কর্জ বা ঋণগ্রহণ সমাজে একটি রিতিতে পরিণত হয়েছে। ঋণ করেননি বা ঋণী নন এমন মানুষ সমাজে খুঁজে পাওয়া কঠিন। পার্থিব প্রয়োজনে কখনো কখনো ঋণ করতে হয়। ইসলামে ঋণ দেয়া-নেয়া অবৈধ নয়। তবে তা হতে হবে সুদমুক্ত। পবিত্র কুরআনের ভাষায় এ ঋণকে বলা হয়েছে করজায়ে হাসানা’। ক্ষেত্রবিশেষে করজায়ে হাসানাকে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং ঋণ গ্রহণে সঠিক পদ্ধতিও অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণের আদান-প্রদান করো, তখন লিপিবদ্ধ করে নাও এবং তোমাদের মধ্যে কোনো লেখক ন্যায় সঙ্গতভাবে তা লিখে দেবে, লেখক লিখতে অস্বীকার করবে না। আল্লাহ তাকে যেমন শিক্ষা দিয়েছেন, তার উচিত তা লিখে দেয়া। ঋণগ্রহীতা লেখার বিষয় বলে দেবে। সে যেন স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করে এবং লেখার মধ্যে বিন্দুমাত্রও বেশ কম না করে।’(সূরা বাকারা : ২৮২)
এ আয়াতে ঋণসংক্রান্ত বিশদ আলোচনা এসেছে। এর দ্বারা বোঝা যায় , ইসলামি শরিয়তে ঋণ আদান-প্রদান বৈধ আছে। একান্ত প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণে দোষ নেই। তবে ভবিষ্যতে কোনোরূপ দ্বন্দ -ফ্যাসাদ না হওয়ার আশঙ্কায় কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী দিন, তারিখ ও ঋণের পরিমাণ লিখে রাখাই ভালো। যেদিন বা যে সময় ঋণ আদায় করতে পারবে, তার চেয়ে দু-চার দিন বেশি সময় হাতে রেখে ঋণ পরিশোধের ওয়াদা করবে। আর টাকা হাতে আসামাত্র তা বা নির্ধারিত সময়ের ভেতরে পরিশোধ করে দেবে। তাহলে পরে কোনো প্রয়োজনে ওই ব্যক্তির কাছ থেকে আবার ঋণ নেয়া সহজ হবে। অনিবার্য কারণবশত ঋণ আদায়ে অপারগতা দেখা দিলে জেনেশুনে মিথ্যা আশ্বাস দেয়া উচিত নয় এতে বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় । কখনো এমনটি হলে মেয়াদ শেষের আগেই দাতার কাছে অপারগতার কথা জানাতে হবে। সময় মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে লজ্জায় ওই ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ না করার ফন্দি আঁটা উচিত নয় । এটা মারাত্মক ভুল। এতে ঋণগ্রহীতার প্রতি বদ ধারণার সৃষ্টি হয় । এমনকি একপর্যায়ে ঋণগ্রহীতাকে ঠক, ধোঁকাবাজ, ওয়াদা খেলাপি, ঋণখেলাপি ইত্যাদি মনে করে বসে। এতে সম্পর্কচ্ছেদও হয় । এ জন্য আরবিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘আল-কারজু মিকরাজুল মাহাব্বাহ’ অর্থ ঋণ ভালোবাসার কাঁচিস্বরূপ।
অপ্রয়োজনে ঋণ করা ঠিক নয়। কেউ কেউ বিলাসিতা বা অপরিণামদর্শিতার দরুণ ঋণ করে। অনেকে লোক দেখানো বা যশ-খ্যাতি অর্জনে কোনো বিষযয়ে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে। যেখানে একটি জিনিস হলেই চলে সেখানে অযথা একাধিক পণ্য ক্রয় করে। আবার কেউ কেউ কোনো সুন্দর পণ্য বা জিনিস দেখলে লোভ সামলাতে পারেন না ঋণ করে হলেও ক্রয় করা চাই। অথচ প্রয়োজন ছাড়া ঋণগ্রহণ একেবারে অনুচিত। হুজুর সা: ঋণ গ্রহণ থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চেয়েছেন। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: বলেন, আমি হুজুর সা:-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘আমি কুফর ও কর্জ থেকে আল্লাহর পানাহ চাচ্ছি। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কর্জকে কুফরের সমক মনে করছেন? হুজুর সা: বললেন, হ্যাঁ (নাসায়ি)। বুখারি শরিফে একটু বাড়িয়ে এভাবে বলা হয়েছে, মানুষ যখন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন কথা বললে মিথ্যা বলে, আর ওয়াদা করলে তার খেলাপ করে।
ঋণ স্থান-কাল-পাত্রভেদে মানুষকে অপমানিত করে। বায়হাকি শরিফের একটি হাদিসে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: বলেন, আমি নবীজী সা:-কে জনৈক ব্যক্তিকে এভাবে উপদেশ দিতে দেখেছি, ‘গুনাহ কম করো, মৃত্যু সহজ হয়ে যাবে। কর্জ কম করো, তাহলে পৃথিবীতে বাঁচতে পারবে।’ কেননা ঋণ আজাবস্বরূপ। ভুক্তভোগীই এ ব্যাপারে ভালো বোঝেন। তবে যে ঋণ আদায়ের চেষ্টা করবে, আল্লাহ তায়ালা তার ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করে দেবেন। হুজুর সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের মাল আদায় করার নিয়ত করে আল্লাহতায়ালা তার হক আদায় করে দেন। আর যে ব্যক্তি মানুষের সম্পদ নষ্ট করা ও আত্মসাৎ করার নিয়ত করে, আল্লাহ তায়ালা তাকে ধ্বংস করে দেন।’ (বুখারি)
ঋণগ্রহীতাকে হঠাৎ চাপ প্রয়োগ বা ত্বরিত আদায়ে বাধ্য না করা। কেননা সঙ্কটের কারণেই মানুষ ঋণ করে। এ ঋণের চাপে তাকে দিশেহারা বা অন্যত্র হাত বাড়াতে বাধ্য করা অমানবিক। এক্ষেত্রে তাকে অবকাশ দিতে হবে। কিংবা একটা সময় বেঁধে দিয়ে সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা। ঋণগ্রহীতার প্রতি করুণাও করা যেতে পারে। ইসলামি শরিয়তে তা জায়েজ আছে। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘যদি ঋণগ্রহীতা অভাবগ্রস্ত হয় , তবে তাকে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেয়া উচিত। আর যদি মাফ করে দাও, তবে তা খুবই উত্তম, যদি তোমরা উপলব্ধি করো।’ (সূরা বাকারা : ২৮০)।
বিশেষ প্রয়োজনে ধার-করজ করা যেতে পারে। খোদ নবী করিম সা:-এর কাছ থেকেও বিশেষ প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণের দৃষ্টান্ত আছে। তবে তিনি ব্যক্তিগত কারণে বা অভাব-সঙ্কটে কখনো ঋণ করেননি। যদিও অনেক সময় তাঁকে উপস থাকতে হয়েছে। তিনি ঋণ করেছিলেন ইসলামি জিহাদের প্রয়োজনে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবি রবিআ রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী করিম সা: একবার আমার কাছ থেকে ৪০ হাজার দিরহাম করজ নিলেন। পরে তার হাতে সম্পদ এলে পরিশোধ করে দিলেন এবং দোয় া করে বললেন, আল্লাহ তায়ালা তোমার পরিবার পরিজন ও ধন-সম্পদে বরকত দান করুন। বস্তুত, ঋণের বদলা হচ্ছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ও তা পরিশোধ করে দেয়া।’ (নাসায়ী)।
সূরা নিসার ১১ থেকে ১৪ নম্বর আয়াতে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে ব্যাপক তাকিদ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যদি কেউ আল্লাহর আদেশমতো সহজেই এ ঋণ পরিশোধ করে তবে তার জন্য জান্নাতের সুসংবাদ রয়েছে যেখানে সে অনন্ত কাল থাকবে। কিন্তু অস্বীকার করলে বা অবাধ্য হলে তার জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি ও আজাব যে আজাবও চিরকালের জন্য অবধারিত। ইবনে মাজাহ ও বায়হাকির একটি হাদিসে ঋণ গ্রহণের পর যে বা যারা ওই ঋণ পরিশোধ না করার সংকল্প করে তাকে কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে চোর হিসেবে সাক্ষাৎ করতে হবে বলে মহানবী সা: বলেছেন। এ ছাড়া ঋণ অনাদায়ের বিষযয়েও কঠোর ধমকি রয়েছে। এমনকি সে যদি ধর্মযুদ্ধে শহীদও হয়, তবুও রেহাই পাবে না। মহানবী সা: বলেছেন, ‘শহীদের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়, কিন্তু ঋণ এর ব্যতিক্রম’ (মুসলিম)।
এ জন্য ঋণ আদায়ের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে। একটি হাদিসে মহানবী সা: সে দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন। হজরত আলী রা:-এর কাছে একজন কৃতদাস এসে বলল, আমি চুক্তির টাকা আদায় করতে পারছি না। আমাকে সাহায্য করুন। তখন হজরত আলী রা: তাকে বললেন, আমি কি তোমাকে এমন কয়েকটি শব্দ শিখিয়ে দেব না, যা আমাকে রাসূলুল্লাহ সা: শিখিয়েছেন? যদি তোমার ওপর সাবির পর্বত সমতুল্যও ঋণ থাকে, তবু আল্লাহ তায়ালা তা আদায় করে দেবেন। এটি পড়তে থাকো ‘আল্লাহুম্মাকফিনি বিহালালিকা আন্ হারামিকা ওয়াগনিনি বিফাজলিকা আম্মান সিওয়াক।’সন্মানিত পাঠক পাঠীকা ভাই ও বোনেরা আমাদেও সকলের খেয়াল রাখা উচিৎ যেন আমরা ঋণ গ্রহনে শরয়ী বিধান মেনে চলতে পারি সে চেষ্টায় আমাদের তৎপর থাকতে হবে ।আল্লাহ আমাদের কে ইসলামী বিধান মেনে চলার তৌফিক দান করুক । আমিন