সমাজশুদ্ধির পেছনে ভূমিকা আত্মশুদ্ধির

imagesCABGXCPH

দ্বীন-ধর্ম ও আমানতদারি মানুষের হৃদয় থেকে সম্পূর্ণ মিটে যাচ্ছে। ঘুষের বাজার গরম। নীতিনৈতিকতা, সভ্যতা ও ভদ্রতার মৃত্যু ঘটেছে প্রায়। সর্বত্র দুর্নীতির ঝড় বইছে। এ জাতীয় কথা রাত-দিন আমরা কোনো না কোনোভাবে শুনে থাকি। এ অভিযোগ অবান্তরও নয়। বাস্তবে জীবনের সবস্তরেই স্পষ্টত অধঃপতন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। সর্বোপরি সামাজিক দুর্নীতি আমাদের ঘুণ পোকার মতো কুরে কুরে খাচ্ছে।

অন্যদিকে সমাজ সংস্কারের চেষ্টা সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সেখানেও কোনো প্রকার কমতি নেই। কত সংস্থা, কত দল আর কত সংগঠন যে সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং নিজ নিজ চৌহদ্দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে, এর ইয়ত্তা নেই। অথচ সামগ্রিকভাবে এগুলোর কোনো প্রভাব গোচরীভূত হয় না। বরং মনে হয়, সংস্কারের সব নৌকা বাঁকা পথেই চলছে। এর কারণ কি?

সমাজ সংস্কারের এসব প্রয়াস ফলপ্রসূ না হওয়ার ‘কারণ’ হল প্রত্যেকেই সংস্কারের পতাকা হাতে নিতে চায়, সংশোধনটা যেন অপরের দিক থেকে শুরু হোক_ এভাবে অন্যকে আহ্বান করে, সংস্কারের মুখরোচক বাণী ও সেস্নাগান শোনায়। অথচ নিজ অবস্থার পরিবর্তন সাধনে সম্পূর্ণ উদাসীনতা দেখায়। আমাদের সব সংস্কারমূলক প্রচেষ্টা এ কল্পিত মনস্তাত্তি্বক ভিত্তির ওপর অগ্রসর হয় যে, আমি ছাড়া দুনিয়ার সবাই খারাপ। তাদের সংশোধনের দায়িত্ব আমার ওপর। খুব কম মানুষের মাঝেই এ চিন্তা জাগে যে, আমাদের নিজেদের মধ্যেও কিছু দোষ আছে এবং সর্বপ্রথম আমার আত্মশুদ্ধি প্রয়োজন। নিজেদের ব্যাপারে গাফেল থেকে শুধু অন্যদের সংশোধন করার লক্ষ্য নিয়ে সমাজশুদ্ধিমূলক যাবতীয় কর্মসূচি ও তৎপরতা পরিচালিত হওয়ায় সমাজে তা কার্যকর হয়ে ওঠে না। সব কর্মসূচি ও তৎপরতা তখন পরিণত হয় নিছক লোক দেখানোর জন্য। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন,
যে ব্যক্তি বলবে, মানুষ নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যের ওপর আপত্তি করে বলবে, তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। সর্বাধিক ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যক্তি সে নিজেই (মুসলিম)।

কারণ অন্যের ওপর আপত্তি করার অর্থ বাস্তবেই সে যা বলছে, সেটার ভয় যদি তার অন্তরে থাকত, তা হলে সর্বপ্রথম নিজেকে সংশোধন করার ফিকির করত। নিজেকে সংশোধন করার অর্থ হল কমপক্ষে সমাজে এক ব্যক্তি পরিশীলিত হওয়া। প্রদীপ থেকে প্রদীপ জ্বলে। ব্যক্তির মধ্যে সংশোধনের চিন্তা ব্যাপক হলে ধীরে ধীরে পুরো সমাজ শুদ্ধ ও পরিমার্জিত হয়ে যাবে। কেননা ব্যক্তি সমষ্টির নামই তো সমাজ। মনে করুন একটি ভয়ঙ্কর অগি্নকু-লী গোটা এলাকা গ্রাস করার জন্য যার জিহ্বা লকলক করছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের তৎপরতা কি হবে? নিশ্চয়ই প্রতিটি ব্যক্তি তখন আগুন নেভানোর তৎপরতায় সক্রিয় হয়ে উঠবে। ফায়ার ব্রিগেডকে ফোন করবে এবং সাধ্যমতো সব প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে কিংবা কমপক্ষে নিজে সেখান থেকে সরে পড়বে। এ পরিস্থিতিতে যদি কোনো ব্যক্তি এসব তৎপরতায় অংশগ্রহণ না করে এবং আগুন থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান না করে বরং আগুনের বিবরণ তেল-নুন দিয়ে বর্ণনা করে এবং নিজেও তাতে ঝাঁপ দেয়, তা হলে সে চরম নির্বোধ ও উন্মাদ ছাড়া আর কিই-বা হতে পারে?
অথচ সামাজিক দুর্নীতিরূপী যে আগুনের আলোচনা আমরা রাত-দিন করে থাকি, বিস্ময়ের ব্যাপার হল এ সম্পর্কে আমাদের তৎপরতা এ রকম যে, আমরা ‘তেল-নুন’ মাখিয়ে এর সমালোচনা করি, তারপর নিজেরাই এতে জড়িয়ে পড়ি। রাত-দিন দুর্নীতিবাজ, প্রতারক ও হারামখোরদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করি অথচ সুযোগ পেলে নিজেও এগুলোয় নির্দ্বিধায় যুক্ত হয়ে যাই। এ কর্মপন্থার দৃষ্টান্ত কি ঠিক এরূপ নয় যে, কোনো ব্যক্তি জ্বলন্ত অগি্নকু-ের বর্ণনা দিয়ে নিজেই তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সমাজে যখন অন্যায় ও অপকর্ম ব্যাপক রূপ ধারণ করে, তখন আমাদের করণীয় কী, সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের চিন্তা কর। তোমরা যখন সৎ পথে রয়েছো, তখন কেউ পথভ্রান্ত হলে তাতে তোমাদের ক্ষতি নেই।’ (সুরা-আল-মায়েদা : ১০৫)।

পবিত্র আয়াত এ সোনালি মূলনীতি পেশ করে যে, সমাজ ও তার দুর্নীতির সমালোচনায় সর্বদা মুখর থাকার মধ্যে সমস্যার প্রকৃত সমাধান নিহিত নেই; বরং সমস্যার সমাধান এই যে, আমার দায়িত্বে আল্লাহ ও বান্দার যেসব কর্তব্য এবং অধিকার রয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে আদায় করা। নিজের দায়িত্ব পালন করা। সর্বপ্রথম নিজে ঠিক হওয়া, তারপর অন্যকে সংশোধন করার চেষ্টা করা। মূলত সমাজ সংশোধন করার সর্বপ্রথম পদক্ষেপ এটাই। স্মরণ করা যেতে পারে, আমি, আপনি ও কিছু সংখ্যক মানব সদস্যের সমষ্টির নামই তো সমাজ। যদি প্রত্যেকে সর্বপ্রথম নিজের কথা ভাবে যে আগে আমি ঠিক হয়ে যাই, তা হলে ধীরে ধীরে সমাজ ঠিক হয়ে যাবে। এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন-চার, এভাবে প্রদীপ থেকে প্রদীপ জ্বলতে থাকবে। তখন সমাজ সংস্কারের যে কোনো কর্মসূচি সহজেই মানুষকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। দুর্নীতির যে সাইক্লোন আমরা দেখতে পাচ্ছি, ধীরে ধীরে তা স্তিমিত হয়ে যাবে। আজ দুর্নীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সমাজের উদর ফাঁপিয়ে তুলছে ঘুণ ও উইপোকা। কিন্তু এ কালের চিকিৎসকরা ওপর দিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে পানি। ফলে সমাজের দিগন্তে আশার কোনো ঝিলিক দেখা যাচ্ছে না। আল-কোরআন এসব ব্যর্থ চেষ্টার পরিবর্তে প্রকৃত সমাধান পেশ করেছে এবং মানুষকে মানুষ বানানোর জন্য ব্যক্তি ও আত্মশুদ্ধির দিকনির্দেশনা দিয়েছে। কোরআনের এ উজ্জ্বল ফর্মুলার মাঝেই রয়েছে সমাজশুদ্ধির প্রকৃত কর্মকৌশল।   (সমাপ্ত)

Related Post