আল্লাহ তায়ালা সব মানুষের সঠিক পথে চলার জন্য পথনির্দেশনা হিসেবে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণকারী মাপকাঠি হিসেবে নাজিল করেছেন মহাগ্রন্থ আল কুরআন। কিন্তু আফসোস! পথনির্দেশনা হিসেবে মানুষ এই গ্রন্থকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। মুসলমানেরা শুধু এটাকে নামাজের মন্ত্র হিসেবে সূরা কেরাত পাঠ করে ঠিকই, কিন্তু এর আদেশ অনুযায়ী কাজ করতে আর নিষেধ অনুযায়ী বর্জন করতে বা বিরত থাকতে, কোনোটাই কেউ মানতে বা পালন করতে রাজি নয়, কিছু লোক ছাড়া। মোট কথা কুরআনকে মুসলমানেরা মসজিদের বাইরে কোনো কাজে ব্যবহার করতে চায় না বা রাজি নয়। কারণ বর্তমানের মুসলমান প্রজন্ম জানেই না কুরআন তাকে সব ক্ষেত্রে পথনির্দেশনা দিতে পারে। সে শুধু এতটুকু জানে, নামাজ পড়তে হলে সূরা কেরাত লাগে, তাই কুরআনের কিছু সূরা মুখস্থ রাখলেই কুরআনের কাজ শেষ, হক আদায় হয়ে গেল। আবার জামাতে নামাজ পড়লে তো সূরা না জানলেও চলে, কোনো অসুবিধা নেই ইত্যাদি। কুরআনের কাছ থেকে দূরে থাকার বা দূরে রাখার জন্য শয়তান শত কৌশল প্রয়োগ করে সে মুসলমানকে কুরআনের জ্ঞানে অজ্ঞ রাখার ব্যাপারে শত ভাগ সফল হয়েছে। ফলে বর্তমানে আমরা বড় বড় বিদ্ব্যান জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের বাক্যালাপ, বিবৃতি শুনছি, যা তাদের যুক্তি ও কৌশল নিজস্ব মস্তিষ্ক প্রসূত বা শয়তানের অপকৌশল দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু তারা সেটা মোটেই বোঝে না বা বুঝতে পারে না। কুরআন নিজেই ঘোষণা করেছে ‘এই কুরআনের নির্দেশনা শুধু মুসলমানের জন্য নয়, সব মানুষের জন্যই কল্যাণকর।’ তাই মানুষের উচিত ছিল এই কল্যাণ পাওয়ার জন্য কুরআনের দ্বারস্থ হওয়া, এ নিয়ে গবেষণা করা, সেই গবেষণালব্ধ ফলাফল মানুষের কল্যাণে লাগানো।
আমরা কয়েকজন নবীর নামসহ সেই নবীর সময়ের শাসকগোষ্ঠীর কার্যকলাপের বিবরণ বা কাহিনী এই মহাগ্রন্থে জানতে পারি। এর মধ্যে হজরত মুসা ও ফিরাউন বাদশাহের কথা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে। কিন্তু কেন? ১৪০০ বছর আগে ফেরাউন ছিল না আর মুসা নবীও ছিলেন না, তবুও তাদের কাহিনী এত বেশিবার, এত বেশি জায়গায় বিভিন্ন ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন, কেয়ামত পর্যন্ত সব মানুষের জন্য, তারও নিশ্চয় একটা কারণ আছে। আল্লাহ কারণ ছাড়া কোনো কিছুই করেন না বা বলেন না। অন্তত এটা আমাদের বুঝতে হবে। কেয়ামতের আগ পর্যন্ত পৃথিবীতে মানুষের শাসনকার্য পরিচালনা, যুগে যুগে ফেরাউনরূপী শাসক দেশের শাসনভার গ্রহণ করার দায়িত্ব পাবে, ফেরাউন যেমন তার স্বজাতি কিবতি আর বনি ইসরাইলের মধ্যে বিভাজন বা দলাদলির মাধ্যমে অশান্তির সৃষ্টি করে রেখেছিল, বর্তমানে বা কেয়ামতের আগ পর্যন্ত কিছু কিছু শাসক দেশের শাসন কর্তৃত্ব পেয়ে দেশের মানুষকে নানা অজুহাতে তেমনি দুই ভাগে বিভক্ত করে নিজ দল কর্তৃক বিপক্ষ দলকে নাস্তানাবুদ করবে, অপমান করবে, হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য যত রকম কৌশল বা বুদ্ধি দরকার তা গ্রহণ করবে। সেই সময় ফেরাউনের পাশে পরামর্শদাতা যেমন হামান নামীয় মন্ত্রিপরিষদ ছিল, বর্তমানে ও ভবিষ্যতেও আধুনিক ফেরাউনের পাশে অত্যন্ত জ্ঞানীগুণী মন্ত্রিপরিষদ আছে ও থাকবে, যারা জাতিকে অত্যন্ত যৌক্তিক কারণের ভিত্তিতে দুই ভাগে ভাগ করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ও যাবে। এটা কোনো মুমিন মুসলমান মেনে নিতে পারে না। কিন্তু ফাসেক আর মুনাফেকদের কাছে মানুষের মাঝের এই বিভাজনটা অত্যন্ত যৌক্তিক। কারণ সে সময় মুহাম্মাদ সা: (কুফফার) অস্বীকারকারীদের কাছে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন, তেমনি বর্তমানে যেহেতু মুহাম্মাদ সা: নেই কিন্তু তার অনুসারীরা ফাসেক আর মুনাফেকদের কাছে সেরকম ভীতিকর আর অসহ্যকর, তাই এখন মুহাম্মাদের সা: অনুসারীদের দুনিয়া থেকে বিদায় করা দরকার। তাই বিচারের কাঠগড়া তাদের জন্য, আর বিচারের নামে ফাঁসির ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি। একটা কথা অন্তত মুসলমানের মনে রাখা উচিত তা হলো মুমিন ব্যক্তিরা অতীতের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে মিলেমিশে এক সাথে দেশের কাজ করতে বা দেশের উন্নতি করতে চায়, কিন্তু ফাসেক বা মুনাফেক ব্যক্তিরা সব সময় চাইবে তার বিপরীত কাজ করতে। তারা তাদের যুক্তিতে অটল। যেমন শয়তান তার যুক্তিতে অটলÑ মাটির মানুষ থেকে সে শ্রেষ্ঠ। আর এটাও মিথ্যা কথা নয়। তাই বলে কি মানুষের চেয়ে শয়তান শ্রেষ্ঠত্ব পেয়েছে? অহঙ্কারীকে আল্লাহ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন না।
আমরা জানি মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ সা: যারা তাঁর জানের শত্রু ছিল, ইসলামের চির দুশমন ছিল সবাইকে ক্ষমা করে দেন। আর পরবর্তীকালে খোলাফায়ে রাশেদীন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। নবী সা: ও ইসলামের ওইসব চিরশত্রুদের কারো বিরুদ্ধে সামান্যতমও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। এটাই ইসলামের শিক্ষা।
আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস, ইকরামা ইবনে আবুল হাকাম এরকম আরো কিছু ব্যক্তি যারা বর্তমানের কলুষিত অন্তরের মানুষের জন্য হেদায়েতের আলো। উমর ইবনে খাত্তাব, খালেদ ইবনে ওয়ালিদ যাঁরা ছিলেন এক সময় মুহাম্মাদের সা: তথা ইসলামের দুশমন, কিন্তু পরে তারা নিজের জীবনের চেয়েও মুহাম্মাদকে সা: বেশি ভালোবেসে দুনিয়াবাসীকে শিখিয়ে গেছেন, সময় ও পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে যদিও মুহাম্মাদের সা: দুশমন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন, কিন্তু পরে বন্ধু হিসেবে মুহাম্মাদের সা: তথা ইসলামের এমন খেদমত করে এমন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন, যে স্তরে সাধারণ মুসলমানের পৌঁছা সম্ভব নয়। তাদের অনুসরণ করা আমাদের জন্য কর্তব্য। কেননা যারা যেকোনো খারাপ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে, তারা অবশ্যই ভালো কাজেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে এটাই স্বাভাবিক বা অবশ্যম্ভাবী। কারণ তারা মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি, তাদের দেশের কাজে লাগাতে হবে। তারা দেশ তথা সমাজসেবার মতো ক্ষমতা রাখে। কিন্তু যদি হিংসার বশবর্তী হয়ে সারা জীবন দুশমন ভেবে তাদের পিছে প্রতিশোধের নেশায় লেগে থাকে তবে, যে লেগে থাকবে তার নিজের ক্ষতি পরজীবনে, আর দেশের ক্ষতি ইহজগতে। অতএব হিংসা-দ্বেষ পরিহার করে নিজের তথা দেশের মঙ্গল করুন, এটাই একান্ত কাম্য।