আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ মানব-সত্তায় বহুবিধ চাহিদা জুড়ে দিয়েছেন। আবার, এই আল্লাহই মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য যা যা প্রয়োজন সবই সৃষ্টি করেছেন। তদুপরি আল্লাহ মানুষকে তার চাহিদা পূরণে সম্পদ আহরণ, সম্পদ রূপান্তরিতকরণ এবং সম্পদ ভোগ-ব্যবহারের জন্য জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্ম-ক্ষমতা দান করেছেন। এই জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্ম-ক্ষমতা প্রয়োগ করেই মানুষ আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব করে থাকে। মানুষের কোন কোন চাহিদা আপনা-আপনিই পূরণ হয়। কোন কোন চাহিদা মানুষ একক প্রচেষ্টায় পূরণ করতে পারে। কোন কোন চাহিদা পূরণের জন্য মানুষকে অপরাপর মানুষের সহযোগিতা নিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের নানাবিধ চাহিদা পূরণের জন্যই পরিবার, বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা, আর্থিক সংস্থা এবং রাষ্ট্র-সংগঠন গড়ে ওঠে।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য চাই বায়ু। পৃথিবীর চারদিকে একটি পুরো বায়ুমণ্ডল জুড়ে দিয়ে আল্লাহ মানুষের এই চাহিদা পূরণ করেছেন।এই চাহিদা আপনা-আপনি পূরণ হয়। শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে বায়ু অটোমেটিক মানুষের ফুসফুসে যাতায়াত করে। বায়ুর চাহিদা মেটাবার জন্য মানুষকে কষ্ট করতে হয় না। চেষ্টা চালাতে হয় না। শীতের দিনে শীত তাড়াবার জন্য তাপের প্রয়োজন। তাপ লাভের অন্যতম উপায় রোদ পোহানো। কেউ শীত তাড়াতে চাইলে রোদে গিয়ে দাঁড়ালে শীত দূর হয়। এইভাবে তাপ লাভের জন্য তাকে কারো সহযোগিতা নিতে হয় না। অর্থাৎ সে একাই তার এ চাহিদা পূরণ করতে পারে।
বেঁচে থাকার জন্য মানুষের খাদ্য চাই। আল্লাহ শস্য, ফল, শাক-সবজি, তরি-তরকারি ইত্যাদি উৎপন্ন করার উপযুক্ত করে মাটি সৃষ্টি করেছেন। এই মাটি কর্ষণ করে, এতে বীজ বপন করে এবং চারাগাছ পরিচর্যা করে এইগুলোর উৎপাদন নিশ্চিত করতে হয়। আবার, চুলোর উপর পাতিলে সেদ্ধ করে এইগুলো খাওয়ার উপযোগি করতে হয়। খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এবং খাদ্য প্রস্তুতকরণের বিভিন্ন স্তরে একজন মানুষকে অপরাপর মানুষের সহযোগিতা নিতে হয় এবং আল্লাহ পৃথিবীময় যেইসব উপাদান মওজুদ করে রেখেছেন সেইগুলোর রূপান্তর ঘটিয়ে অপরাপর মানুষ যেইসব উপকরণ তৈরি করেছে, সেইগুলোর সাহায্য নিতে হয়। অর্থাৎ সে একা এ চাহিদা পূরণ করতে পারে না।
মানুষের চাহিদার তালিকা বেশ দীর্ঘ। মানুষের খাদ্য চাই, পানি চাই, ঘর চাই, পোশাক চাই, ঔষধ চাই, শিক্ষা চাই, ভাব প্রকাশের সুযোগ চাই, বাহন চাই, নিরাপত্তা চাই, যুল্মের প্রতিকার চাই। ইত্যাদি। মানুষের যাবতীয় প্রয়োজন মেটানো বা চাহিদা পূরণের জন্য মানুষের জীবনকে স্বচ্ছন্দ করার জন্য, মানুষের জীবনকে সুন্দর করার জন্য এবং মানুষের জীবনকে সমুন্নত করার জন্য আল্লাহ যেইসব নিয়ামাতের ব্যবস্থা করেছেন সেইগুলো সবই মানুষের রিয্ক।উল্লেখ্য যে অন্যান্য সৃষ্টির রিয্কের ব্যবস্থাও আল্লাহই করে থাকেন। রিয্ক তালাশের নির্দেশ
এই পৃথিবীর অংগনে মুমিনদেরকে দুইটি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে হয়। একটি হালাল জীবিকা উপার্জনের সংগ্রাম, অপরটি আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্রাম। জীবিকা উপার্জনে উদাসীন হওয়া, সংসার ত্যাগী হওয়া, বৈরাগী হওয়া, সন্ন্যাসী হওয়া এবং আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্রাম বিমুখ হওয়া ইসলাম নির্দেশিত জীবন ব্যবস্থা নয়। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
لاَرَهْباَنِيَّةَ فىِ الْاِسْلاَمِ
“ইসলামে রাহবানিয়াত বা বৈরাগ্যবাদ নেই। -মুসনাদে আহমাদ
”আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَرَهْبَانِيَّةَ نِ ابْتَدَعُوْهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ –
“আর বৈরাগ্যবাদ তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে, আমি ওটা তাদের ওপর চাপিয়ে দেইনি।” সূরা আল হাদীদ : ২৭
وَلَقَدْ مَكَّنَّاكُمْ فِى الأَرْضِ وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيْهَا مَعَايِشَ قَلِيْلاً مَّا تَشْكُرُوْنَ
“আমি তোমাদেরকে পৃথিবীতে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছি এবং এতে তোমাদের জন্য জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করেছি। তোমরা সামান্যই শুকরিয়া আদায় করে থাকো।” [সূরা আল আ‘রাফ ঃ ১০]
هُوَ الَّذِىْ خَلَقَ لَكُمْ مَّا فِى الْأَرْضِ جَمِيْعاً
“তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীর সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন।” সূরা আল বাকারা : ২৯
وَآتَاكُمْ مِّنْ كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ وَإِنْ تَعُدُّواْ نِعْمَتَ اللهِ لاَ تُحْصُوْهَا
“এবং তোমরা যা চাও (অর্থাৎ তোমাদের চাহিদা পূরণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন) সবই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। তোমরা যদি আল্লাহর নিয়ামাত গুলো গণনা করতে চাও তা করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।” সূরা ইবরাহীম : ৩৪
هُوَ الَّذِىْ جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُولًا فَامْشُوْا فِىْ مَنَاكِبِهَا وَكُلُوْا مِنْ رِّزْقِه وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ
“তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে অনুগত বানিয়ে দিয়েছেন। অতএব তোমরা এর বুকে বিচরণ কর এবং আল্লাহর দেওয়া রিয্ক (আহরণ করে) খাও। আবার জীবিত হয়ে তোমাদেরকে তাঁর দিকেই যেতে হবে।” সূরা আল মুলক : ১৫
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন:
ياَ أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا إِذَا نُوْدِىَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَّومِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ. فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ وَاذْكُرُوْا اللهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, জুমু‘আর দিন যখন ছালাতের জন্য ডাকা হয় আল্লাহর স্মরণে দৌড়ে আস, বেচাকেনা ছেড়ে দাও। এটা তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জান। ছালাত আদায় করে যমীনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ কর এবং বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাক। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।” সূরা আল জুমু‘আ : ৯, ১০
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
اُطْلُبُوا الرِّزْقَ فِىْ خَباَ ياَ الْاَرْضِ
“তোমরা মাটির গভীর তলদেশে রিয্ক তালাশ কর।” [আয়িশা (রা), মুসনাদু আবী ইয়া‘লা]
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا
“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন।” [সূরা আল বাকারা : ২৭৫]
لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُواْ فَضْلاً مِّنْ رَّبِّكُمْ
“(হাজের সময়ে) তোমরা যদি তোমাদের রবের অনুগ্রহ (রিয্ক) তালাশ কর এতে কোন দোষ নেই।” [সূরা আল বাকারা : ১৯৮]
…وَجَعَلْنَا آيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِّتَبْتَغُواْ فَضْلاً مِّنْ رَّبِّكُمْ
“এবং আমি দিনকে করেছি আলোকোজ্জ্বল যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ (রিয্ক) তালাশ করতে পার।” …[সূরা বানী ইসরাঈল : ১২]
وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا
“এবং আমি দিনকে জীবিকা উপার্জনের সময় বানিয়েছি।” [সূরা আন নাবা : ১১]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
ماَ اَكَلَ اَحَدٌ طَعاَماً قَطُّ خَيْرًا مِّنْ اَنْ يَّاْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ.
“কারো জন্য নিজের হাতের উপার্জনের চেয়ে উত্তম খাবার আর নেই।”আল্লাহর রাসূলকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, “কোন্ উপার্জন উত্তম?” [মিকদাম ইবনু মা‘দী কারাব (রা), সহীহ আল বুখারী]
তিনি বললেন,
عَمَلُ الرَّجُلِ بِيَدِه وَكُلُّ بَيْعٍ مَّبْرُوْرٍ.
“ব্যক্তির নিজের হাতের উপার্জন এবং সৎ ব্যবসা।” [রাফে‘ ইবনু খাদীজ (রা), মিশকাতুল মাছাবীহ]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন
,اِذَا صَلَّيْتُمُ الْفَجْرَ فَلاَ تَنُوْمُوْا عَنْ طَلْبِ اَرْزَاقِكُمْ.
[আনাস ইবনু মালিক (রা), আলকাউলুল মুসাদ্দাদ]
“তোমরা ছালাতুল ফাজর আদায়ের পর তোমদের রিয্ক তালাশে নিয়োজিত না হয়ে ঘুমিয়ে থেকো না।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
طَلَبُ كَسْبِ الْحَلاَلِ فَرِيْضَةٌ بَعْدَ الْفَرِيْضَةِ.
“নির্ধারিত ফারযগুলোর পর হালাল জীবিকা তালাশ করাও ফারয।” [আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রা), সুনানু আল বাইহাকী]