তৃতীয় সংশয়:-
নুমান (রা.) তাঁর উপর ন্যস্ত দায়িত্বের ক্ষেত্রে জুলম প্রতিষ্ঠা করেন
নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহু ইয়াযিদের এবং তার পূর্বে মুআবিয়া রাদি আল্লাহু আনহু কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত একজন শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি আলী রাদি আল্লাহু আনহুর থেকে ভিন্নপথ অবলম্বন করেন বিধায় মুআবিয়া রাদি আল্লাহু আনহু তাঁকে তাঁর সময়ে কুফার শাসক নিয়োগ দেন। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত এবং ইয়াযিদের রাজত্বের কিছু সময় তিনি সেখানে দায়িত্ব পালন করেন অতঃপর তাকে হেমসে বদলী করেন। তাছাড়া তিনি সিরিয়ার বিচারকের দায়িত্বও পালন করেন… ইত্যাদি।
এর অর্থ দাঁড়ায় নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহু উক্ত শাসকদের শাসনকাজে রাজী ছিলেন এবং তাদের সিদ্ধান্তে সম্মত ছিলেন।
এর উত্তর:
বলা যায়, নুমান ইব্ন বাশীর মুআবিয়া রাদি আল্লাহু আনহু ও তাঁর পুত্র ইয়াযিদের সময়ে কিছু রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ট হন। তার অর্থ এই নয় যে, তাঁকে যে নির্দেশ দেয়া হত তার সাথে তিনি একমত হতেন। বরং তিনি তাঁর প্রতি প্রেরিত নির্দেশসমূহ তিনি দ্বীনের মৌলিক নীতিমালা ও আল্লাহর প্রতি তাঁর ভয়ের ভিত্তিতে বিচার করেই সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতেন। এ কারণেই আমরা দেখি তাঁকে দুর্বল, খারাপ মতামতের অধিকারী ইত্যাদি বিশেষণ প্রদান করা হয়েছে এমনকি তাঁকে তাঁর পদ থেকে অপসরণও করা হয়েছে। কারণ তিনি ঐসব নির্দেশের এতটুকু কাজে পরিণত করতেন যতটুকুকে তিনি সত্য হিসেবে বিশ্বাস করতেন এবং মহান আল্লাহ তাঁর দ্বীনের অংশ বানিয়েছেন।
সম্ভবত নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহুর অনুসৃত পদ্ধতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান থেকে প্রমাণিত হয়। বিশেষত মুসলিম ইব্ন আকীল ইব্ন আবু তালিব এবং হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুমা ও তাঁদের পরিবারের ব্যাপারে তার অবস্থান থেকে।
প্রত্যেকের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান ও এ সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি নিম্নে উপস্থাপন করা হল।
প্রথম অবস্থান:-
* মুসলিম ইব্ন আকীল রাদি আল্লাহু আনহুর ব্যাপারে নুমান রাদি আল্লাহু আনহুর অবস্থান
ইতিহাসের গ্রন্থাবলিতে বর্ণিত হয়েছে যখন মুআবিয়া রাদি আল্লাহু আনহু ইন্তিকাল করেন ও তাঁর পুত্র ইয়াযিদ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন তখন ইয়াযিদ চারজন ব্যক্তি থেকে তার শাসনের বশ্যতা স্বীকারের ইচ্ছা পোষণ করেন। তারা হলেন, আব্দুর রহমান ইব্ন আবু বকর, আব্দুল্লাহ ইব্ন উমর, আব্দুল্লাহ ইব্ন যুবাইর ও হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুম। আব্দুল্লাহ ইব্ন যুবাইর ও হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুমা শেষ পর্যন্ত মদীনা ত্যাগ করে মক্কায় চলে যান এবং তার বশ্যতা স্বীকার করেননি। তাঁরা মক্কায় অবস্থান গ্রহণ করলে সে সময় কুফাবাসী (আপনাদের নিশ্চয় জানা আছে কুফাবাসী কারা?) হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুর কাছে বারবার পত্র প্রেরণ করতে থাকে যে, আপনি আমাদের এখানে আসুন আমরা আপনার হাতে খিলাফতের বাইয়াত গ্রহণ করব। এমনকি বর্ণিত হয়েছে, তিনি একদিনে ছয়শত পর্যন্ত চিঠি পান। কিন্তু হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহু নিজে কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে তাঁর চাচাত ভাই ও ঘনিষ্টজন মুসলিম ইব্ন আকীলকে প্রেরণ করেন যেন তিনি কুফা থেকে খবর সংগ্রহ করে। যদি বিষয় তদ্রুপ হয় যেমনটি চিঠি পত্রে লেখা হয়েছে তবে তিনি তাদের কাছে গমন করবেন। মুসলিম ইব্ন আকীল কুফায় পৌঁছান। তখনই কুফাবাসী তাঁর পাশে জড় হতে শুরু করে ও তাঁর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করে। সেই সময় নুমান ইব্ন বাশীর কুফায় মুআবিয়া রাদি আল্লাহু আনহু নিযুক্ত আমীর ছিলেন এবং ইয়াযিদ তাঁকে স্বপদে বহাল রাখেন। কিন্তু নুমান রাদি আল্লাহু আনহু উদ্ভূত পরিস্থিতি অবগত হওয়া সত্ত্বেও ঘটনার ব্যাপারে নিরবতা অবলম্বন করেন ও তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অতঃপর যখন ঘটনা ব্যাপৃত হতে থাকে তখন নুমান ইব্ন বাশীর কুফাবাসীর উদ্দেশ্যে ফিতনা ফাসাদের ভয়াবহতা ও এর ফলে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে সে বিষয়ে ভাষণ প্রদান করেন। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, অতঃপর হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং ফেতনা-ফাসাদ ও মতানৈক্যের প্রতি ধাবিত হয়ো না। কেননা তাতে মানবতা বিপর্যস্ত হয়, রক্ত প্রবাহিত হয় ও সম্পদ নষ্ট হয়। যে আমার সাথে যুদ্ধ করবে না আমি তার সাথে যুদ্ধ করব না, আমি তার উপর চড়াও হব না যে আমার উপর চড়াও হবে না। তোমাদের ঘুমন্ত ব্যক্তিকে আমি জাগ্রত করব না, তোমাদের ব্যাপারে আমি নাক গলাবো না, কোন অভিযোগ-অনুযোগ, ধারণা বা অপবাদ আরোপ করব না। কিন্তু যদি তোমরা তোমাদের পৃষ্ঠদেশ আমার দিকে এগিয়ে দাও, তোমাদের বাইয়াত ভঙ্গ কর, তোমাদের নেতার বিরোধিতা কর তবে ঐ আল্লাহর শপথ! যিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই আমি অবশ্যই আমার হাতে প্রতিষ্ঠিত তরবারীর মাধ্যমে তোমাদেরকে আঘাত করব, যদি তোমাদের মধ্যে কেউ আমার সাহায্যকারী নাও হয়। তবে আমি আশাকরি তোমাদের মধ্যে সত্যান্বষীর সংখ্যা মিথ্যার অনুসারীর চেয়ে অনেক বেশি।
তখন আব্দুল্লাহ ইব্ন মুসলিম ইব্ন সাঈদ আল-খাদরামী দাড়িয়ে বললেন, যে পরিস্থিতি আপনি দেখছেন তাতে তাদের সাথে দুর্ব্যবহার ছাড়া এর কোন সমাধান হবে না। আর আপনি আপনার ও আপনার শত্রুদের মধ্যকার বিষয়ে যে অবস্থান গ্রহণ করেছেন তা দুর্বলদের অবস্থান মাত্র।
নুমান রাদি আল্লাহু আনহু বললেন, আল্লাহর অবাধ্যতায় শক্তিশালী হওয়া অপেক্ষা আল্লাহর আনুগত্যে দুর্বল হওয়া আমার নিকট অনেক প্রিয়। অতঃপর তিনি মিম্বর থেকে নামলেন।
এরপর আব্দুল্লাহ খাদরামী, উমর ইব্ন সায়াদ ইব্ন আবু ওয়াক্কাস ও উমরাহ ইবন উকবাহ ইয়াযিদের কাছে পত্র লেখন: মুসলিম ইব্ন আকীল কুফায় আগমন করেছে এবং হুসাইন ইব্ন আলীর পক্ষে বায়াত গ্রহণ করছে। অতএব আপনার যদি কুফা নগরীর প্রয়োজন থাকে তবে একজন শক্তিশালী ব্যক্তিকে এখানে প্রেরণ করুন যিনি আপনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করবেন এবং আপনার শত্রুর বিরুদ্ধে আপনার মতই কাজ করবেন। কেননা নুমান ইব্ন বাশীর একজন দুর্বল ব্যক্তি অথবা অন্যের কারণে দুর্বল হচ্ছে।
যখন পত্রটি ইয়াযীদের কাছে পৌঁছায় তখন ইয়াযীদ মুয়াবিয়া রাদি আল্লাহু আনহুর আজাদকৃত দাস আরজুনের সঙ্গে পরামর্শ করেন যে, হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহু কুফার দিকে যাওয়ার মনস্থ করছেন এবং মুসলিম ইব্ন আকীল বর্তমান কুফায় অবস্থান নিয়ে তার পক্ষে বাইয়াত প্রদান করছেন। আমার কাছে খবর পৌঁছেছে যে, নুমান একজন দুর্বল এবং তার পদক্ষেপও দুর্বল। তখন সারজুন পরামর্শ দিলেন কুফা থেকে নুমানকে অপসরণ করে উবায়দুল্লাহ ইব্ন যিয়াদকে সেখানের শাসক নিযুক্ত করুন।
এ বর্ণনা থেকে যা সাব্যস্ত হয়:
১. নুমান ইবন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহু তার চারপাশের অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন না। তবে যা ঘটছিল প্রথম পর্যায়ে তা থেকে তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে রেখেছিলেন। কেননা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তনয়ার পুত্র যাকে তিনি প্রচ- ভালবাসতেন ও সম্মান করতেন। তাঁর ব্যাপারে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, সম্ভবত তিনি তা থেকে ফিরে আসবেন কুফাবাসীর ষড়যন্ত্র অবগত হওয়ার পর।
২. পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে নুমান ইবন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহু হিকমত অবলম্বন করেন। তিনি প্রথমে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দেন ও তাদেরকে নসীহত করেন। অতঃপর ফিতনার প্রভাব ও পরবর্তীতে এর কারণে সৃষ্ট বিপর্যয় বর্ণনা করেন এবং যারা তাঁর নির্দেশের বিরোধিতা করবে তাদের ভীতি প্রদর্শন করেন।
৩. যদি নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহু ক্ষমতালিপ্সু হতেন এবং এর কারণে দ্বীনকে বিসর্জন দিতেন তবে প্রথমেই মুসলিম ইব্ন আকীলের ব্যাপার জানিয়ে ইয়াযীদকে পত্র লিখতেন বরং এ ব্যাপারে তার অবস্থান ছিল ভিন্ন। যেহেতু তাঁর হাতে ক্ষমতা ছিল সেহেতু তিনি পারতেন ঐ দলটিকে সমূলে বিনাশ করতে। কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ তিনি তাদেরই একজন যারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শিক্ষালয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। তিনি এ শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন যে, দুনিয়ার মর্যাদা যাই হোক না কেন তার প্রতি আগ্রহ অনুচিত। বরং তাঁর পদমর্যাদা আহলে বাইতের সাথে সংঘর্ষে যাওয়া থেকে বিরত রেখেছিল আর সবকিছুই ছিল তাঁদের প্রতি গভীর ভালবাসা ও অকৃত্রিম সম্মানবোধের কারণে।
৪. আব্দুল্লাহ খাদরামীর প্রশ্নের উত্তরে নুমান রাদি আল্লাহু আনহুর কথা থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর আনুগত্য তাঁর কাছে সবকিছুর চেয়ে অগ্রগণ্য। এমনকি যদি তা তাকে অন্যের দৃষ্টিতে দুর্বল ও অসহায় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করে তবুও।
৫. নুমান ইবন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহু দুর্বল ছিলেন না। কিন্তু তিনি সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতেন। তিনি ছিলেন বিনয়ী ও ধর্মভীরু যিনি শান্তি ভালবাসতেন এবং ফিতনা-ফাসাদ ও দলাদলি অপছন্দ করতেন।
৬. নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহুর দৃঢ় অবস্থানে কুফার মসনদ থেকে তার অপসরণের ও তার পরিবর্তে উবায়দুল্লাহ ইব্ন যিয়াদের আরোহণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি যদি তাদের মত হতেন যারা দুনিয়ার ক্ষমতার মোহে দ্বীনকে বিক্রি করে দেয় তবে তাঁর প্রতি যে নির্দেশ আসত সন্তুষ্টচিত্তে তার আনুগত্য করতেন এবং নিজের ক্ষমতা ও পদমর্যাদা রক্ষার্থে তা বাস্তবায়ন করতেন। কিন্তু এটি তার চারিত্রিক ও নৈতিক বৈশিষ্ট্য ছিল না।
দ্বিতীয় অবস্থান:-
হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহু ও তাঁর পরিবারের ব্যাপারে নুমান রাদি আল্লাহু আনহুর অবস্থান
আহলে বাইতের ব্যাপারে নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহুর অবস্থান থেকে তাঁদের প্রতি ভালবাসা, সম্মানবোধ ও তাঁদের মর্যাদার স্বীকৃতির প্রমাণ পাওয়া যায়। যা বর্তমানের বহুল প্রচারিত নীতি ‘মুআবিয়া ও তার পরিবারের প্রতি তোমার ভালবাসার অর্থ আহলে বাইতের প্রতি বিদ্বেষ, আর তাদের সাথে তোমার আঁতাত অর্থ আহলে বাইতের সাথে যুদ্ধ’ এ নীতি বাতিল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ রাখে না। সমস্ত সাহাবীর উপর এ এক মারাত্মক মিথ্যা।
এ প্রসঙ্গে আলোচনা দুটি ভাগে বিভক্ত হবে। একভাগে হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুর ব্যাপারে তাঁর অবস্থান ও অন্যভাগে তাঁর পরিবারের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান।
১. হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুর ব্যাপারে নুমান রাদি আল্লাহু আনহুর অবস্থান:
নুমান রাদি আল্লাহু আনহু হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুকে প্রচ- ভালবাসতেন। এক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান অন্যান্য মুসলমানের মতই। তিনি অন্তরের গহীনকোণে এ আশা পোষণ করতেন যে, নিজের জীবন, সন্তান-সন্তুতি ও ধন-সম্পদ তাঁর জন্য উৎসর্গ করবেন। তবে হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুর জন্য নুমান রাদি আল্লাহু আনহুর ভালবাসা বিশেষ ধরণের ছিল। যে কারণে তাকে জটিল পরিস্থিতির মুখাপেক্ষী হতে হয়েছিল এবং বিভিন্ন প্রকার কায়, ক্লেশ ও যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল। নিম্নে এই ভালবাসার মুক্তাখচিত প্রমাণ উপস্থাপন করা হল:
ক. ইতিহাস গ্রন্থাবলিতে উল্লেখিত হয়েছে উবায়দুল্লাহ ইব্ন যিয়াদ যখন হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুর পক্ষে বাইয়াত গ্রহণের কারণে মুসলিম ইব্ন আকীলের সাথে বোঝাপড়া করার জন্য কুফায় আগমন করেন এবং হঠাৎ প্রাসাদে এসে পড়েন। তখন নুমান রাদি আল্লাহু আনহু একদল মানুষের সাথে অবস্থান করছিলেন যারা তাঁর পাশে এ ধারণা করে জড় হয়েছিল যে, হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহু আগমন করেছেন। কেননা উবায়দুল্লাহর মুখ ঢাকা ছিল। তখন নুমান রাদি আল্লাহু আনহু তাঁর গৃহে প্রবেশ করলেন ও দরজা বন্ধ করে দিলেন। অতঃপর যখন উবায়দুল্লাহ ইব্ন যিয়াদ তাঁর ঘরে পৌঁছে দরজার কড়া নাড়ালেন, তখন নুমান রাদি আল্লাহু আনহু হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহু এসেছেন মনে করে বের হলেন এবং বললেন: আমি আপনার জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি। আপনি সরে যান, আল্লাহর শপথ! আমি আমার আমানত আপনার হাতে অর্পণকারী নই। আর আপনার সাথে যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছাও আমার নেই। সে সময় উবায়দুল্লাহ শুধু এতটুকু বলেছিল দরজা খুলুন, যদি না খোলেন, তবে আপনার রাত দীর্ঘ হবে …… অতঃপর তিনি দরজা খুললেন।
এ থেকে যা সাব্যস্ত হয়:
১. নুমান রাদি আল্লাহু আনহু হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুর আগমন সম্পর্কে জানতে এ কারণে নিজের ও ঘনিষ্টজনের থেকে ফিতনা এড়ানোর জন্য নিজ গৃহে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করেন।
২. নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহু হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুর সাথে মুখামুখী না হওয়ার ব্যাপারে প্রচ- আগ্রহী ছিলেন। এ কারণে তার অন্তরের কথাটি হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহু মনে করে উবায়দুল্লাহর সামনে প্রকাশ করে বলেন, “আল্লাহর শপথ! আপনার সাথে যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছাই আমার নেই।” যদি তিনি রাজ্য শাসন, শাসকের চাটুকারিতা ও তাদের আনুকুল্যের ব্যাপারে উৎসাহী হতেন, তবে সরাসরি এভাবে বলতেন না।
৩. নুমান ই্বন বাশীরের অন্তরে যদি হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহু ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি এ অকৃত্রিম ভালবাসা ও উচ্চ অবস্থান না থাকত তবে তিনি নিজেই তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। প্রথমত তার রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও দ্বিতীয়ত বিশৃংখলা সৃষ্টির প্রতিরোধে। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁকে এ গোনাহ ও অপরাধ থেকে রক্ষা করেছেন।
(খ) ইমাম তাবরানী তাঁর সনদে মুহাম্মদ ইব্ন আলী ইব্ন হুসাইন থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহু হিরায় তাঁর ভূ-খন্ডের উদ্দেশ্যে বের হন, আমরাও তাঁর সাথে ছিলাম। অতঃপর নুমান ইব্ন বাশীর খচ্চরের পিঠে সওয়ারী অবস্থায় আমাদের সাথে সাক্ষাত হলে তিনি আরোহী থেকে নেমে খচ্চরটি হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুর নিকটবর্তী করলেন এবং বললেন, আবু আব্দুল্লাহ! আরোহণ করুন। তিনি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে নুমান বিভিন্নভাবে শপথ করে তার চেষ্টা অব্যাহত রাখে যাতে হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহু পশুতে আরোহণ করার ব্যাপারে তার অনুগত হয়। তিনি বললেন, আপনি কসম করাতে আমার অপছন্দটা হাল্কা হয়ে গেছে। আমি আপনার পশুর বক্ষে আরোহন করব এবং আমি আপনাকে পশ্চাতে আরোহণ করাবো। অথচ আমি ফাতিমা বিনত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, মানুষ তার পশুর বক্ষে আরোহণ, বিছানার ও তার নিজ ঘরে নামাজ আদায়ের বেশি হকদার, শুধুমাত্র ইমাম ব্যতীত যার কাছে মানুষ জড় হয়। তখন নুমান রাদি আল্লাহু আনহু বললেন, ফাতিমা বিনত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য বলেছেন। আমি আমার পিতা বাশীরকেও অনুরূপ বলতে শুনেছি যেমনটি ফাতিমা রাদি আল্লাহু আনহা বলেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তবে যাকে অনুমতি দেয়া হয়েছে” অতঃপর হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহু জিনের উপর বসলেন এবং আনসারী তার পিছনে আরোহণ করলেন।
এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলা কি শুদ্ধ হবে যে, আহলে বাইতের সাথে তার শত্রুতা ছিল? এবং তিনি তাঁদের থেকে প্রাপ্তির প্রচেষ্টায় থাকতেন?
উক্ত উদ্ধৃতি পাঠের পর এ প্রশ্নের আলাদা উত্তর পাওয়ার জন্য কোন ধরনের চেষ্টা পরিশ্রমের বা মস্তিষ্কের পেরেশানির প্রয়োজন হয় না। অতএব এ প্রশ্নের উত্তর সম্মানিত পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম।
২. হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুর পরিবারের ব্যাপারে নুমান রাদি আল্লাহু আনহুর অবস্থান
হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুর প্রতি তাঁর ভালবাসা, সম্মানবোধ, তাদের উচ্চ মর্যাদা ও অবস্থানের স্বীকৃতি প্রদান থেকে ভিন্ন নয়। এর প্রমাণ স্বরূপ পাঠকের উদ্দেশ্যে আমরা কয়েকটি উদ্বৃতি বর্ণনা করব।
(ক) ইতিহাসের তথ্যগ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে, ইয়াযিদ নুমান ইব্ন বাশীরকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করে বলেন, এই মহিলাগুলো (হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুর পরিবার) মদীনায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা কর……. তাঁদের সাথে সার্বক্ষণিক তার মতই অবস্থান করবে যে নুমানকে প্রতিনিধি নির্বাচন করেছে এবং তাকে নির্দেশনা দিয়েছে (অর্থাৎ ইয়াযিদ তার প্রতিনিধিকে দিয়েছে) তিনি তাঁদের নিয়ে রাতে চলাচল করতেন, তাঁদের সামনেই থাকতেন এবং একপলক পরিমাণ সময় আড়াল হতেন না। যখন তাঁরা বিরতির জন্য অবস্থান নিতেন তখন তিনি তাঁদের যাবতীয় ক্লেশ দূর করতেন। তিনি এবং তার সাথীরা সার্বক্ষণিক তাঁদের পাশেই নিরাপত্তা প্রহরীর মতই অবস্থান নিতেন। তাঁদের সাথে এমনভাবে লেগে থাকতেন যে, দলবদ্ধ থাকলেও মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত কাজ যেমন-ওজু করা, প্রয়োজন পূরণ ইত্যাদি সময়েও তাদের সঙ্গ দিতে লজ্জাবোধ করেননি। তিনি পুরা রাস্তায় তেমন ছিলেন যেমনটি ইয়াযিদ তাকে নির্দেশ দিয়েছিল এবং মদীনায় প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত তাঁদের সাথেই ছিলেন।
কোন কোন বর্ণনায় এমনও এসেছে যে, ফাতিমা বিন্ত আলী তাঁর বোন যয়নাবকে বললেন, এই ব্যক্তির সৎ সাহচর্যের কারণে তার প্রতিদান প্রদান করা আমাদের উপর আবশ্যক হয়ে দেখা দিয়েছে। তোমার কাছে কি এমন কিছু রয়েছে যা দিয়ে আমরা তার প্রতিদান দিতে পারি? তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! আমার কাছে তাঁকে দেওয়ার মত কিছুই নেই শুধুমাত্র আমাদের গহনা ব্যতীত। অতঃপর আমি আমার চুড়ি ও বাজুবন্ধ অথবা আমার বোনের চুড়ি ও বাজুবন্ধ তাঁর কাছে প্রেরণ করলাম এবং তা অল্প হওয়ায় আমরা আমাদের অপারগতা স্বীকার করে বললাম, আপনি আমাদের সাথে যে সদাচরণ করেছেন তার সামান্য প্রতিদান এটি।
তখন তিনি বললেন, আমি যা করেছি তা যদি দুনিয়ার উদ্দেশ্যে করতাম তবে এতে আমি সন্তুষ্ট হতাম না। কিন্তু আল্লাহর শপথ! আমি ঐ কাজ করেছি শুধুমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে এবং রাসূলুল্লাহর সাথে আপনাদের নৈকট্যতার কারণে।
এই উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্টভাবে নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহু কর্তৃক হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুর পরিবারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয় প্রতীয়মান হয়। কিছু কিছু তথ্যসূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তাঁদের সাহচর্যের জন্য যে প্রতিনিধি বাছাই করা হয় তিনি ছিলেন সৎ বিশ্বস্ত। এ থেকে যা প্রমাণিত হয় তা হল, নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহুর ভীতি ও তাঁদের প্রতি তাঁর ভালবাসা।
এরপরেও কি বলার অবকাশ আছে যে, নুমান তাদের মধ্যে একজন যারা হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুর পরিবারের সাথে বিদ্বেষপোষণ করত, তাঁদের কষ্ট, ক্লেশ প্রদান করত ও তাঁদের ক্ষতিসাধনে ব্রত হত? এ এক মহা অপবাদ। হে আল্লাহ আপনার পবিত্রতা।
(খ) হিরার অধিবাসীদের ব্যাপারে নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহুর অবস্থান:
হিরার ঘটনাটি হিজরী ৬৩ সনে ঘটে। এর কারণ ছিল, মদীনাবাসী ইয়াযিদ ইব্ন মুআবিয়ার বাইয়াত প্রত্যাখ্যান করে এবং এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। আনসাররা আব্দুল্লাহ ইব্ন হানজালাহকে তাদের শাসক নিযুক্ত করেন, যিনি ছিলেন নুমান ইব্ন বাশীরের বৈপিত্রীয় ভাই। অন্যদিকে মুহাজিরগণ আব্দুল্লাহ ইব্ন মুতীঈ আল-আদয়ীকে তাঁদের আমীর নিযুক্ত করে। তাঁদের প্রতি ইয়াযিদ মুসলিম ইব্ন উকবাহ আল-মাররীর নেতৃত্বে বিশাল এক সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। তারা তাদের পরাজিত করে মদীনা দখল করে এবং ইব্ন হানজালাহসহ অনেক আনসারকে হত্যা করে।
এই অমানবিক হত্যাকা- বন্ধ করার জন্য নুমান রাদি আল্লাহু আনহু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করতে সক্ষম হননি। ইব্ন আসাকির বলেন, নুমান ইবন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহু ইয়াযিদকে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমাকে প্রেরণ করুন আমি আপনার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু ইয়াযিদ সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তিনি নুমান রাদি আল্লাহু আনহুর সরলতা, মুসলমানদের রক্ত প্রবাহিত না হওয়ার ব্যাপারে তার আগ্রহ সম্পর্কে জানতেন। নুমান তাকে বলেন, হে আমিরুল মুমিনীন! আমি আপনার পরিবার ও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনসারদের ব্যাপারে আপনাকে আল্লাহর নামে শপথ করাই।”
হুসাইন রাদি আল্লাহু আনহুর পরিবার পরিজন মদীনায় বসবাস করতেন। মদীনার প্রতিষ্ঠাতার উপর দরুদ ও সালাম।
ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, যুদ্ধ অনুষ্ঠিত না হওয়া ও রক্তপাত না করার জন্য নুমান রাদি আল্লাহু আনহুর অদম্য স্পৃহা এবং ইয়াযিদের কাছে আল্লাহর উপর শপথ দেয়া যাতে তিনি মদীনাবাসীর উপর কমল হন যাদের মধ্যে আহলে বাইতও ছিলেন।
নুমান রাদি আল্লাহু আনহু তাঁদের রক্তের ফোটা বের হওয়ার বা ব্যাপক দৃষ্টিতে সাহাবীগণের রক্তপাত বিষয়ে চিন্তিত ছিলেন। বিধায় বিষয়টি নিয়ে ইয়াযিদের সাথে আলাপ করতে তাড়িত হয়েছিলেন এবং তার কাছে আবেদন করেছিলেন যেন তিনি তাকে মদীনার বিষয়টি সমাধান করার জন্য তাকে সেখানে প্রেরণ করেন। এর মধ্যে সাহাবী ও নবী পরিবারের মধ্যকার ভালবাসার সম্পর্কের উত্তম দলীল রয়েছে। আর তাঁরা সকলেই একই পতাকা তলে ছিলেন।
এরপরেও কি বলা যায়, নুমান তাদেরই একজন যারা আহলে বাইতের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতাপোষণ করতেন?
উপরোক্ত বর্ণনাসমূহের আলোকে সংক্ষেপে বলা যায়, নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহু আহলে বাইতের ব্যাপারে খুবই উৎসাহী ছিলেন এবং তাঁদের ব্যাপারে শাসকদের নীতি যদি তার আকীদা বিশ্বাস ও আল্লাহর দ্বীনের বিরোধী হত তবে তিনি তা প্রয়োগ করতেন না। এ কারণেই তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপিত হয় এবং দুনিয়ার এক পদমর্যাদা থেকে তাঁকে অপসরণ করা হয়। তারপরেও তিনি এ নিয়ে চিন্তিত হননি এই ভেবে যে, তিনি সৃষ্টির আনুগত্যের উপর স্রষ্টার আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অতএব আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং সন্তুষ্ট করেছেন।