Main Menu

হিজরী সনরে সুচনা ও প্রয়োজনীয়তা

is

চন্দ্র পরিক্রমার সাথে সম্পর্কিত হিজরি সন বর্তমান বিশ্বের প্রায় দেড়শ কোটি আল্লাহপ্রেমী মানুষের কাছে অতি পবিত্র, মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ সন। মুসলিম উম্মাহর ঐতিহাসিক সাল গণনায় হিজরি সন এক মহান ঘটনার স্মারক। হিজরি সন মহানবী সা. এর হিজরতের ১৮ বছর পর দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর রা: এর নির্দেশে তারই যুগ থেকে প্রচলিত হয়েছে কিন্তু তার গণনা আরম্ভ হয়েছে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. এর হিজরতের দিন থেকে।

চান্দ্র মাসের সূচনা

যদিও হিজরি বা চন্দ্র তারিখ গণনা আরম্ভ হয়েছে মহানবীর সা: হিজরতের সময় থেকে, কিন্তু চান্দ্র মাসের সূচনা হয়েছে এ পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,

إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ ۚ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنفُسَكُمْ*  

  আসলে যখন আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তখন থেকেই আল্লাহর লিখন ও গণনায় মাসের সংখ্যা বারো চলে আসছে৷ এর মধ্যে চারটি হারাম মাস৷ এটিই সঠিক বিধান৷ কাজেই এ চার মাসের নিজেদের ওপর জুলুম করো না ৷ (সূরা তাওবা : ৩৬)।

অর্থাৎ যখন আল্লাহ চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তখন থেকেই এ হিসাবও চলে আসছে যে, প্রতি মাসে প্রথমার চাঁদ একবারই উঠে৷ এ হিসাবে এক বছরে ১২ মাস হয়৷

৩৫ . অর্থাৎ যেসব উপযোগিতা ও কল্যাণকারিতার ভিত্তিতে এ মাসগুলোতে যুদ্ধ করা হারাম করা হয়েছে সেগুলোকে নষ্ট করো না৷ এবং এ দিনগুলোতে শান্তি ভংগ করে বিশৃংখলা ছড়িয়ে নিজেদের ওপর জুলুম করো না৷ চারটি হারাম মাস বলতে যিলকদ্দ, যিল হজ্জ ও মহররম মাসে হজ্জের জন্যে এবং উমরাহের জন্য রজব মাস৷

হিজরি সন গণনার প্রয়োজনীয়তা

মক্কার অধিবাসীরা ছিল হজরত ইব্রাহিম আ:-এর নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাসী ও তার শরিয়ত অনুসরণের দাবিদার। বলাবাহুল্য ইব্রাহিমী শরিয়ত মতেও নিষিদ্ধ মাসগুলোতে যুদ্ধবিগ্রহ এমনকি জন্তু শিকার নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু কিছু দুষ্টাচারী শরিয়তের বিধান ভঙ্গ করে স্বীয় স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নানা টালবাহানার আশ্রয় নিত। কখনো এ মাসগুলোতে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতে চাইলে কিংবা যুদ্ধের সিলসিলা নিষিদ্ধ মাসে প্রসারিত হলে তারা বলত, বর্তমান বছরে এ মাস নিষিদ্ধ নয়, আগামী মাস থেকেই নিষিদ্ধ মাস শুরু হবে। যেমন যুদ্ধ চলাকালে মহররম মাস এসে পড়লে বলত, এ বছরের মহররম মাস নিষিদ্ধ মাস নয়, বরং তা হবে সফর বা রবিউল আউয়াল মাস। অথবা বলত, এ বছরের প্রথম মাস হলো সফর, মহররম হবে দ্বিতীয় মাস।

সার কথা তারা মহান আল্লাহর চিরাচরিত নিয়মের বিরুদ্ধে বছরের যেকোনো চার মাসকে তাদের সুবিধামতো নিষিদ্ধরূপে গণ্য করে নিত। যে মাসকে ইচ্ছা, জিলহজ বা রমজান নামে অভিহিত করত। এমনকি অনেক সময় যুদ্ধবিগ্রহে ১০টি মাস অতিবাহিত হলে বর্ষপূর্তির জন্য আরো কয়েকটি মাস বাড়িয়ে দিয়ে বলত- এ বছরটি হবে চৌদ্দ মাস সম্বলিত। অতঃপর অতিরিক্ত চার মাসকে সে বছরের নিষিদ্ধ মাসরূপে গণ্য করত।

মূলত তারা দ্বীনে ইব্রাহিমের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখিয়ে বছরের চারটি মাসের সম্মান করে যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকত। কিন্তু মহান আল্লাহ মাসের যে ধারাবাহিকতা রেখেছেন, তাতে নানা হেরফের করে নিজেদের স্বার্থ পূরণ করে নিত। ফলে সেসময় কোন মাস প্রকৃত রমজান বা শাওয়াল এবং কোন মাস প্রকৃত জিলকদ বা রজব তা নির্ধারণ করা দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। অষ্টম হিজরি সনে যখন মক্কা বিজিত হয় এবং নবম সালে মহানবী সা: হজরত আবু বকরকে রা: হজের মওসুমে কাফিরদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ঘোষণার জন্য পাঠিয়েছিলেন, সে মাসটি প্রকৃত প্রস্তাবে যদিও ছিল জিলহজ মাস, কিন্তু জাহেলি যুগের সেই পুরনো প্রথা অনুসরণে তা জিলকদই সাব্যস্ত হলো এবং সে মতে তাদের সে বছরের হজের মাস ছিল জিলহজের স্থলে জিলকদ।

অতঃপর দশম হিজরি সনে মহানবী সা: বিদায় হজের জন্য মক্কায় আগমন করেন, তখন অবলীলাক্রমে এমন ব্যবস্থাও হয়ে যায় যে, প্রকৃত জিলহজ জাহিলী হিসাব মতেও জিলহজই সাব্যস্ত হয়। এ জন্য মহানবী সা: মিনা প্রান্তরে প্রদত্ত খুতবায় এরশাদ করলেন, ‘কালের চক্র ঘুরেফিরে সেই নিয়মের ওপর এসে গেল, যার ওপর আল্লাহ আসমান ও জমিনের সৃষ্টি করেন।’ অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে যে মাসটি জিলহজ তা জাহিলী প্রথানুসারে জিলহজই সাব্যস্ত হয়ে গেল (মাআরিফুল কুরআন)।

জাহিলী প্রথায় মাস গণনার এই রদবদল ও বিনিময়ের ফলে কোনো মাস বা দিন বিশেষের সাথে সম্পৃক্ত ইবাদত ও শরিয়তের হুকুম আহকাম পালনেও বিস্তর জটিলতা সৃষ্টি হতো। যেমন- জিলহজের প্রথম দশকে রয়েছে হজের আহকাম, দশই জিলহজে কোরবানি, দশই মহররমের রোজা, মাহে রমজানের রোজা এবং বছরের শেষে জাকাত আদায়ের হুকুম প্রভৃতি।

মুসলিম বিশ্বে চাঁদের হিসাবে অনেক ইবাদত-বন্দেগি, আমল অনুশাসন পালিত হওয়ায় হিজরি সনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। মূলত এসব কারণেই প্রয়োজন হয়ে পড়ে একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও পরিকল্পিত সন গণনার হিসাব।

হিজরি সন গণনার সূত্রপাত

হিজরত মুসলমানদের দিনপঞ্জি গণনার প্রারম্ভ হিসাবে নির্ধারিত হয় খলিফা হজরত উমর রা:-এর সময় থেকে। ইসলামী বিধিবিধান প্রতিপালন ও পরিকল্পিত সন গণনার প্রয়োজনেই মূলত হিজরি সনের উদ্ভব। এ ছাড়াও বিভিন্নভাবে কথিত আছে যে, অর্থব্যবস্থা পরিচালনা সুসংহতকরত নথিপত্র প্রস্তুত ও কর ধার্য করার পর আদায়ের তারিখ নির্দিষ্ট করা সম্পর্কে হজরত উমর রা: বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হন। উপরন্তু দলিলপত্রে তারিখ উল্লেখ না থাকায় নানা অসুবিধার সৃষ্টি হয়।

আল বিরুনী কর্তৃক উদ্ধৃত একটি বিবরণীতে আছে, হজরত আবু মুসা আল-আশয়ারী রা: হজরত উমর রা:-এর কাছে লিখিত এক পত্রে বলেন, ‘আপনি আমাদের নিকট চিঠিপত্র পাঠাচ্ছেন কিন্তু তাতে কোনো তারিখের উল্লেখ নেই।’ খলিফা বিষয়টি অধীনস্থদের সাথে আলাপ করেন এবং গ্রিস ও পারস্যে প্রচলিত পদ্ধতি পরীক্ষান্তে কাল গণনায় দিনপঞ্জি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। কেউ কেউ প্রস্তাব করেন যে, মহানবী সা:-এর জন্মদিন থেকে ওই তারিখ গণনা করা হোক, কিন্তু ওই তারিখ নিশ্চিত নয়। কথিত আছে, তখন হজরত আলী রা: প্রস্তাব করেন যে, হিজরতকে দিনপঞ্জির প্রারম্ভ তারিখরূপে গ্রহণ করা হোক। কারণ বাস্তবপক্ষে ওই দিন থেকে মহানবী সা: শাসনক্ষমতা গ্রহণ করতে শুরু করেন এবং সেজন্য দিনটি চিরস্মরণীয়।

হিজরতের ১৬, ১৭ বা ১৮ বছর পর কিন্তু সাধারণ স্বীকৃত মতে ১৭ বছর পরে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই অব্দ নির্ধারণের আগে মুসলমানগণ বিশেষ বিশেষ ঘটনার ভিত্তিতে বছরগুলোর নামকরণ করতেন। যথাÑ অনুমতির বছর, ভূমিকম্পের বছর, বিদায়ের বছর প্রভৃতি। মহানবী সা: যখন ইসলাম প্রচার করতে শুরু করেন, আরববাসী তখন ‘হস্তীর বছর’ থেকে কাল গণনা করছিল।

হিজরতের বছরটি তৎপর হিজরি অব্দের প্রথম বছর নির্ধারিত হয়েছিল। মাসগুলো যেমন প্রচলিত ছিল তেমনি রইল এবং মহররমকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ধরা হলো। সুতরাং হিজরি সনের শুরু ধরা হলো ঠিক হিজরতের দিন থেকে নয়, তৎপরিবর্তে এই বছরের ১ মহররম থেকে। প্রথম দিনটি ছিল জুমাবার, মুতাবেক ১৬ জুলাই ৯৩৩ সেলুকেসীয় বছর এবং জুলিয়ান দিনপঞ্জির ৬২২তম অব্দ।

শেষ কথা

হিজরি সন ইসলাম পুনর্জাগরণের প্রধান ও অবিসংবাদিত প্রতীক এবং মুসলমানদের বিজয় ও সাফল্যের এক জ্বলন্ত ইতিহাস। উজ্জ্বল অমর কীর্তি ও চিরন্তন ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্যবাহী হিজরি সনের অনুসরণ করে গোটা ইসলামী জাহান মুসলিম উম্মাহর সঠিক ও শাশ্বত অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে মানজিলে মাকসুদের প্রতি এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পায়

Related Post