মানবজাতির মুক্তি ও কল্যাণের জন্য রমজান মাসের শবেকদরের রাতেই বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাজিল হয়। কোরআন নাজিলের কারণেই মাহে রমজানের এত কদর, এত মাহাত্ম্য। পবিত্র কোরআন প্রথমে লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত ছিল। সেখান থেকে রাসুলে পাক (সা.)-এর কাছে কদরের রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে নাজিল শুরু হয়, যা কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য একমাত্র হিদায়াত বা পথনির্দেশক গ্রন্থ। কোরআন তো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ (সূরা কালাম, ৫২)। প্রতিটি মুসলমানের উচিত পবিত্র কোরআন শুদ্ধভাবে, স্পষ্ট ও সুন্দর করে তিলাওয়াত করা, তিলাওয়াত শোনা, গবেষণাপূর্বক এর প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করে নিজের ও অন্যের কল্যাণ সাধন করা।
কোরআন শব্দটি কারউন ধাতু থেকে এসেছে। যার অর্থ জমা করা, একত্রিত করা। আল কোরআনে পূর্ববর্তী সব কিতাবের সারবস্তু ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান একত্রিত করা হয়েছে। কোনো কোনো বৈয়াকরণিকের মতে, কোরআন কারাআ ধাতু থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ তিলাওয়াত করা। দুনিয়ার সব গ্রন্থের মধ্যে এটিই সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ, এজন্য আল কোরআনকে কোরআন বলা হয়। ‘এর সংরক্ষণ ও পাঠ আমারই দায়িত্ব। অতঃপর আমি যখন তা পাঠ করি তখন আপনি সে পাঠের অনুসরণ করুন’ (সূরা আল কিয়ামাহ : ১৭ ও ১৮ আয়াত)।
কোরআনবিহীন অন্তর শূন্য, এর তিলাওয়াত উত্তম ইবাদত, যা দিলের মরিচা দূর করে। হজরত ওসমান এবং হোযায়ফা (রা.) বলেন, অন্তর যদি পাপের ময়লা থেকে পবিত্র না থাকে তবে কালামে পাকের তিলাওয়াতে কখনও তৃপ্তি হয় না। এ পাক কালামের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং আল্লাহপাক এবং তা তাঁরই গুণের আধার। এমন পবিত্র কালামে পাকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে পারলে মানুষের জন্য আর কোনো বুজুর্গি দরকার নেই। হজরত ওকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, হুজুর আকরাম (সা.) বলেন, যে প্রকাশ্যে কোরআন শরীফ পড়ল সে যেন প্রকাশ্যে ছদকা দান করল। (তিরমিযি)। তিনি আরও বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি যে নিজে কোরআন শিখে এবং অপরকে শেখায়।’ (বুখারি শরীফ)এ কোরআন শিখতে হবে, পড়তে হবে শুদ্ধভাবে। ‘তোমরা শুদ্ধ করে ধীরে ধীরে কোরআন তিলাওয়াত করো।’ (সূরা মুজ্জামিল)
কিন্তু দুঃখের বিষয়, অধিকাংশ মসজিদে তারাবির নামাজে হাফেজরা এত তাড়াতাড়ি কোরআন পড়েন যা স্পষ্ট বোঝা যায় না। এর ফলাফল কী হবে, আল্লাহই ভালো জানেন। তাছাড়া আমরা পিতা-মাতারা আমাদের সন্তানদের জন্মের কয়েক বছর পরেই ভর্তি কোচিং, কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু কোরআন শেখানোর কোনো ব্যবস্থা করি না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ইলম-ই-দ্বীন শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ’ (বুখারি)। তিনি অন্যত্র বলেছেন, সাত বছর হলে সন্তানদের নামাজ পড়তে বলা এবং দশ বছর হলে তাকে বাধ্য করতে প্রহার করা। কিন্তু কোরআন সহিহ-শুদ্ধ করে না শিখলে তারা নামাজ পড়বে কীভাবে? অথবা কোরআন পড়ে চর্চার অভাবে তা ভুলে গেলে পরিণতি হবে কত ভয়াবহ তা কি আমরা জানি? ‘আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবনযাপন হবে সঙ্কুচিত এবং কিয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ অবস্থায় উঠাব। সে বলবে, হে আমার প্রভু! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? আমি তো পৃথিবীতে চক্ষুষ্মান ছিলাম। আল্লাহ বলবেন, পৃথিবীতে আমার আয়াতগুলো তোমার কাছে এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। আজ অনুরূপভাবে আমিও তোমাদের ভুলে যাব।’ (সূরা ত্বহা, আয়াত ১২৪-১২৬)। কোরআন শেখা, পড়া, বোঝা এবং সে অনুযায়ী চলা সবার জন্য ফরজ দায়িত্ব। কোরআন তিলাওয়াত যথাযথ ও সহিহ-শুদ্ধ না হলে নামাজও হবে না। কোরআন শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষের জীবন সুন্দর ও আদর্শবান হয়। এ কোরআনের সংস্পর্শে আসার কারণেই জাহিলিয়াতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষগুলো ইসলামের শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হয়েছিল। আজও আমরা যদি কোরআন শিখে এর পথে ফিরে আসি, তাহলে সমাজের শ্রেষ্ঠ ও আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে পারব। কোরআন শিক্ষা কঠিন নয়। আল্লাহ বলেন, ‘আমি কোরআনকে বোঝার জন্য সহজ করে দিয়েছি।’ (সূরা কামার-১৭)। কোরআন যদি কঠিন হতো তাহলে সাত-আট বছরের ছোট ছেলেমেয়েরা তা মুখস্থ করতে পারত না!
রাসুল (সা.) স্বয়ং খুবই সুন্দর ও সুমিষ্ট সুরে কোরআন তিলাওয়াত করতেন এবং সাহারিদেরও সুমিষ্ট সুরে কোরআন তিলাওয়াত করতে উপদেশ দিতেন। যাতে কোরআন তিলাওয়াত শুনে হৃদযন্ত্র বিদীর্ণ হয়ে যায়। সুর আল্লাহর সৃষ্টির বিভিন্ন ডায়মেনশনে বিশেষভাবে ক্রিয়াশীল। ইমাম আবু উবায়দ বর্ণনা করেছেন, একদা নবী করিম (সা.) বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে সর্বাপেক্ষা ভয় করে, তার তিলাওয়াতের সুর সর্বাপেক্ষা উত্তম। সর্বাপেক্ষা উত্তম সুর কোরআন সম্পর্কে শ্রোতাকে চিন্তা-ভাবনা করতে, এর অর্থ ও মর্ম উপলব্ধি ও হৃদয়ঙ্গম করতে এবং এর প্রতি বিনয়াবনত হতে অনুপ্রাণিত করে। শরিয়তের দৃষ্টিতে এমন সুরই উত্তম ও মধুরতম। হজরত বারা ইবনে আমির (রা.) থেকে ইমাম আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন—নবী করিম (সা.) বলেছেন, স্বীয় কণ্ঠস্বর দ্বারা তোমরা কোরআনে মজিদ সৌন্দর্যমণ্ডিত করো। মূলত কোরআন তিলাওয়াতে বিনয়, নম্রতা, আদব, ভক্তি এবং অন্তরের গভীরতম প্রদেশ থেকে উত্সারিত ভালোবাসা, আন্তরিকতাপূর্ণ ও মর্মস্পর্শী সুরের মূর্ছনা থাকা চাই। যাতে তিলাওয়াতকারীর চোখে পানি আসে, শ্রবণকারীর হৃদয় কাঁদে, পশু, পাখি, বৃক্ষলতা, আকাশ-বাতাস সুরের মোহে ধ্যানমগ্ন হয়। এমন সুর স্বয়ং আল্লাহর পছন্দ।
কোরআনের ভাব, ভাষা, অর্থ, ধ্বনি গাম্ভীর্য ও ব্যঞ্জনায়, প্রকাশ ভঙ্গিতে অপূর্ব কলা-কৌশল বিদ্যমান রয়েছে; যা চক্ষুষ্মান পাঠকের ও শ্রোতার অন্তর ঈমানের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাই আল কোরআনের প্রেমে যারা মজেছে, কোরআনের হক আদায়ে তারা সদা তত্পর। আল্লাহপাক বলেন, আমি যাদের কিতাব দিয়েছি (তাদের মধ্য থেকে) যারা তার হক আদায় করে তিলাওয়াত করে, তারাই ওই কিতাবকে (প্রকৃত অর্থে) বিশ্বাস করে। (সূরা বাকারা, আয়াত ১২১)। সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য মহাগ্রন্থ আল কোরআন আল্লাহ্র পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ সর্বশেষ হেদায়ত গ্রন্থ। শুধু তিলাওয়াত ও সওয়াবের উদ্দেশ্যে এমন অমূল্য গ্রন্থ নাজিল হয়নি। মানব জীবনের এমন কোনো বিভাগ বা দিক নেই, যার মূলনীতি কোরআনে আলোচনা করা হয়নি। সত্য, ন্যায় ও সুন্দরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যই কোরআন নাজিল হয়েছে। কোরআনের হক আদায় করা মানেই এক আল্লাহর কাছে মাথা নত করে তাঁর দাসত্বকে মনেপ্রাণে স্বীকার করে নেয়া, ঈমানকে দৃঢ় করা, নামাজ কায়েম করা, রোজা রাখা, জাকাত দেয়া, হজ করা এবং মানবসেবায় নিজের জ্ঞান-বুদ্ধিকে কাজে লাগানো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম জন্তু হচ্ছে সেসব বধির-বোবা লোক, যারা জ্ঞান-বুদ্ধিকে কাজে লাগায় না।’ (সূরা আনফাল, আয়াত ২২)। আর যারা বিবেক-বুদ্ধিকে প্রয়োগ করে কাজ করে না, তিনি তাদের ওপর অপবিত্রতা বা অকল্যাণ চাপিয়ে দেন।’ (সূরা ইউনুস-১০০)। ‘তারা কি কোরআন নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে না? না তাদের অন্তরে তালা পড়ে গেছে।’ (সূরা মুহাম্মদ-২৪)।
আধুনিক বিশ্বের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে মানুষ আজ বিপন্ন, বিভ্রান্ত এবং আতঙ্কিত। মানুষের ঘরে-বাইরে জ্বালা, অশান্তির কালো থাবা মানুষকে গ্রাস করতে চলেছে। তাই মানুষ পূর্ণ শান্তি কামনা করে। আর সেই পূর্ণ শান্তি একমাত্র কোরআনের দিকনির্দেশনায় নিহিত রয়েছে। বিভিন্ন গবেষকের মতে, হক আদায় করে কোরআন তিলাওয়াতের অর্থ হচ্ছে—
এক. কোরআনকে আদবের সঙ্গে ধরা, যত্ন সহকারে রাখা এবং কোরআনের শিক্ষায় সুশিক্ষিত হওয়া। দুই. স্পষ্ট করে বিশুদ্ধভাবে সুন্দর সুরে তিলাওয়াত করা। তিন. অর্থ জেনে ও বুঝে দরদ দিয়ে তিলাওয়াত করা। চার. তিলাওয়াতের মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জিত হলো সে অনুযায়ী কাজ করা অর্থাত্ আল কোরআনের দিকনির্দেশনা অনুসারে জীবন গঠন করা এবং নবীর আদর্শের সৈনিক হওয়া। পাঁচ. অর্জিত জ্ঞানের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। ছয়. অর্জিত ওই জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য চিন্তা ও গবেষণা করা। ‘আল কোরআন এক বিজ্ঞানময় কিতাব’ (সূরা ইয়াসিন)। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখার মূলনীতিগুলো (সূত্র) পবিত্র কোরআনে বিদ্যমান রয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা কোরআন তিলাওয়াত করতে এবং কোরআন নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করতে বলেছেন। ‘(হে মুহাম্মদ) এই যে কিতাব আমি আপনার ওপর নাজিল করেছি, এটি একটি বরকতময় কিতাব। মানুষেরা যেন এর আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে।’ (সূরা সাদ : আয়াত ২৯)। জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উত্স আল কোরআন। চিরসত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আল কোরআনের অফুরন্ত জ্ঞানের আলো বিশ্বের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেয়া প্রতিটি মুসলমানের পবিত্র দায়িত্ব। সত্য ও সুন্দরের জয় হোক। আল কোরআন ও সুন্নাহর জ্যোতির্ময় আলো জ্বলে ওঠুক পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের অন্তরে—এটাই আল কোরআনের দাবি বা হক।