“ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে”
আজকের শিশু আগামী দিনের স্বপ্নিল সম্ভাবনা। শিশুর সুস্থ বিকাশের উপর নির্ভর করে একটি সুস্থ’ জাতির গঠন। তাই শিশু জীবনের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও তার সুস্থ বিকাশ অপরিহার্য। তৎকালীন আরবে যত অপরাধ সংগঠিত হত তার মধ্যে অন্যতম ছিলো,কন্যা-সন্তানকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে হত্যা করা এবং পুত্র-সন্তানরা লালিত-পালিত হত অনাদরে, অবহেলায়,অশিক্ষায় কুশিক্ষায়,অবাঞ্ছিত মানবরূপে। বিবাহ প্রথার যেহেতু কোন বালাই ছিল না, তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশু তার বাবা-মায়ের সোহাগ থেকে বঞ্চিত হত। শিশুদের নিয়ে আরব সমাজের এ বিভৎস,ধ্বংসকারী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মানবতার দরদী নবী (সঃ) সর্বপ্রথম পৃথিবীতে শিশুদের জীবনের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং তাদের পরিপূর্ণ বিকাশের গ্যারান্টি প্রদান করলেন।
শিশু হত্যা রোধ ও শিশু জীবনের নিরাপত্তাদান
জাহেলিয়াতের যুগে আরবের চরম বর্বর লোকেরা তিনটি কারণে সন্তান হত্যা করতো। (১) কন্যা সন্তান হলে পিতা-মাতাকে লজ্জার সম্মুখীন হতে হয় এ চিন্তায়। (২) সন্তানদের লালন-পালনে অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ার ভয়ে। (৩) নিজেদের উপাস্যদের সন্তুষ্টির জন্য সন্তানদের বলি দেয়া হতো। যা, সূরা আন’আমের ১৩৭, ১৪০ ও ১৫১ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। অসভ্য ও বর্বর আরব জাতির এ জঘন্য কাজের বিরুদ্ধে আল্লাহ পাক কঠোর হুঁশিয়ারী বাণী নাযিল করলেন, “তোমাদের সন্তানদেরকে তোমরা দারিদ্র-ভয়ে হত্যা করো না, তাদেরকে ও তোমাদেরকে আমিই রিযিক দিয়ে থাকি; তাদেরকে হত্যা করা মহাপাপ।” (বাণী ইসরাইল-৩১)। রাসূল (সঃ) আল্লাহর এবাণী প্রচার করে শিশু জীবনের অস্তিত্ব রক্ষায় আরব সমাজ থেকে শিশু হত্যা সম্পূর্ণ বন্ধ করেন । আরব সমাজ থেকে শিশু হত্যার মত জঘন্য অপরাধের মূলোৎপাটন করে শিশুদের সুস্থ ও সুন্দর জীবনের বিকাশ তথা একটি আদর্শ জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের ভিত তৈরী করেন। এক্ষেত্রে তাঁর অবদানসমূহ সংক্ষেপে নিম্মে উল্লেখ করা হলো ঃ
শিশুরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ
রাসূল (সঃ) শিশুদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কুরআনেও শিশুদেরকে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য, সৌভাগ্য, সর্বশ্রেষ্ঠ সুসংবাদ ও চোখের প্রশান্তিরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে; “ধনৈশ্বর্য এবং সন্তান সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য।” (কাহ্ফ-৪৬)। “হে যাকারিয়া! আমি তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছি এক পুত্র সন্তানের যার নাম হবে ইয়াহইয়া। ইতোপূর্বে আমি আর কাউকে এই নামধারী করিনি।”(মারইয়াম-৭)। “হে আমাদের রব! আমাদের স্ত্রী এবং সন্তানদের আমাদের জন্য নয়ন জুড়ানো করে দিন।” (ফুরকান-৭৪)। শিশুরা শুধু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদই নয়, শিশুর মৃত্যুতে ধৈর্য ধারণ করতে পারলে তাদের মা-বাবাকে বেহেশতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। রাসূল (সঃ) এরশাদ করেন-“যখন কারো সন্তান মৃত্যুবরণ করে তখন আল্লাহ পাক ফেরেশতাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি আমার বান্দার সন্তানের প্রাণ কবজ করে নিলে? উত্তরে তারা বলে জ্বি, হ্যাঁ। আল্লাহ পাক আবার জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি তার কলিজার টুকরা কবজ করে নিলে? ফেরেশতারা বলে জ্বি, হ্যাঁ। আল্লাহ পাক পুনরায় জিজ্ঞেস করেন, আমার বান্দা কি বলেছে? ফেরেশতারা বলে, সে ধৈর্য ধারন করে আপনার প্রশংসা করেছে। এবার আল্লাহ বলেন, আমার বান্দার জন্য জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ কর যার নাম হবে বায়তুল হামদ। (তিরমিযী)
সকল শিশুর মর্যাদা সমান
রাসূল (সঃ) এরশাদ করেনঃ প্রত্যেক শিশু ফেতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতামাতা তাকে হয়ত ইহুদী বানায়, নয়তো নাসারা কিংবা মাজুসী বানায়।” (বুখারী ও মুসলিম)। ফেতরাত অর্থ, সত্য গ্রহণের যোগ্যতা। প্রত্যেকটি শিশুকে এহেন গুণের অধিকারী হিসাবে ঘোষণা করে রাসূল (সঃ) দুনিয়ার সকল শিশুর মর্যাদা সমুন্নত, সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং তাদের পরিপূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে যাবতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা কল্পে শিশুদের মধ্যে সমতা বিধান, মানসিক বিকাশ, আনন্দ ফূর্তি, খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন। রাসূল (সঃ) নিজেই শিশুদের সাথে সালাম বিনিময়, খেলাধুলা ও কৌতুক করতেন।
শিশু জন্মকালীন পিতা-মাতার দায়িত্বসমূহ
(১) কানে আযান দেয়া (২) আকীকা করা (৩) উত্তম নাম রাখা (৪) তাহনীক ও খাৎনা করা (৫) হে মমতা ও ভালবাসা প্রদান (৬) দুধ পান করানো (৭) লালন পালন ও ভরণপোষণ (৮) পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জীবন গঠন (৯) নৈতিক চরিত্র গঠন (১০) সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। সন্তানের উত্তম ও নৈতিকতা পূর্ণ শিক্ষা না দেয়া সন্তান হত্যার শামিল। যা সূরা আন’আমের ১২২ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে মৃত্যু বলা হয়েছে অজ্ঞতা, মূর্খতা ও চেতনাহীন অবস্থাকে। আর জীবন বলতে জ্ঞান,উপলব্ধি ও প্রকৃত সত্যকে চিনতে পারার অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে। সন্তানদেরকে উত্তম ও নৈতিকতা পূর্ণ শিক্ষা না দেয়া,তার নৈতিক চরিত্র গঠন না করা, যার কারণে সে আল্লাহ-রাসূল (সঃ) ও পরকালের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে এবং চরিত্রহীন ও নির্লজ্জ কাজে জড়িত হয়ে পড়ে,এটাও সন্তান হত্যার চাইতে কম নয়! যারা সন্তানদের কাজ-কর্ম ও চরিত্র সংশোধনের প্রতি মনোযোগ দেয় না, তাদেরকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়,যার ফলে ইসলামী চরিত্র ধ্বংস হয়ে যায়, তারাও এক দিক দিয়ে সন্তান হত্যার অপরাধে অপরাধী। বাহ্যিক হত্যার প্রভাবে তো শুধু ক্ষণস্থায়ী জাগতিক জীবন বিপর্যস্ত হয়। কিন্তু এ হত্যা মানুষের পারলৌকিক ও চিরস্থায়ী জীবন বরবাদ হয়ে যাবে এবং পিতামাতাকে এজন্য আল্লাহর সমীপে জবাবদিহি করতে হবে।
রাসূল (সঃ)-এর শিক্ষা এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদঃ
জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত শিশু অধিকার সনদ পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় যে, শিশুদের বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর এবং কল্যাণধর্মী অধিকার প্রদান করলেও শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তা পূর্ণাঙ্গ নয়। তদুপরী ঘোষিত এ সকল নীতিমালার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতিসংঘ আজ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী শিশুদের নিরাপত্তা ও সুস্থ বিকাশ সাধন করতে পারেনি। জাতিসংঘ একদিকে শিশুদের জন্য একখানি অধিকার সনদ প্রদান করেছে, অপর দিকে জাতিসংঘেরই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদদে বিশ্বব্যাপী বিশেষতঃ ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান,সোমালিয়া প্রভৃতি দেশের লক্ষ লক্ষ শিশুর জীবন বিপন্ন করা হচ্ছে। জাতিসংঘের এই স্ববিরোধী ভূমিকার প্রেক্ষাপটে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী (সঃ)ই সর্বপ্রথম শিশুর কল্যাণে এগিয়ে এসেছেন-জাতিসংঘ নয়। একমাত্র তাঁরই প্রদর্শিত এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থায় একজন শিশুর সুস্থ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সম্ভব।
আজ আমাদের বুঝতে হবে যে, (৫৭০-৬৩২) সালের পৃথিবী আর বর্তমান পৃথিবী এক নয়। আজ আমরা সভ্যতার দাবী করতে শিখেছি। নিজেদেরকে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করতে শিখেছি। বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি আজ আমাদেরকে দিশেহারা করে দিয়েছে। বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হয়েছে, কিন্তু নৈতিকতার চরম ধস নেমেছে। শিশুরা আজ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, অবৈধ যৌন সংসর্গজাত শিশুরা তাদের অনিশ্চিত জীবন নিয়ে বেড়ে উঠছে,অর্থলিপ্সুরা শিশু পাচার করছে, ভ্রুণ হত্যা, বৈধ-অবৈধ গর্ভপাত হচ্ছে অহরহ, জীবিকার ভয়ে আঁতুরঘরেই শিশুহত্যা কিংবা শিশু বিক্রি ঘটনা আজ বিচিত্র নয়। তথাকথিত শান্তিসংঘ, জাতিসংঘের দোহাই দিয়ে হুমকি ধমকি এবং অপারেশনে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শিশুদের জীবন আজ বিপন্ন। পৃথিবীর সৌন্দর্য এবং শ্রেষ্ঠ সম্পদ শিশুদের প্রতি এহেন অনাচার অবিচার যেন তৎকালীন আরবের বর্বরতাকেও হার মানায়। শিশুদের প্রতি এহেন বর্বরতা রোধকল্পে জাতিসংঘ সনদের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে বিশ্ববাসীর উচিত রাসূল (সঃ) -এর প্রদর্শিত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা। তাহলেই কেবল শিশু জীবনের নিরাপত্তা, অধিকার, মর্যাদা এবং তার পূর্ণ বিকাশ নিশ্চিত হবে। আসুন! আমরা সবাই রাসূল (সঃ)-এর প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে শিশু অধিকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুন্দর একটি পৃথিবী গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করি। আল্লাহ আমাদের সে তাওফীক দান করূন। আমীন ॥