হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে আমাদের শিশুদের প্রতি দয়া-স্নেহ করে না সে আমাদের মধ্যে গণ্য নয়।’ (বুখারি)।বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই শিশু। শিশুরাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার, তাদের হাতেই আগামী পৃথিবীর ভার। অথচ শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত কয়েক বছরের যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ক্ষতিগ্রস্ত সৈনিকদের চেয়েও বেশি। কেবল যুদ্ধই যে শিশুদের ভালোভাবে বেড়ে ওঠার পথে বাধার সৃষ্টি করছে তা নয়; ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা ও প্রাণঘাতী রোগ শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করছে।
এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে শিশুদের কাজ করতে দেখা যাবে না। চরম দারিদ্র্যই এর মুখ্য কারণ। দরিদ্র বাবা-মা সংসারের ব্যয় নির্বাহে অসমর্থ হয়ে বা তাদের কর্মহীনতার কারণে মা-বাবার স্থলে শিশুরা অর্থ উপার্জনে অগ্রসর হয়। ইসলামের বিধান অনুযায়ী প্রতিটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য শিশুশ্রম নিন্দিত। শিশুদের সংরক্ষণ, কল্যাণ ও শিক্ষার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংগঠন বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে এটা সত্য, হঠাৎ শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাই যতটা সম্ভব শিশুর কর্মস্থল ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ করা প্রয়োজন। ইসলামী শ্রমনীতিমালা অনুসারে মালিক শ্রমিকের ওপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপাতে পারবে না। কেননা আল্লাহতায়ালা সাধ্যাতীত কোনো কাজ করার দায়িত্ব চাপিয়ে দেননি।
দেশে প্রায় ১ কোটির কাছাকাছি শিশু শ্রমে নিয়োজিত। তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করে। সেখানে নানা ধরনের নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অভাবের তাড়নায় রাস্তায় পাথর ভাঙে, গার্মেন্টে কাজ করে, ঠেলাগাড়ি চালায়, কাগজ কুড়ায়, বাজারে মুটের কাজ করে, পার্কে ফুলের মালা বিক্রি করে। এ ছাড়া শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম, যেমন_ উটের জকি, অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি, ছিনতাই, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ে বাধ্য করা হয়। এ ধরনের প্রতিটি কাজ ইসলামে অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সামগ্রিকভাবে শিশুদের নিপীড়নমূলক এসব কাজ থেকে মুক্তি দিতে ধর্মীয় সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারিভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
শিশুশ্রম প্রতিরোধ বিষয়ে এখন সব দেশে ও সব মহলে চিন্তাভাবনা চলছে। উন্নত ও ধনী দেশে শিশুরা সব ধরনের অধিকার পেলেও দরিদ্র দেশগুলোতে তারা অধিকার বঞ্চিত থেকে যায়। শিশুশ্রমিক যেমন শহরে আছে, তেমনি গ্রামেও আছে। এ ক্ষেত্রে প্রায়ই তাদের অঙ্গহানির ঘটনা ঘটছে, এমনকি মৃত্যুমুখেও পতিত হচ্ছে।
শিশুশ্রম চালু হওয়ার প্রধান কারণ, পেটের তাগিদে তাদের কোথাও না কোথাও কাজ করতে হয়, শ্রমের বিনিময়ে তারা খাবার জোগাড় করে। অন্যদিকে শিশুশ্রমিকদের তুলনামূলকভাবে অনেক কম মজুরি দিয়ে কাজ করানো যায়। এ কারণেই নিয়োগকারীরা শিশুদের কাজে লাগায় এবং বেশি করে খাটায়, যা শিশুদের দেহ-মনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। শিশুশ্রমিকরা অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করে, যার নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। বিশ্রাম ও বিনোদনের কোনো অবকাশ নেই। কাজেই একেবারে বিশ্রামহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে শিশুদের বাধ্য করা যাবে না। এক সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাজ করার পর অনুরূপ নিরবচ্ছিন্নভাবে তাকে অবসর ও বিশ্রামের সুযোগ দিতে হবে। এটি মৌলিক মানবাধিকারের পর্যায়ে গণ্য। তাই এ প্রসঙ্গে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘লোকদের সহজাত দাও, কঠোরতার মধ্যে নিক্ষেপ করো না।’
ধর্মীয় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে শিশুর যথার্থ বিকাশ সাধিত হয় না। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) অবহেলিত শিশুদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ও বিনোদনের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ধর্মে-কর্মে যথার্থ মানুষ হিসেবে গঠন করেছিলেন। তিনি শিশুদের প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। যে কোনো শিশুকে তিনি নিজের সন্তানের মতো আদর করতেন। তাই শিশুদের শারীরিক নির্যাতন না করে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্য হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা শিশুদের স্নেহ করো, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো এবং সদাচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।’ (তিরমিজি)।শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য তাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হবে, এ সম্পর্কে হজরত রাসুলল্লাহ (সা.) বাণী দিয়েছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের উত্তমরূপে জ্ঞানদান করো, কেননা তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্ট।’ (মুসলিম)ইসলাম পরিপন্থী শিশুশ্রম অকালে কত শিশুর জীবন বিনাশ করছে। এসব মানবেতর জীবনযাপনকারী শিশুর জন্য মুসলিম বিশ্বকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আজকের প্রজন্মের শিশুরাই ভবিষ্যতের কর্ণধার। তাই নতুন প্রজন্মের হাতগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে তথা শিশুদের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব গণমাধ্যমসহ সবাইকে নিতে হবে।
আমরা আশা করব, শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বের সব দেশের সরকার ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এগিয়ে আসবে। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। ‘শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, শিশু পাচার বন্ধ কর’_ কেবল এসব সস্নোগান দিলেই হবে না, এ ব্যাপারে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। শিশুদের শিক্ষা যাতে নিশ্চিত করা যায়, সেজন্য সরকারকে আরো বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এ শিশুরা যাতে অকালে শেষ হয়ে না যায়, সে বিষয়ে কাজ করতে হবে। দরিদ্র শিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তারা যেন উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে, সেজন্য ওদের মা-বাবাকে বোঝাতে হবে, ওদের যেন স্কুলে পাঠায়, কমপক্ষে প্রাইমারি শিক্ষা অর্জন করতে পারে।
তাই আমাদের উচিত শিশুদের শিক্ষাদান করা, যাতে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর ও সফল হয়। শৈশব থেকে সন্তানকে প্রাপ্য অধিকার প্রদান ও উত্তম আচার-আচরণের দ্বারা আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কেননা মানব সন্তানের শৈশব হল কাদা মাটির ন্যায়, শৈশবে তাকে যেমন ইচ্ছা তেমন গড়ে তোলা যায়। স্থায়িত্ব ও প্রভাব বিস্তারের দিক থেকেও শৈশবকালীন শিক্ষা মানব জীবনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। শৈশবকালীন শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, ‘শৈশবে বিদ্যার্শন (স্থায়িত্বের দিক থেকে) পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্যের ন্যায়।’ ইসলাম ১৪০০ বছরের অধিককাল যাবৎ শিশুদের বিষয় গুরুত্বারোপ করে আসছে এবং শিশু পরিচর্যার বিষয়কে ইসলামের মৌলিক নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত করত তাকে একটি সার্বক্ষণিক পালনীয় বিধানে পরিণত করেছে। ইসলাম যে শিশুর জন্ম মুহূর্ত থেকেই তার অধিকারের কথা ঘোষণা করেছে তা নয়, বরং তার জন্মের পূর্ব থেকেই তার অধিকার নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইসলামী দৃষ্টিতে শৈশব হচ্ছে সৌন্দর্য, আনন্দ, সৌভাগ্য ও ভালোবাসার পরিপূর্ণ এক চমৎকার জগৎ। সন্তানকে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্যের ঘোষণা পবিত্র কোরআনে এসেছে_ ‘ধন সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি হচ্ছে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য বিশেষ।’ (সুরা কাহাফ)।
সুতরাং পার্থিব জীবনের সুখ-শান্তি ও সৌন্দর্য এ শিশুকে ভবিষ্যতে সম্পদ হিসেবে গড়ি তোলার জন্য শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন। তাই আসুন সবাই মিলে শিশুশ্রম প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।