(চার) সুন্নাতে রাসূল (সা.)ঃ
সুন্নাতে রাসূল (সা.) এর পরিচয়: সুন্নাহ শব্দের অর্থ-পথ, তরিকা, নিয়মনীতি ও পন্থা। শরীয়াতের পরিভাষায় এই শব্দটি একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহহৃত হয়। কুরআন মজীদে সুন্নাত শব্দের উল্লেখ রছেয়ে বিভন্নভাবে। যেমন: সূরা ফাতেহ এর ২৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে: “আল্লাহর সুন্নাত যা পূর্ব থেকেই কার্যকর হয়ে রয়েছে। আর আল্লাহর এ সুন্নাতে কোনোরুপ পরিবর্তন দেখবে না কখনো।” সূরা ফাতের এর ৪৩ আয়াতে বলা হয়েছে: তুমি আল্লাহর সুন্নাতে কোনোরূপ পরিবর্তন হতে- কোন প্রকারের ব্যতিক্রম হতে দেখবে না। এ ছাড়াও সূরা ইসরা এর ৭৭ আয়াতে সুন্নাত শব্দটি দু’বার ব্যবহৃত হয়েছে।
* ইমাম রাগেব ইসফাহানী লিখেছেন: আল্লাহতাআলার সুন্নাত বলা হয়, তাঁর কর্মকুশলতার বাস্তব পন্থাকে, তাঁর আনুগত্য করার নিয়ম ও পদ্ধতিকে। এভাবে দেখা যায় সুন্নাত শব্দটি যেমন আল্লাহর ব্যাপারে প্রয়োগ করা হয়েছে তেমনি করা হযেছে নবী ও রাসূরদের ক্ষেত্রেও।
* ইমাম রাগেব এর ভাষায়:
وسنة النبي طريقته التي كانت يتحراح
সুন্নাত হচ্ছে সেই নিয়ম, পন্থা ও পদ্ধতি, যা তিনি বাস্তব কাজে ও কর্মে অনুসরণ করে চলতেন।
* আল্লামা মুহাম্মদ বশির সাহসোয়ানীর ভাষায় ‘সুন্নাত’ হলো: সেই বিশেষ পথ, পন্থা ও পদ্ধতি- যা নবী কারিম (সা.) এর সময় থেকেই দ্বীন ইসলামের ব্যাপারে কোন কাজ করার বা না করার দিক দিয়ে বাস্তবভাবে অনুসরণ করা হয়- যার উপর দিয়ে চলাচল করা হয়।
* আল্লামা আবদুল আজীজ আল হানাফী লিখেছেন:
لفظ السنة شامل لقول الرسول صلى الله عليه و سلم وفعله عليه السلام وتطلق علي طريقة الرسول والصحابة اجمعين
সুন্নাত শব্দ বুঝায় রাসূলে কারীম (সা.) এর কথা ও কাজ। আর তা রাসূলে কারীম (সা.) এর সাহাবায়ে কিরামের বাস্তব কর্মনীতি বুঝাবার জন্যে ও ব্যবহৃত হয়।
* আল্লামা সফীউদ্দীন আল-হাম্বালী লিখেছেন: কুরআন ছাড়া রাসূলের যে কথা, যে কাজ বা অনুমোদন বর্ণনার সূত্রে পাওয়া গেছে তা-ই সুন্নাত।
যে মহান আখলাকে পরিপূর্ণতা নিয়ে আল্লাহ তাআলা বিশ্বনবী (সা.) কে জগতবাসীর জন্য পাঠিয়েছেন, তা তিনি নবূয়াতি দায়িত্বপারনের বিস্তৃত অঙ্গনে তথা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও সার্বিক পর্যায়ে-বিশ্বাসে, কথায় কর্মে ও সমর্থনে অনুসরণ করেছেন, তা-ই সুন্নাতে রাসূল (সা.)। নবুয়াতি ২৩ টি বছরের প্রতিটি পদক্ষেপ, তাঁর মুখ নিঃসৃত প্রতিটি বাণী ও অবস্থার প্রতিটি প্রকাশই সুন্নাতে রাসূর (সা.) এর মধ্যে শামিল। এমনকি নবী (সা.) এর সুন্নাহ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার পাক কালামের এক মাত্র নির্ভরযোগ্য সঠিক হেদায়েত ও কুরআনে পাকের ব্যাখ্যা। وجميع السنة شرح للقران
# সুন্নাহ ও হাদীসঃ হাদীস হচ্ছে ঐ জ্ঞানের নাম যার সাহায্যে নবী পাক (সা.) এর কথা, কাজ ও অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। এব্যাপারে মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল বুখারী (রা.) এর উক্তি হচ্ছেঃوهو علم يعرف به اقوال النبي وافعاله واحواله সুন্নাহ শব্দটি হাদীসের চাইতেও ব্যাপক। ইহাতে নবী (সা.) ছাড়াও সাহাবায়ে কিরাম, তাবে’য়ী ও তাবে-তাবে’য়ীদের কথা কাজ ও সমর্থনও রয়েছে।
لفظ السنة شامل لقول الرسول [ وفعله عليه السلام وتطلق علي طريقة الرسول والصحابة اجمعين
“সুন্নাহ শব্দটি রাসূলে পাক (সা.) এর কথা এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা) এর বাস্তব কর্মনীতি বুঝাবার জন্য ব্যবহৃত হয়।
# সুন্নাতে রাসূল (সা.) এর গুরুত্বঃ সুন্নাতেরাসূল (সা.) এর গুরুত্ব অপরিসীম। ইহা ইসলামের পিলার। ইহাকে বাদ দিলে ইসলামের গোটা ইমারাত ধসে পড়ার মত ফাটল সৃষ্টি হবে। কুরআনের পর ইসলামের মূল উৎস সুন্নাত। ইহার সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়লে আল্লাহর কালামও একটি দুর্বোধ্য কিতাবে পরিণত হবে। হেদায়াতের এই কিতাব এতই অস্পষ্ট হয়ে পড়বে যে, ইসলামের মূল বুনিয়াদি বিষয় যেমন নামায রোযা, হাজ্জ ও যাকাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও পণ্ডিতদের নিজেস্ব ও কল্পনার ধু¤্রজালে আচ্ছন্ন হতে বাধ্য। তাই ইসলামের স্থায়িত্ব ও হেফাজাত আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাতে রাসূল (সা.) এর উপর সমানভাবে নির্ভরশীল। আমি তোমাদের জন্যে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতদিন পর্যন্ত তোমরা এ বস্তুদয় আঁকড়ে থাকবে ততদিন তোমরা পথ হারা হবে না। উহা আল্লাহর কিতাব ও নবী পাকের সুন্নাহ। উল্লেখিত হাদীস থেকে কুরআন ও সুন্নাহর গুরুত্ব সুস্পষ্ট।
# সুন্নাহ অনুসরণের প্রয়োজনীয়তাঃ
দ্বীনের ব্যাপারে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি বিষয়ে, রাসূলে পাক (সা.) এর আনীত সব কিছুকে বিনা শর্তে গ্রহণ করার জন্য মুমিনদের প্রতি আল্লারাহর নির্দেশ। “রাসূল তোমাদের জন্যে যা পেশ করেন তা গ্রহণ করো আর যা থেকে নিষেধ করেন উহা থেকে ঁেবচে থাক (মুয়াত্তা)
(খ) স্রষ্টার ভালবাসা ও সন্তুষ্টি কামনাই সৃষ্টির উদ্দেশ্য। এর জন্য মানুষ সংসার সুখ ত্যাগ করে বনবাসী হয়। পারিবারিক জীবন ত্যাগ করে সন্যাসব্রত গ্রহণ করে। আরোপ করে স্বীয় জীবনের উপর কঠোর পন্থাসমূহ। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এ গুলো আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ নয়। সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণই আল্লাহর রেজামন্দি হাসিলের একমাত্র পথ। (সূরা আল ইমরান- ৩১)
নবীর প্রতি মুহাব্বত প্রকাশ একটি ইবাদাত। যাবতীয় ইবাদাতের পদ্ধতি সম্পর্কে হাদীসে এবং সাহাবায়ে কিরামের জীবনে রয়েছে বাস্তব নির্দেশিকা রাসূল (সা.) বলেন: আমার সুন্নাতকে গ্রহণ করা প্রকৃত প্রস্তাবে আমাকে গ্রহণ করা
(গ) যে কোন বিষয়য়ে নবীজি (সা.) এর আনীত বিচার-ফায়সালাকে বিচারকের পদ মর্যাদায় গ্রহণ করতে হবে। কেউ যদি রাসূলে কারীম (সা.) এর রায়ের উপর সন্তুষ্ট না থাকে তবে ঐ ব্যক্তির ঈমানের দাবী সত্য নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন: فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ
“তোমার রবের শপথ, তারা কখনো ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের যাবতীয় ব্যাপারে আপনার ফয়সালাকে সন্তুুষ্টচিত্তে মেনে নিবে এবং এ ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোন সংকোচ থাকবে না। (সূরা নিসা: ৬৫ )
(ঘ) জাহেলিয়াতের অন্ধকার আজ সমগ্র দুনিয়াকে গ্রাস করতে উদ্যত হচ্ছে। নব্য গোমরাহীর এ বেপরোয়া হামলা মুসলমানদের ঈমান আকিদাসহ তাদের আমল আখলাক দারুনভাবে বিপর্যস্ত। সর্বগ্রাসী এই বিপর্যয়ের মূল কারণ- সুন্নাতে রাসূল (সা.) থেকে মুসলমানদের দূরে সরে থাকা। রাসূল (সা.) এর এ ব্যাপারে সাবধান বাণী রয়েছে যে, ولوتركتم سنة نبيكم لضللتم- مسلم যারা আমার সুন্নাতকে ছেড়ে দেবে তারা অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে। (মুসলিম শরীফ)
(ঙ) উম্মতে মুহাম্মদী (সা.) এর মধ্যে আজ অনৈক্যর আগুন জ্বলছে, অসংখ্য বাতিল মতবাদ ও ফেরকায় উম্মত শতধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। উম্মতের এই ভয়াবহ ব্যাধির চিকিৎসা কিসে হতে পারে? এই প্রশ্ন আজ ভাবিয়ে তুলেছে উম্মতের জ্ঞানীদেরকে। একমাত্র সুন্নাতে রাসূলের মজবুত রশিই মুসলিম উম্মাহর এই ফেরকার কঞ্চিগুলোকে একটি আঁটিতে পরিণত করতে সক্ষম। অতীত জাতির পতন ও ধ্বংস এসেছিল এই বিভক্তি থেকেই। তাই নবী পাক (সা.) এই ব্যাপারে উম্মতকে পূর্বেই সাবধান করেছেন।
– تفرقت اليهود علي احد وسبعين فرقت النصارى علي اثنين وسبعين فرقة وستتفرق امتى على ثلاث وسبعين فرقة كلهم فى النار الا واحدة- قيل منهم يا رسول الله ؟ قال ما انا عليه واصحابى
অর্থাৎ ইয়াহুদীরা একাত্তর দলে ও নাসারারা বাহাত্তর দলে আর আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে।
শুধু একটি দল ছাড়া সকলেই জাহান্নামী। রাসূলকে (সা.) জিজ্ঞাসা করা হলো তারা কারা ? নবীজি (সা.) জবাবে বললেন, قال ما انا عليه واصحابى তারা আমি ও আমার সাহাবীদের অনুসারী।
ইত্তেবায়ে সুন্নাতের রাসূলের (সা.) তাৎপর্য ঃ
আমাদের অবিশ্যই ভেবে দেখতে হবে আম্বিয়ায়ে কিরামের আগমনের উদ্দেশ্য কি ছিল? কোন বিশেষ দায়িত্ব পালনের কারণে নবীগণ অকথ্য নির্যাতন ও নিপীড়ন ভোগ করেছেন, শাহাদাত বরণ করেছেন অগণিত নবী- রাসূল। কুরআন ও হাদীসের সাক্ষ্য এই যে, মানুষের উপর মানুষের জুলুম ও অন্যায়ের যাঁতাকল ভেঙ্গে তাদেরকে আযাদ করা, আল্লাহর বান্দাদের উপরে তারই শাসন প্রতিষ্ঠার মহা প্রযোজনে নবীদের আগমন হয়েছিল। কুরআন ঘোষণা করছে এভাবে: তিনি সে সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে হেদায়েত ও দ্বীনে হক সহকারে পাঠিয়েছেন।, যাতে তিনি তামাম বাতেল দ্বীনের উপর উহাকে বিজয়ী করে দেন। দ্বীনে হক প্রতিষ্ঠার এ দায়িত্ব ছিল সমস্ত নবীদের উপর আরোপিত আল্লাহর জিম্মাদারি। সত্যিকার অর্থে একামতে দ্বীনের এ কাজ ছিল তামাম পয়গাম্বরের আমলী সুন্নাত।
নবীজি (সা.) কে অনুসরণ ও ইত্তেবার ক্ষেত্রে মানবগোষ্ঠীর জন্যে সাহাবায়ে কিরামই একমাত্র আদর্শ। তাদের পরিচয় সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহাবা ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন,
وعن ابن مسعود (رض) قال اختارهم الله لصحبة نبيه ولإقامة دينه – (مشكوة)
আল্লাহতাআলা তাদেরকে বাছাই করেেছন নবীজি (সা.) এর সাহাচর্য দেয়ার জন্যে আর তাদের দায়িত্ব ছিল দ্বীন প্রতিষ্ঠার জিহাদ। (মিশকাত শরীফ) (চলবে——)