লীলতার নির্দেশ দেয়।’ ( সূরা বাকার: ২৬৮ )
আল্লাহপাক বলেন ঃ ‘যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে তাহলে আল্লাহকে স্মরণ করবে , তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। যারা তাকওয়ার অধিকারী হয় তাদেরকে শয়তান যখন কুমন্ত্রণা দেয় তখন তারা আত্মসচেতন হয় এবং তৎক্ষণাৎ তাদের চোখ খুলে যায়।’ (সূরা আ‘রাফ: ২০০-২০১)
মানুষকে পথভ্রষ্ট করার শয়তানী কৌশল হল মদ জুয়া মুর্তিপূজা লটারী বা ভাগ্য নির্ণায়ক বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট করা। মদ এবং জুয়া এমন একটি ভারসাম্যহীন সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি করে যার কারণে সবখানে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহপাক বলেনঃ ‘হে মুমিনগণ, মদ জুয়া মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্যবস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবেনা।’ (সূরা মায়িদা: ৯০-৯১)
সমাজে অনাচারের সয়লাব ঘটিয়েই শয়তান ক্ষান্ত হয়না। তার চরম টার্গেট সচ্চরিত্র এবং আল্লাহভীরু লোকদের উৎখাত করার জন্য নারকীয় অপতৎপরতায় মেতে ওঠা। আল্লাহপাক বলেনঃ ‘এরা হল শয়তান, যারা তোমাদেরকে তার বন্ধুদের দ্বারা ভয় দেখায়। তোমরা যদি প্রকৃত মুমিন হয়ে থাক তাহলে তাদেরকে ভয় করনা এবং আমাকে ভয় কর।’ (সূরা আল ইমরান : ১৭৫)
হযরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেনঃ শয়তান পানির উপর তার সিংহাসন স্থাপন করে। অতঃপর মানুষের মধ্যে ফ্যাসাদ সৃষ্টির জন্য চারদিকে তার সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে। এদের মধ্যে তার নিকট সর্বাধিক সম্মানিত সেই ব্যক্তি যে সবচেয়ে বেশি ফ্যাসাদ সৃষ্টি করতে পারে। তাদের মধ্যে কেউ এসে তাকে বলে, প্রভু আমি এরূপ কষ্টকর কর্ম সম্পাদন করেছি। সে তখন বলে তুমি কিছুই করতে পারনি। রাসূল (সা.) বলেনঃ অতঃপর আর একজন এসে বলে, আমি মানব সন্তানকে ছাড়িনি, এমনকি তার এবং তার স্ত্রীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছি। রাসূল (সা.) বলেনঃ ‘শয়তান তাকে নৈকট্য দান করে এবং বলে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট তুমিই। রাবী আ‘মাশ বলেন, আমি মনে করি জাবির (রা.) রাসূল (সা.) থেকে এও বলেছেন, অতঃপর শয়তান তার সাথে আলিঙ্গন করে।’ (মুসলিম , মিশকাত )
মুনাফিকরা শয়তানের দোসর। সমাজে শয়তানের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তারা খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তারা মুমিনদের শক্তিমত্তা এবং ইসলামী ইনকিলাবের কর্মপন্থা জানার অভিপ্রায়ে প্রকৃত স্বরূপ গোপন করে প্রতারণার পথ অবলম্বন করে। মুমিনদের সাথে বিশ্বাসযোগ্য আচরণ করলেও নিভৃতে তারা যখন তাদের শয়তানীচক্রের সাথে মিলিত হয় তখন হাস্যকৌতুকে মশগুল হয়ে যায়। ধোকা দেয়ার খলনাটকে তাদের নিপুন পারঙ্গমতার জন্য তারা বন্ধুদের কাছে প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। তাদের গোমরাহী এবং পাপের বিশাল খাতা ভরে না ওঠা পর্যন্ত আল্ল¬¬াহ ঢিলে দিয়ে থাকেন। কুরআন বলে ঃ‘ যখন তারা মুমিনদের কাছে আসে তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি। আর নিভৃতে শয়তানদের সাথে মিলিত হয়ে বলে, ‘আমরা তো তোমাদের সাথেই, ওদের সাথে তামাশা করছি মাত্র। আল্লাহও ওদের সাথে তামাশা করেন আর অবাধ্যতায় দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটে বেড়ানোর অবকাশ দেন।’ (সূরা বাকারা: ১৪-১৫)
রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন: মানুষের মধ্যে তারাই নিকৃষ্টতম যাদের দুটো মুখ। একমুখে একজনের সাথে কথা বলে। অন্যমুখে কথা বলে অপর জনের সাথে। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে এ হাদীস সংকলিত হয়েছে বুখারী ও মুসলিম থেকে।
মুনাফিকদের এ আচরণ জঘন্য অন্যায় অসুন্দর অত্যন্ত অপছন্দনীয় এবং দ্রত পরিত্যাজ্য অপরাধ। সংকটময় পরিবেশে আপন অবস্থান ঝুঁকিহীন এবং বিপদমুক্ত রাখার জন্য মুনাফিকরা কপটতার আশ্রয় নেয়। সত্যকে উপলব্ধি করার পরও পার্থিব স্বার্থের কাছে তারা তাদের বিশ্বাসকে বিক্রি করে দেয়।
হযরত হাসান (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন ঃ প্রিয়নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘এক ব্যক্তিকে বেহেশতের দরজা খুলে তাতে প্রবেশ করার জন্য ডাকা হবে। কিন্তু যখন সে নিকটবর্তী হবে তখন দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। অতঃপর তাকে বেহেশতের অন্য দরজা থেকে আহ্বান করা হবে। সে কাছে গেলে সে দরজাও বন্ধ হয়ে যাবে। এভাবে তাকে ডেকে বারবার অপমান করা হবে। অবশেষে সে এমন হতাশ হয়ে পড়বে যে ডাকলেও আর দরজার নিকট যাবেনা।’
বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে শয়তান মুশরিকদের অন্তরে কুমন্ত্রণা দিয়ে তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে উৎসাহ দান করে। সে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদেরকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। কিন্তু যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং মুসলমানরা আল্লাহর উপর নির্ভর করে প্রবল পরাক্রমে কাফেরদের প্রতিরোধ ব্যুহ তছনছ করে ফেলে তখন শয়তান তাদেরকে সাহায্য করতে অপারগতা প্রকাশ করে।
কুরআন বলে ঃ ‘স্মরণ কর, শয়তান তাদের কাজকর্ম শোভন করেছিল তাদের দৃষ্টিতে এবং বলেছিল, ‘আজ মানুষের মধ্যে তোমাদের উপর কেউ বিজয়ী হবেনা। আমি তোমাদের পাশেই থাকব। যখন দুই দল পরস্পরের সম্মুখীন হল, তখন সে কেটে পড়ল এবং বলল, তোমাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক থাকল না। তোমরা যা দেখতে পাওনা আমি তা দেখি। আমি আল্লাহকে ভয় করি, আর আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।’ (সূরা আনফাল: ৪৮)
শয়তান এবং তার সহযোগীরা মানুষের সামনে নানান রকমের যুক্তি এবং মতবাদ তুলে ধরে। অর্থনীতি, দর্শন, সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং চিত্রকলায় মুক্তবুদ্ধির জিগির তুলে তারা মানুষকে আল্লাহর বিধানের বিরোধিতা করতে উৎসাহ যোগায়। কুরআন প্রদর্শিত সহজ সুন্দর জীবন ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে তারা মানুষকে এমন এক দূর্বোধ্য আইনের নিগঢ়ে বেঁধে ফেলে, শতাব্দীর পর শতাব্দী চেষ্টা করেও মানুষ সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারেনা। শয়তানের দোসরদের এই হীন কর্মকান্ডের কথা স্মরণ করে দেয়ার জন্য আল্লাহপাক বলেন ঃ ‘এদের তুলনা শয়তান যে মানুষকে বলে, ‘কুফরী কর’। মানুষ যখন কুফরী করে তখন শয়তান বলে, ‘তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি। ফলে উভয়ের পরিণাম হবে জাহান্নাম। সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং এটাই জালিমদের কর্মফল।’ (হাশর ঃ ১৬-১৭)