Main Menu

হযরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা.)

হযরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা

হযরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা.)

পূর্বে প্রকাশিতের পর

 বীরত্ব, নৈতিক দৃঢ়তা এবং ধৈর্য-সহ্য
আরব ভূমির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সেখানকার শিশুরা উদার এবং দানশীল হয়ে থাকে, তেমনি বীরত্ব আর সাহসিকতাও তাদের স্বভাবজাত ধর্ম। দানশীলতায় হযরত আসমার যেমন খ্যাতি ছিল, তেমনি বীরত্বের জন্যও তিনি ছিলেন মশহুর। সাঈদ ইবনুল আছ এর শাসনকালে মদীনায় যখন ফেতনা-ফাসাদ-বিপর্যয় দেখা দেয়, শহরে অশান্তি বিরাজ করে, চারিদিকে চুরি-ডাকাতি শুরু হয়, হযরত আসমা তখন শিয়রে খঞ্জর নিয়ে ঘুমাতেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করে, আপনি কেন এমন করেন? জবাবে তিনি বলেন, কোন চোর-ডাকাত এসে আমার উপর হামলা করলে আমি তার ভূড়ি কেটে ফেলবো। তার পুত্র আবদুল্লাহ পরিণত বয়সে হিজরী ৬৬ সালে আরবীয় ইরাকের শাসনকর্তা হন। এটা ছিল এমন সময়, যখন উমাইয়্যা শাসনকর্তা ইয়াযীদ ইসলামে পাপ-অনাচার বিস্তার করা শুরু করে, চারিদিকে বিপর্যয়-অরাজকতা দেখা দেয়। হাজার হাজার লোক এই বিভ্রান্ত ইয়াযীদের হাতে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে। কিন্তু হযরত আব্দুল্লাহ ইয়াযীদের হাতে বায়আত গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। মক্কাকে কেন্দ্র করে তিনি সেখান থেকে খেলাফতের আওয়ায তোলেন। যেহেতু সকলেই তাঁর বীরত্ব, মহত্ব, সত্যবাদীতা ও সহজ-সরল জীবন ধারার কথা স্বীকার করতো, তাই দলে দলে লোকেরা তার খেলাফতের দাবিতে সাড়া দিয়ে তার প্রতি সমর্থন জানাতে থাকে।
পরবর্তীকালে আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান উমাইয়্যা সাম্রাজ্যের শাসন-কর্তৃত্ব হাতে নিয়ে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফকে মক্কার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। হাজ্জাজ আব্দুল্লাহ্ ইবনে যুবায়ের-এর সাথে লড়াইয়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং হিজরী ৭২ সালের পয়লা জিলহজ্ব মক্কা অবরোধ করে। মক্কায় রসদ সামগ্রী প্রেরণ বন্ধ করে দেয়। উভয় বাহিনীর মধ্যে দীর্ঘ ৬মাস ধরে লড়াই চলতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অবরোধের ফলে কাহিল হয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের এর সমর্থকদের অনেকেই পলায়ণ করতে বাধ্য হয়। মাত্র গুটি কতেক লোক তার সমর্থক থাকে। এ সময় হযরত আব্দুল্লাহ্ মাতা আসমার খেদমতে হাযির হয়ে আরয করেন ঃ
আম্মাজান! ওফাদারদের বে-ওফায়ী আর অবশিষ্টদের অধৈর্যের ফলে আমি অস্থির হয়ে উঠেছি। কি করি, কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার অনুমতি পেলে আনুগত্য মেনে নেবো। কারণ, আনুগত্য স্বীকার করে নিলে হাজ্জাজ এবং তার সমর্থকদের কাছে যা কিছু দাবি করবো, সবই তারা মেনে নিতে পারে। জবাবে মাতা হযরত আসমা বলেন, প্রিয় পুত্র ! তুমি ভালো জান। তুমি মনে কর যে, সত্য ও ন্যায়ের জন্য লড়ছ, তাহলে তোমাকে অটল-অবিচল মেনে নেবে না। সম্মানের সাথে তরবারীর আঘাত খাওয়া অপমানের জীবনের চেয়ে অনেক উত্তম। তুমি শাহাদাত বরণ করলে আমি আনন্দিত হবো। আর তুমি নশ্বর দুনিয়ার লোভী প্রমাণিত হলে তোমার চেয়ে খারাপ আর কে হতে পারে? এমন লোক নিজেও খারাপ হয়, আর অপরকেও ধ্বংস ও জিল্লতীর চরমে নিয়ে ছাড়ে। তুমি যদি মনে কর যে, তুমি একা, আনুগত্য ছাড়া আর কোন উপায় নেই; এটা শরীফ লোকদের কাজ নয়। তুমি কতকাল বেঁচে থাকবে? একদিন তো মরতেই হবে। তাই তোমার জন্য উত্তম হচ্ছে সুনাম রেখে মরা। এতে আমি আননিন্দত হবো। মাতার সোনালী উপদেশ শুনে হযরত আব্দুল্লাহ বললেন, আমার আশঙ্কা হচ্ছে সিরীয়রা মৃত্যুর পর আমাকে নানা প্রকার শাস্তি দেবে।
হযরত আসমা জবাবে বলেন ঃ
পুত্র তুমি যে আশঙ্ককা প্রকাশ করছ, তা নিঃসন্দেহে সত্য। কিন্তু বকরী জবাই করার পর তার খাল ছিলে ফেলা হোক, বা তাকে দিয়ে কিমা করা হোক, তাতে বকরীর কোন কষ্ট হয় না।
অতঃপর হযরত আবদুল্লাহ প্রিয় মাতার হাতে চুমু খেয়ে বলেন, আসলে আমিও তাই মনে করি। আমি সত্যের জন্য দুনিয়াকে তুচ্ছ মনে করি। আমি নিছক দ্বীনের স্বার্থে এ কাজ করছি। আজ আমি লড়াই করে অবশ্যই শাহাদাত লাভ করবো। আপনি কোন দুঃখ, কোন অনুতাপ করবেন না। মা! প্রিয় মা আমার! আজ পর্যন্ত তোমার পুত্র কোন পাপ কাজ করেনি। শরীয়তের বিধান জারীর ক্ষেত্রে ইচ্ছা করে কোন ভুলও করেনি। শাসন কর্তাদের যুলুম-নির্যাতনে আনন্দিতও হয়নি।
অতঃপর আকাশের দিকে মুখ তুলে বলেন, আল্লাহ! তুমি জান, আমি মাকে যা কিছু বলেছি, তা সবই বলেছি তার সান্ত¡নার জন্য, যাতে তিনি অবস্থা দেখে দুঃখ না পান। হযরত আসমা আরো বলেন, প্রিয় পুত্র! আমি আশা করি, তোমার ক্ষেএে আমার ধৈর্য হবে এক নযীরবিহীন ধৈর্য। তুমি আমার সামনে শহীদ হলে তা হবে আমার মুক্তির কারণ, আর তুমি বিজয়ী হলে তা হবে আমার জন্য আনন্দ ও শোকর আদায়ের কারণ। এখন আল্লাহর নাম নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হও এবং পরিণাম কি হয় দেখ।
অতঃপর হযরত আবদুল্লাহ মায়ের নিকট দোয়া চেয়ে লৌহবর্ম পরিধান করে শেষ বারের মতো মায়ের সাথে দেখা করতে আসেন। মাতা হযরত আসমা দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহকে বিদায় দিতে গিয়ে তার সাথে কোলাকুলি করার সময় হাতে লৌহবর্ম অনুভব করে বললেন, প্রাণ প্রিয় পুত্র আব্দুল্লাহ! যারা শাহাদাতের জন্য আকাঙ্খী, তারা লৌহবর্ম পরিধান করে না। হযরত আবদুল্লাহ বলেন, আমি আপনার মন জয় করার জন্য লৌহবর্ম পরিধান করেছি মাত্র। মাতা বললেন, লৌহবর্ম দ্বারা আমার মনকে তুষ্ট করা যাবে না। বুকে সাহস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়। হযরত আব্দুল্লাহ তাই করলেন। একটি কবিতা আবৃত্তি করতে করতে তিনি ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন, শত্রু বাহিনীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ধীরে  বিক্রমে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত শাহাদত  বরণ করেন।
শাহাদাতকালে আবৃত্তি করা কবিতাটি ছিল এই ঃ
انى اذا اعرف يومى اصبر
وانما يعرف يومة الحر
اذ بغضهم يعرف ثم ينكر.
-আমি যখন আমার দিনে অবস্থা দেখি, ধৈর্য ধারণ করি।
আর স্বাধীনচেতা ব্যক্তি তো তার দিন সম্পর্কে ভালোই জানে।
কিন্তু কিছু লোক এমনও আছে, যারা জেনেও অস্বীকার করে।
শাহাদাতের পর হাজ্জাজ হযরত আব্দুল্লাহর লাশ প্রকাশ্য রাজপথে ঝুলিয়ে রাখে। তিন দিন পর হযরত আসমা দাসীকে সাথে নিয়ে এসে দেখেন, নিচের দিকে মাথা দিয়ে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এহেন মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে নিজেকে সংবরণ করে তিনি বললেন, ইসলামের ঘোড়সওয়ার দ্বীন-মিল্লাতের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ এ বীর।
সত্যবাদীতা ছিল হযরত আসমার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের মতো নিষ্ঠুর যালেমের সামনেও সত্য বলতে তিনি ইতস্তত করেননি। বরং তিনি তাঁকে দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেন। হযরত আব্দুল্লাহ্র শাহাদাতের পর হজ্জাজ হযরত আসমার নিকট এসে বলে, তোমার ছেলে আব্দুল্লাহ্ আল্লাহর ঘরে বেদ্বীনী বিস্তার করেছিল, তাই আল্লাহ তার উপর কঠোর শাস্তি নাযিল করেছেন। জবাবে হযরত আসমা বলেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আমার ছেলে বেদ্বীন ছিল না। আমার ছেলে ছিল রোযাদার, রাতে নামায গুযার, পরহেযগার ও ইবাদতগুযার। পিতা-মাতার একান্ত বাধ্য অনুগত সন্তান। আমি নবীজীর কাছে একটি হাদীস শুনেছি। তিনি বলেছেন, সকীফ গোত্রে দু’জন লোক হবে। এদের প্রথমজন হবে দ্বিতীয় জনের চেয়ে জঘন্য। এদের মধ্যে একজন মিথ্যাবাদী অর্থাৎ মোখতার সকফীকে তো আমি দেখেছি। আর অপর যালেম তুমি, যাকে আমি এখন দেখছি তার এই তিক্ত জবাবে হাজ্জাজ  জ্বলে উঠলেও শেষ পর্যন্ত চুপ থাকে। এক বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হাজ্জাজ হযরত আসমাকে বলে, আমি তোমার পুত্রের সাথে এ আচরণ করেছি। তখন তিনি জবাবে বলেন, তুমি আমার পুত্রের দুনিয়া বরবাদ করেছ আর নিজের করেছ আখেরাত বরবাদ। আমি এটাও শুনেছি যে, তুমি উপহাস করে আমার পুত্রকে বলতে ইবনু যাতিন নেতাকাইন-দুই নেতাকওয়ালীন পুত্র। হ্যাঁ, আমি আমার নেতাক দিয়ে আঁ-হযরত সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আমার পিতা হযরত আবূ বকর (রাঃ) এর খানা বেঁধেছিলাম। আমি এ হাদীসও শুনেছি যে, সকীফ গোত্রে একজন মিথ্যাবাদী এবং একজন যালেমের জন্ম হবে। মিথ্যাবাদীকে তো আমি দেখেছি। আর যালেম হচ্ছে তুমি। হাজ্জাজ এ হাদীস শুনে প্রভাবিত হয় এবং কেটে পড়ে। কিছুদিন পর আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের নির্দেশে লাশ নামানো হয় হযরত আসমা লাশ চেয়ে নিয়ে গোসল করান। লাশের জোড়া বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। গোসল করাতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু এই মর্মবিদারী দৃশ্য দেখেও হযরত আসমা ধৈর্য ধরণ করেন। হযরত আসমা ইবনেয় ও নম্র স্বভাবের হলেও বোন হযরত আয়েশার মতো ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ছিলেন। হাজ্জাজের দম্ভ আর ঔধ্যত্যের সামনেও তার ব্যক্তিত্ব ইসলামের ইতিহাসে অক্ষয় ও স্মরণীয় হয়ে আছে।
ওফাত
হযরত আসমা আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন, আল্লাহ! আব্দুল্লাহর লাশ দেখার আগে আমাকে মৃত্যু দেবে না। আল্লাহ্ তাঁর এ দোয়া কবুল করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহর শাহাদতের এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই হিজরী ৭৩ সালের জমাদিউল আওয়াল মাসে নশ্বর জীবনের শত বর্ষ পূর্ণ করে মক্কা মুয়াযযামায় তিনি ইন্তিকাল করেন। বয়স একশ বছর পূর্ণ হলেও তার একটা দাঁত পড়েনি। হুঁশ-জ্ঞানও সম্পূর্ণ ঠিক ছিল। তার কদ ছিল লম্বা। দেহ ছিল মাংশল ও সুঢৌল। শেষ পর্যন্ত শক্তি-সামর্থ সবই অটুট ছিল।
৩১হিজরী সালে তার স্বামী হযরত যুবায়ের যখন জামাল যুদ্ধ থেকে ফিরে আসছিলেন, তখন আমর ইবনে জরমুয মুজাশেয়ী নামে জনৈক ব্যক্তি সেবা উপত্যাকায় তাকে হত্যা করে। তিনি এ ঘটনা জানতে পেরে ব্যথিত হন এবং এ শোক গাথা পাঠ করেন ঃ
ইবনে জরমুয যুদ্ধের দিন একজন সাহসী যোদ্ধার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে। আর তা করেছে এমন সময় যখন সে ছিল নিরস্ত্র। আমর! তুমি তাকে আগে জানিয়ে দিলে তার মনে ভয় দেখতে পেতে না, হাতে দেখতে না কম্পন। তোমার মাতা তোমার জন্য কাদন করুক, তুমি একজন মুসলমানকে হত্যা করেছো। তোমার উপর অবশ্যই আযাব আসবে। একদিকে স্বামীর হত্যা আর অপর দিকে বক্ষের পুতুল কলিজার টুকরা পুত্রের শাহাদত, এদুটি ঘটনা তার জন্য কেয়ামতের চেয়ে কম ছিল না। কিন্তু এ হৃদয় বিদারক ঘটনা যে অশেষ ধৈর্য-সহ্যের সাথে তিনি হযম করেছেন, তা কেবল হযরত আসমার মতো মহাপ্রাণ মহিলার পক্ষেই সম্ভব।

Related Post