(পর্ব:- ১)
আব্দুল্লাহ নাম, সিদ্দীক ও আতীক উপাধি, ডাকনাম বা কুনিয়াত আবু বকর। পিতার নাম ‘উসমান, কুনিয়াত আবু কুহাফা। মাতার নাম সালমা এবং কুনিয়াত উম্মুল খায়ের। কুরাইশ বংশের উপর দিকে ষষ্ঠ পুরুষ ‘মুররা’তে গিয়ে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জন্মের দু’বছরের কিছু বেশী সময় পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং অনুরূপ সময়ের ব্যবধানে তাঁরা উভয়েই ইনতিকাল করেন। তাই মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বয়সের সমান।
তিনি ছিলেন উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, পাতলা ছিপছিপে ও প্রশস্ত ললাট বিশিষ্ট। শেষ বয়সে চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল। মেহেন্দীর খিজাব লাগাতেন। অত্যন্ত দয়ালূ ও সহনশীল ছিলেন।
তিনি ছিলেন সম্মানিত কুরাইশ ব্যক্তিবর্গের অন্যতম। তিনি জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও সচ্চরিত্রতার জন্য আপামর মক্কাবাসীর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। জাহিলী যুগে মক্কাবাসীদের দিয়াত বা রক্তের ক্ষতিপূরণের সমূদয় অর্থ তাঁর কাছে জমা হতো। আরববাসীর নসব বা বংশ সংক্রান্ত জ্ঞানে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ। কাব্য প্রতিভাও ছিল। অত্যন্ত বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল-ভাষী ছিলেন। বক্তৃতা ও বাগ্মিতায় আল্লাহপ্রদত্ত যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন।
তিনি ছিলেন তাঁর গোত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয়, বন্ধু বৎসল ও অমায়িক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী, দানশীল ও চরিত্রবান। জাহিলী যুগেও কখনো শরাব পান করেননি। তাঁর অমায়িক মেলামেশা, পান্ডিত্য ও ব্যবসায়িক দক্ষতার কারণে অনেকেই তাঁর সাথে বন্ধুত্ব ও সখ্যতা করতো। তাঁর বাড়িতে প্রতিদিন মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়মিত বৈঠক বসতো।
আবু বকরের পিতা আবু কুহাফা কুরাইশদের মধ্যে যথেষ্ট মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন বয়োঃবৃদ্ধ ও স্বচ্ছল। তাঁর গৃহ কেবল ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলনা, সামাজিক কর্মকান্ডেও তাঁর মতামত অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করা হতো। মক্কা বিজয় পর্যন্ত ইসলামের প্রতি তিনি আকৃষ্ট না হলেও পুত্র আবু বকরকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন- এমন কোন প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। অবশ্য আলী (রাঃ) কে তিনি দেখলে মাঝে মধ্যে বলতেনঃ ‘এই ছোকরারাই আমার ছেলেটিকে বিগড়ে দিয়েছে।’ মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র খিদমতে হাজির হয়ে ইসলামের ঘোষণা দেন। হিজরী ১৪ সনে প্রায় ১০০ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। শেষ বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
আবু বকরের মা উম্মুল খায়ের স্বামীর বহু পূর্বে মক্কায় ইসলামের প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মক্কার ‘দারুল আরকামে’ ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্বামীর মত তিনিও দীর্ঘ জীবন লাভ করেন। প্রায় ৯০ বছর বয়সে ছেলেকে খিলাফতের পদে অধিষ্ঠিত রেখে ইহলোক ত্যাগ করেন।
আবু বকর ছিলেন পিতার একমাত্র পুত্র সন্তান। অত্যন্ত আদর যত্ন ও বিলাসিতার মধ্যে পালিত হন। শৈশব থেকে যৌবনের সূচনা পর্যন্ত পিতার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। বিশ বছর বয়সে পিতার ব্যবসা বাণিজ্যের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন।
শৈশব থেকেই রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকরের বন্ধুত্ব ছিল। তিনি রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র অধিকাংশ বাণিজ্য সফরের সংগী ছিলেন। একবার রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সঙ্গে ব্যবসায় উপলক্ষে সিরিয়া যান। তখন তাঁর বয়স প্রায় আঠারো এবং রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বয়স বিশ। তাঁরা যখন সিরিয়া সীমান্তে; বিশ্রামের জন্য রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র একটি গাছের নীচে বসেন; আবু বকর একটু সামনে এগিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন। এক খৃষ্টান পাদ্রীর সাথে তাঁর দেখা হয় এবং ধর্ম বিষয়ে কিছু কথাবার্তা হয়। আলাপের মাঝখানে পাদ্রী জিজ্ঞেস করে, ওখানে গাছের নিচে কে? আবু বকর বললেন, এক কুরাইশ যুবক, নাম মুহাম্মদ বিন আবদিল্লাহ। পাদ্রী বলে উঠলো, এ ব্যক্তি আবরদের নবী হবেন। কথাটি আবু বকরের অন্তরে গেঁথে যায়। তখন থেকেই তাঁর অন্তরে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রকৃত নবী হওয়া সম্পর্কে প্রত্যয় দৃঢ় হতে থাকে। ইতিহাসে এ পাদ্রীর নাম ‘বুরাইরা’ বা ‘নাসতুরা’ বলে উল্লেখিত হয়েছে।
রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত লাভের ঘোষণায় মক্কায় হৈ চৈ পড়ে গেল। মক্কার প্রভাবশালী ধনী নেতৃবৃন্দ তাঁর বিরোধীতায় কোমর বেঁধে লেগে যায়। কেউ বা তাঁকে মাথা খারাপ, কেউ বা জীনে ধরা বলতে থাকে। নেতৃবৃন্দের ইঙ্গিতেও তাকে দেখা-দেখি সাধারণ লোকেরাও ইসলাম থেকে দূরে সরে থাকে। কুরাইশদের ধনবান ও সম্মানি ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র আবু বকর রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সঙ্গ দেন, তাঁকে সাহস দেন এবং বিনা দ্বিধায় তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনেন। এই প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ঃ ‘আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, একমাত্র আবু বকর ছাড়া প্রত্যেকের মধ্যে কিছু না কিছু দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করেছি।’ এভাবে আবু বকর হলেন বয়স্ক আযাদ লোকদের মধ্যে প্রথম মুসলমান।
মুসলমান হওয়ার পর ইসলামের ভিত্তি সুদৃঢ করার লক্ষ্যে তিনি রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাথে দাওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মক্কার আশপাশের গোত্রসমূহে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। হজ্জের মওসুমে বিভিন্ন তাঁবুতে গিয়ে লোকদের দাওয়াত দিতেন। বহিরাগত লোকদের কাছে ইসলাম ও রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পরিচয় তুলে ধরতেন। এভাবে আরববাসী রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রচারিত দ্বীন সম্পর্কে অবহিত হয়ে তাঁর ওপর ঈমান আনেন। তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব ও চেষ্টায় তৎকালীন কুরাইশ বংশের বিশিষ্ট যুবক উসমান, যুবাইর, আব্দুর রহমান, সা’দ ও তালহার মত ব্যক্তিরাসহ আরো অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। (চলবে..)