স্বাগতম মাহে রমজান, রমযান মাসে করণীয় বিষয় জানতে আমাদের এই প্রবন্ধটি পাঠ করুন
১। আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে প্রথমে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে।
২। সকল পাপ-গুনাহ থেকে তাওবার মাধ্যমে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে।
৩। সকল প্রকার জুলুম অন্যায় থেকে বের হয়ে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে।
৪। যাদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে।
ভাল কাজের মাধ্যমে রমযানের দিবস-রজনী যাপনের মানসিকতা নিয়ে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে।
এ ধরনের আবেগ অনুভূতির মাধ্যমেই আশাসমূহ পূর্ণ হয়। ব্যক্তি ও সমাজ তাদের সম্মান ফিরে পায়। এর বিপরীতে রমযান যদি কেবলই একটি অন্ধ অনুকরণের বিষয় হয়। কেবলই কিছু সীমিত প্রভাবের নিষ্প্রাণ আচার পালনের নাম হয়। যদি এমন হয় যে রমযানে, পুণ্যের বদলে, পাপ ও বক্রতা বেড়ে যায়, তবে এটা হবে নিশ্চয়ই একটি আত্মিক পরাজয়, এটা নিশ্চয় শয়তানের ক্রীড়া, যার বিরূপ প্রভাব ব্যক্তি ও সমাজের উপর পড়তে বাধ্য।
রোযার হাকীকত
অনেক এমন রয়েছে যারা রোযার হাকীকত সম্পর্কে বেখবর। তারা রোযাকে কেবলই খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকার মধ্যে সীমিত করে দিয়েছে। তাদের রোযা মিথ্যাচারিতায় জিহ্বা লম্বা করতে বারণ করে না। চোখের ও কানের লাগাম তারা উন্মুক্ত করে দেয়। তারা গুনাহ ও পাপে নিপতিত হতে সামান্যও উৎকণ্ঠিত হয় না। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন:
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ وَالْجَهْلَ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ أخرجه أحمد والبخاري
যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা, সে অনুযায়ী কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করল না, তার খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।
কবি সত্যই বলেছেন:
রক্ষিত যদি না হয় কর্ণ. — দৃষ্টিতে না থাকে বাধা.
তবে বুঝে নিও —এ রোযা কেবলই তৃষ্ণা ও পিপাসা।
যদি বলি আমি আজ রোযা, —মনে করিও আমি আদৌ রোযাদার নই।
রমযান মাসে বিশেষ কিছু আমল:
১। কুরআন পুরোটা অর্থসহ পড়া:
যারা খতম তারাবীতে যাবেন তাদের জন্য, দিনের বেলা সেই রাতের তারাবীতে পড়াবে এমন কুরআনের অংশটুকুর অর্থসহ বুঝে পড়া, প্রয়োজনে তাফসীরসহ পড়ে নেওয়া। এখানে তেলাওয়াতকৃত আয়াতগুলো হতে বিষয় ভিত্তিক আয়াতগুলো, দারস তৈরি করার চেষ্টা করা। যারা আগ্রহী তারা মার্কার পেন বা কলম দিয়ে দাগিয়ে পড়তে পারেন অথবা ডায়েরীতে লিখে নিতে পারেন কোন্ কোন্ আয়াত বিষয় ভিত্তিক।
এখানে আরেকটু করা যায়, এই সময়ে সমগ্র কুরআনের আল্লাহর শেখানো দোয়াগুলো আমরা ডায়েরীতে তুলে ফেলে ধীরে ধীরে সেগুলো মুখস্ত করতে পরি।
প্রতি সূরা শেষ করে পরিবারের সবাইকে কিংবা নিজের শাখা বা অঞ্চলের দ্বীনি ভাইদের নিয়ে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো আলোচনা করা।
২। সহীহ হাদীসগুলো ধীরে ধীরে জানা:
ঐ রকম ভাবে সহীহ বুখারী-মুসলিম ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থের সহীহ হাদীসগুলো থেকে উক্ত দিন গুলোতে আমরা নামায, রোযা, যাকাত বা দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কিত প্রতিদিন কমপক্ষে একটি হাদীস পড়া।
৩। জীবনী থেকে শিক্ষাগ্রহণ:
রাসূলের জীবনী-মহিলা সাহাবী অথবা সাহাবা চরিত ভালো করে জানার সঙ্গে সঙ্গে সালফে সালেহীনদের জীবনী আমাল করার পদ্ধতি জানার চেষ্টা করা।
৪। নামায:
প্রতি পাঁচ ওয়াক্তের সাথে রাতে তারাবীহ, তাহাজ্জুদ ও দিনের বিভিন্ন নফল নামায পড়ার চেষ্টা করা। এই সময়ে আমরা সবাই সেহরীতে উঠি, একটু আগে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে এর উপকারিতা লাভ করতে পারি। প্রতিদিনই তারাবীহ যেন আদায় করি। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ
তাদের পার্শ্বদেহ বিছানা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের প্রভুকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে। (সূরা আস সিজদা : ১৬)
আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র এরশাদ করেন:
أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ ۗ
যে ব্যক্তি রাতের বেলা সিজদার মাধ্যমে অথবা দাঁড়িয়ে ইবাদত করে, পরকালকে ভয় করে এবং তার রবের রহমত প্রত্যাশা করে (সে কি তার সমান যে এরূপ করে না)। (: যুমার ৯)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত রাত্রে জাগতেন ও নামায আদায় করতেন। এ প্রসঙ্গে আয়শা রা. বলেছেন :
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا: أَنَّ نَبِيَّ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقُومُ مِنَ اللَّيْلِ حَتَّى تَتَفَطَّرَ قَدَمَاهُ، فَقَالَتْ عَائِشَةُ: لِمَ تَصْنَعُ هَذَا يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَقَدْ غَفَرَ اللَّهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ؟ قَالَ: «أَفَلاَ أُحِبُّ أَنْ أَكُونَ عَبْدًا شَكُورًا
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের বেলায় নামাযে (এত দীর্ঘ সময়) দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তার পা দুটো যেন ফেটে যেত। আমি তাকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এমনটি করছেন কেন? অথচ আপনার পূর্ব ও পরের সব গুনাহ মাফ হয়ে গিয়েছে। তিনি বললেন, ‘আমি কি (আল্লাহর) কৃতজ্ঞ বান্দাহ হব না?’ (বুখারী ও মুসলিম)
আবদুল্লাহ ইবন সালাম থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ سَلامٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْه ، قَالَ : لَمَّا رَأَيْتُ وَجْهَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلِمْتُ أَنَّ وَجْهَهُ لَيْسَ وَجْهَ كَذَّابٍ , وَكَانَ أَوَّلَ مَا سَمِعْتُهُ يَقُولُهُ : ” أَيُّهَا النَّاسُ ! أَفْشُوا السَّلامَ, وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ , وَصِلُوا الأَرْحَامَ , وَصَلُّوا وَالنَّاسُ نِيَامٌ , تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ بِسَلامٍ
`হে লোকসকল! তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, খাবার খাওয়াও, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা কর এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়। (এগুলো করে) তোমরা নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (তিরমিযী)
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” رَحِمَ اللَّهُ رَجُلًا قَامَ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّى وَأَيْقَظَ امْرَأَتَهُ ، فَإِنْ أَبَتْ نَضَحَ فِي وَجْهِهَا الْمَاءَ ، رَحِمَ اللَّهُ امْرَأَةً قَامَتْ مِنَ اللَّيْلِ وَصَلَّتْ وَأَيْقَظَتْ زَوْجَهَا ، فَإِنْ أَبَى نَضَحَتْ فِي وَجْهِهِ الْمَاءَ ” قَالَ : وَفِي رِوَايَةٍ : ” إِذَا قَامَ أَحَدُكُمْ مِنَ اللَّيْلِ فَلْيُوقِظْ أَهْلَهُ ، فَإِنْ لَمْ تَسْتَيْقِظْ فَلْيَنْضَحْ عَلَى وَجْهِهَا الْمَاءَ
`আল্লাহ করুণা করুন ঐ ব্যক্তির উপর, যে রাতে উঠে নামায পড়ে এবং তার স্ত্রীকে জাগিয়ে দেয়। স্ত্রী যদি উঠতে না চায় তাহলে তার মুখমন্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়। আল্লাহ করুণা করুন ঐ নারীর প্রতি, যে রাতে উঠে নামায পড়ে এবং তার স্বামীকে জাগিয়ে দেয়। স্বামী যদি উঠেতে না চায় তাহলে তার মুখমন্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়। (আবু দাউদ)
আমাদের প্রয়োজন নামাযে পঠিত সব সূরা ও তাসবীহ দরূদ অন্যান্য যা পড়ি তা এখন থেকে আবার সুন্দর সহীহ ও অর্থগুলো জানার কাজ শুরু করা।
৫। যিকর–
এ ছাড়া বাকী সময়গুলো সব সময় আল্লাহর যিকিরে নিজের জিহ্বাকে সিক্ত রাখা, যেমন রান্না বা অন্য কাজের সময় দোয়া এস্তেগফার দরূদ পড়া।
৬। দান:
এ সময় নিকটাত্মীয় গরীব, মিসকীন, ফকীর এদের মাঝে সাহায্য বাড়ানো। নিজের ঘরের যে অধিনস্ত লোক থাকে কাজের জন্য তাকে সাহায্য করা।
৭। প্রতিদিনই কাউকে ইফতার করানো:
একটি খেজুর কিংবা একটি লেবেন বা জুস দিয়ে হলেও। গরীব আত্মীয়দের বাসায় উপহার হিসাবে ইফতারের কিছু কাঁচা মাল (খেজুর, ছোলা, মুড়ি) আগেই পাঠিয়ে দেয়া। আর ধনীদের মাঝে ইসলামের শিক্ষার জন্য বই উপহার দেয়া বা কিনতে উৎসাহিত করা। পরিবারের সবাই মিলে ইফতারের আয়োজন হালকা করে ইফতারের আগের সময়টুকু কুরআন তেলাওয়াতে ও দোয়ায় নিজেকে ব্যস্ত রাখা এবং পরিবারের সবাইকে নিয়ে ইফতার সামনে রেখে এক সাথে আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
৮। রোযাতে অধীনস্ত কাজের লোকদের কাজ হালকা করে দেয়া:
এবং তাদেরকেও ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞান দান করা। এবং নিজে যা খাবে চাকর-বাকরকেও তাই খেতে দিবে।
৯। নাবালক অর্থাৎ ছোটদেকে মাঝে মধ্যে রোযা রাখার অভ্যাস করা।
১০। সংশোধন:
নিজের মাঝের দোষগুলো বের করে একটি একটি করে সেগুলো থেকে সরে আসা এবং তওবা করে আল্লাহর বিধান পালনে যত্নশীল হওয়া।
১১। দোয়া করা:
রমযানের মাসের প্রতি দিন ও রাতে আল্লাহ দোয়া কবুল করেন, তাই আমাদের রমযানের পূর্বে প্রত্যেক দিন নির্দিষ্ট করে দোয়া করা।
১২। কদর রজনীতে বিশেষভাবে ইবাদত করা:
শবে-ক্বদরের রাতগুলো (শেষ দশদিনের বেজোড় রাত) বিশেষ ভাবে রাত জেগে এবাদত করা। বরং উচিত শেষ দশদিন কিয়ামের নামায নিয়মিত পড়া, তবেই কদর পাওয়া যাবে ইনশা আল্লাহ
১৩। ইতেকাফ করা:
শেষ দশদিনে ইতেকাফে বসার সুযোগ করা ।
১৪। ফিতরা
সঠিক সময়ে আদায় করা।
১৫। যাকাত
সঠিক হিসাবে ও সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করা।
পরিশেষে বলবো, আসুন আমরা রমযান মাসের মর্যাদা রক্ষা করি এবং রাসূল (সা.)-এর বলে দেওয়া নিয়মে এই মাসে ইবাদত বন্দেগী করি। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সকলকে সেই তাওফীক ও শক্তি দান কর। আমীন।