কুরআনুল কারিম ও প্রথম ওহি

 252[1]

  আরব দেশ ঘোর তমসাচ্ছন্ন। তারা অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। ইহুদিরা ওজাইর (আ.) কে আল্লাহর ছেলে বলে ঘোষণা করে। ঠিক সেই সময়ে মানবতার মুক্তির দূত সর্বকালের সর্বশেষ মহামানব ও নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এ পৃথিবীর বুকে আগমন করেন। শুধু তাই নয়, তাঁর আগমনের প্রাক্কালে সারা দুনিয়াতে ঘৃণ্য-প্রেম, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, অন্যায়, অপরাধ, জুলুম, যুদ্ধ, হত্যা, লুণ্ঠন ইত্যাদি ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়। মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব, সার্বভৌমত্ব ও বড়ত্বই ছিল এ জাহেলিয়াত ও বিভ্রান্তির মূল কারণ। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে রাসুলুল্লাহ (সা.) এ সমস্যার সমাধানের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন। এমনি পরিস্থিতিতে একদিন হেরা গুহায় ধ্যানে মগ্ন অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা জিবরাইল ফেরেশতার মাধ্যমে তাঁর কাছে প্রথম ওহি (সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত) নাজিল করেন।
ওহির প্রথম সেই পাঁচ আয়াতের অর্থ—‘পড় তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আলাক (জমাট রক্তের মতো বস্তু যা মায়ের রেহেমের সঙ্গে আটকানো থাকে) থেকে। পড়, আর তোমার রব বড়ই সম্মানিত ও দানশীল। যিনি মানুষকে কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে এমন সব বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।’
শুধু এ পাঁচ আয়াত নয়, সমগ্র কোরআনই ওহি। সেই ওহির সারনির্যাস মানুষ। মানুষের জন্য পরিপূর্ণ হেদায়াত বা উপদেশাবলিই এ কোরআন। পুরো কোরআন বটেই, প্রথম ওহির দাবি ও গুরুত্বও সীমাহীন। বলতে গেলে মানব জীবনের তাবত্ দিকনির্দেশনা রয়েছে এতে। এ আয়াতগুলোতে রয়েছে মানবজাতির জন্য অত্যাবশ্যকীয় শিক্ষা। নিম্নে প্রথম ওহি সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াতের শিক্ষা ও দাবি বৃত্তান্ত প্রদত্ত হলো :
ইকরা বা পড়। এ আদেশের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ, বায়হাকি) অতএব কোনো মুসলমানেরই অশিক্ষিত থাকার সুযোগ নেই। প্রতিটি মানুষকেই এমনভাবে শিক্ষিত হতে হবে, যাতে সে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, কল্যাণ-অকল্যাণের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে।
এ জ্ঞান অর্জনের প্রাথমিক ও মৌলিক উদ্দেশ্য হবে রবকে জানা। রব শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। এটি আল্লাহ তায়ালার কার্য সংক্রান্ত একটি গুণবাচক নাম। এর অর্থ হলো সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, মালিক, বিধানদাতা, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী সত্তা, মাবুদ—দাসত্ব, আনুগত্য ও উপাসনার যোগ্য সত্তা। অতএব আল্লাহকেই একমাত্র মালিক ও বিধানদাতা মেনে তাঁরই দাসত্ব ও আনুগত্য করতে হবে। বিভিন্ন মতবাদের নামে মানুষকে সার্বভৌমত্ব তথা বৈধ-অবৈধ নির্ধারণ এবং আইন রচনার নিরঙ্কুশ অধিকার প্রদান করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে কারও দাসত্ব ও আনুগত্য করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
ইকরা বা পড়, এ আদেশের প্রাথমিক পঠিতব্য বিষয় হলো আল কোরআন। অতএব কোরআনই হতে হবে আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ও কেন্দ্রীয় পাঠ্যসূচি। ব্যক্তিগতভাবে কোরআনের একেকটি সূরা তেলাওয়াত, অধ্যয়ন, অনুধাবন ও বাস্তবায়ন অবশ্যকর্তব্য এবং সমষ্টিগতভাবে সুনাগরিক গড়ে তোলার জন্য রবের প্রতি ঈমান ভিত্তিক কোরআন কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা অপরিহার্য। কোরআনবিমুখ ধর্মনিরপেক্ষ তথা ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা গোটা জাতিকে ধ্বংস করারই হাতিয়ার। তাই ধর্মনিরপেক্ষতা তথা কোরআন ও সুন্নাহকে শিক্ষা, নৈতিকতা, রাজনীতি ও অর্থনীতি থেকে আলাদা করার পথ আমাদের বাদ দিতে হবে।
‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আলাক থেকে’—এ আয়াত থেকে আমাদের তথা মানবজাতির অবস্থানও সুস্পষ্ট হয়েছে। আমরা আল্লাহর সৃষ্টি ও দাস। আমাদের সৃষ্টির উপাদান খুবই নগণ্য; এ নিয়ে গর্ব অহঙ্কার করার কিছুই নেই। তাই আমরা নিজেরা প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্বের দাবিদার হতে পারি না। আবার আমরা এত বেশি হীন ও নগণ্য নই যে, আমাদেরই মতো অন্য মানুষকে প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্বের অধিকার প্রদান করে তাদের নিঃশর্ত আনুগত্য করতে থাকব। বরং মহান রব আমাদের জ্ঞান দান করে সম্মানিত করেছেন। আর কোরআনই হলো সঠিক জ্ঞানের মূল উত্স। অতএব আমাদের কোরআন তেলাওয়াত, অধ্যয়ন, অনুধাবন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে রবের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে হবে।
কলম অথবা অনুরূপ উপায় উপকরণের ব্যবহার করার কৌশল শিক্ষাদান আল্লাহ প্রদত্ত এক বিশেষ নিয়ামত। জ্ঞান সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য এসব উপকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতএব এসব উপকরণের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞান, বিশেষভাবে কোরআন প্রদত্ত জ্ঞান অর্জন, সংরক্ষণ ও প্রসারের জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কোরআন অনুধাবন ও বাস্তবায়নের জন্য কতিপয় মৌলিক গুণাবলি অর্জন অপরিহার্য যা রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর মধ্যে আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল।

প্রথম ওহি নাজিলের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.)-এর কথোপকথন থেকে তা জানা যায়। এগুলো হলো আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, সত্য কথা বলা, মেহমানদের সেবা-যত্ন করা, অসহায় ও অক্ষমদের বোঝা বহন করা ও তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য সচেষ্ট হওয়া এবং প্রত্যেক সত্য-সঠিক বিষয়কে সাহায্য ও সমর্থন করা। এসব গুণাবলি অর্জনের জন্য চেষ্টা করা আমাদের জন্য অবশ্যকর্তব্য।
কিছুদিন আগেই আমাদের সামনে হাজির হয়েছিল সেই পবিত্র কোরআন নাজিলের মাস রমজান। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রমজান সেই মাস যে মাসে নাজিল হয়েছে কোরআন।’ কোরআনের ফজিলতের শেষ নেই। রমজানে এক খতম কোরআন অন্য যে কোনো মাসের তুলনায় ৭০ গুণ বেশি সওয়াব। যারা জীবনে কোনোদিন কোরআন নামক গ্রন্থটিকে ছুঁয়ে ধরার সুযোগ পাননি, কিংবা সুযোগ পেয়েছেন কিন্তু তেলাওয়াত করার সুযোগ হয়নি কিংবা নিয়মিত তেলাওয়াতও হয় বটে অর্থ ও মর্ম বুঝতে চান কিংবা যারা তেলাওয়াতে নিয়মিত না বা ব্যস্ততায় কোরআন খতম দেয়া সম্ভব নয়, তাদের জন্য প্রতিদিন কিঞ্চিত পরিমাণ হলেও তেলাওয়াত করা এবং কোরআনের রঙে নিজেদের রাঙিয়ে তুলতে পরামর্শ জানাচ্ছি।

Related Post