যৌবনকাল মানুষের শ্রেষ্ঠ সময়, যা দুরন্তপনা ও সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য পরিচালিত করে। যেকোনো মহৎ উদ্দেশ্যে সহজে জীবন বিলিয়ে দিতে প্ররোচিত করে। যুবমানসের স্বভাব বা প্রকৃতি এবং সাহসিকতা সম্পর্কে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ডা: লুতফর রহমান বলেছেন, ‘যুবকদের গায়ের জোরে আস্থা বেশি।…যুবকেরাই যুদ্ধের যোগ্য। লড়াই করা, নিজের জীবনের মায়া না করা ওদের স্বভাব। নিজে ছোট বা দুর্বল, পরাজয়ের বিপদ তার ভাগ্যে ঘটতে পারে এ কথা সে মোটেই বিশ্বাস করতে পারে না।’ যৌবনকাল দায়িত্বপূর্ণ কাজের জন্য উপযুক্ত সময়। আল্লাহ নবী নির্বাচন করেছেন যুবকদের মধ্য থেকেই। হজরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রা: বলেছেন, ‘আল্লাহ যুবক ছাড়া কোনো নবী পাঠাননি এবং যুবক ছাড়া কাউকে ইলম দান করেননি।’ তারপর এ আয়াতটি পাঠ করেন : ‘তারা বলে আমরা এক যুবককে মূর্তিগুলোর কথা স্মরণ করতে শুনেছি, যার নাম ইব্রাহিম।’ হজরত ইউসুফ আ: সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে, ‘তিনি যখন পূর্ণ যৌবনে পৌঁছলেন, তখন তাকে প্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তি দান করলাম।’ (সূরা ইউসুফ-২২)। হজরত মুসা আ: সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে, ‘যখন মুসা আ: ভরা যৌবনে পদার্পণ করেন এবং পরিণত বয়সে পৌঁছেন, তখন আমি তাঁকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করলাম।’ (সূরা কাসাস-১৪)। এভাবে প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা: শৈশব ও কৈশোরে আদর্শবান ছিলেন, কিন্তু যখন যৌবনে পদার্পণ করলেন তখন তাঁকে নবুওয়াতের দায়িত্ব প্রদান করলেন আল্লাহ তায়ালা। রাসূল সা: যৌবনের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে এক ব্যক্তিকে বললেন, পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের আগে মূল্যবান মনে করবে। বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, অভাবের আগে সচ্ছলতাকে, ব্যস্ততার আগে অবসরকে এবং মৃত্যুর আগে জীবনকে।’ (মিশকাত)। কিয়ামতের কঠিন হিসাবের দিন আল্লাহর আরশে স্থান লাভকারীদের মধ্যে অন্যতম হলো যুবকেরা, আল্লাহর আদেশ পালনে অগ্রগামী। তাই যৌবনের গুরুত্ব অনুধাবন করে শেখ সাদী র: যথার্থই বলেছেন, ইহকাল ও পরকালে যা প্রয়োজন যৌবনকালেই তা সংগ্রহ করো।
বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী র:-এর কিছু কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছেনÑ ১. মিথ্যার প্রাবল্য দেখে ঘাবড়ে যাবেন না। সে তো কখনো ঝড়ের বেগে আসে, আবার কখনো বুদবুদের মতো শূন্যে বিলীন হয়ে যায়। মিথ্যার মোকাবেলা করার কোনো চিন্তা আপনার করা ঠিক নয়, বরং চিন্তা আপনার সততার জন্য হওয়া উচিত। ২. ময়দানে মোকাবেলায় ভীত হয়ে দুর্গের মধ্যে আত্মগোপন করা কাপুরুষতার সুস্পষ্ট নিদর্শন। আল্লাহ তায়ালা এ জমিনকে কাপুরুষদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সৃষ্টি করেননি। ৩. আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ যে তিনি আমাদেরকে আঁধারে প্রদীপ জ্বালানোর তাওফিক দিয়েছেন। এ অনুগ্রহের শুকরিয়া আমরা এভাবে আদায় করব যে, প্রদীপ জ্বালাতে জ্বালাতেই মৃত্যুবরণ করব। ওপরের এই তিনটি উক্তি বর্তমান প্রোপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশ ও সমাজে এখন চলছে মিথ্যার প্রাবল্য, মিথ্যার দাপট, মিথ্যার বেসাতি। যা ঝড়ের বেগে বয়ে চলছে।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর আন্দোলনে যুবকদের অংশগ্রহণ : রাসূল সা: সময়কালে যুবকদের নিয়েই তিনি হিলফুল ফুজুল বা শান্তি সঙ্ঘ, যুবসঙ্ঘ গঠন করেছিলেন। যেকোনো আন্দোলনে যুবকেরাই আন্দোলনের গতিপ্রকৃৃতি বদলে দেয়। যুবকেরাই সমাজ-দেশ-কালের চালিকাশক্তি। রাসূলুল্লাহ সা:-এর আন্দোলনে বৃদ্ধ লোকের চেয়ে যুবকদের সংখ্যাই বেশি ছিল। বয়োবৃদ্ধদের অনেকেই দ্বীনি আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন। তরুণ-যুবকদের রক্তই হলো ইসলামী আন্দোলনের ভিত্তি। তাদের ত্যাগের বিনিময়েই এই পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেছে। আলী ইবনে আবু তালিব রা:, জাফর তাইয়ার রা:, যুবাইর রা:, তালহা রা:, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা:, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা:, মুসআব ইবনে উমাইর রা:দের বয়স ইসলাম গ্রহণের সময় ২০ বছরের নিচে ছিল। আবদুর রহমান ইবনে আওফ রা:, বেলাল রা: ও সোয়াইব রা:-এর বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ছিল। আবু ওবাইদা ইবনুল জাররাহ রা:, জায়েদ ইবনে হারেসা রা:, উসমান ইবনে আফফান ও উমর ফারুক রা:-এর বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে ছিল। এভাবে আরো অনেক সাহাবির নাম বলা যাবে। এই তরুণ-যুবক সাহাবারা আমাদের তরুণদেরও প্রেরণার উৎস। হজরত মুসা আ:-এর সময়ও নওজওয়ানরা তাঁকে মেনে নিয়ে ছিল, বরং বয়স্করা প্রবল বিরোধিতা করেছিল। এরশাদ হচ্ছে, ‘(তারপর দেখো মুসাকে) তাঁর কাওম কিছু নওজওয়ান ছাড়া কেউ মেনে নেয়নি, ফেরাউনের ভয়ে এবং তাদের কাওমের নেতৃস্থানীয় (বয়স্কদের) ভয়ে। (তাদের আশঙ্কা ছিল) ফেরাউন তাদের ওপর নির্যাতন চালাবে।’ (সূরা ইউনুস-৮৩)। আল কুরআনে আসহাবে কাহাফ বা গুহাবাসীদের যে ঘটনা বর্ণনা করেছেন তারাও প্রত্যেকেই ছিলেন তরুণ-যুবক। এরশাদ হয়েছে, ‘যখন ক’জন যুবক গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করল এবং তারা বলল, হে আমাদের রব! তোমার বিশেষ রহমত দ্বারা আমাদের প্লাবিত করো।’ (সূরা কাহাফ-১০)। আমাদের প্রিয়নবী সা: তরুণ-যুবকদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাদের ল্য করে বলেছেন, আমি তোমাদেরকে তরুণ-যুবকদের কল্যাণকামী হওয়ার জন্য নসিহত করছি, আদেশ দিচ্ছি। তাদের হৃদয় অত্যন্ত কোমল। আল্লাহ তায়ালা আমাকে উদারতা দান করেছেন এবং মানুষকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্যই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমাকে সহযোগিতা করেছে তরুণ-যুবক সম্প্রদায়। দ্বীনি আন্দোলনে বয়োবৃদ্ধ শ্রেণী বাধার সৃষ্টি করেছে।
জেল-জুলুম-নির্যাতন আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ : কায়েমি শক্তি শাশ্বত আন্দোলনকে অন্য কোনো ভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে অপপ্রচার, নির্যাতন ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ধ্বংস করতে চায়। রাসূল সা:-এর আন্দোলন, আদর্শ ধ্বংসের জন্য আবু জেহেল, আবু লাহাবেরা সীমাহীন সন্ত্রাস ও নির্যাতন চালিয়েছিল। কবি, পাগল, গণক, জাদুকর বলে অপপ্রচার চালিয়েছে, ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ, গালিগালাজ করেছে, বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য, উসকানিমূলক কথা বলেছে, দৈহিক নির্যাতন চালিয়েছে, শিয়াবে আবু তালেব গিরিগুহায় প্রায় তিন বছর অবরোধ করে রেখেছিল, তায়েফে তাঁর দেহ রক্তাক্ত করেছিল, এমনকি প্রাণনাশের অনেক ব্যর্থ চেষ্টাও চালিয়েছিল। তাঁর সাহাবিদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে। ইমাম আবু হানিফা র:, ইমাম মালেক র:, ইমাম হাম্বল র:, ইমাম ইবনে তাইমিয়া র:, ইমাম হাসানুল বান্না র:, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ র:, সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী র:, সাইয়্যেদ বদিউজ্জামান নুরসি র:, ইমাম খোমেনি র:, মুজাদ্দেদ আল ফেসানি র:, সাইয়্যেদ আহমদ বেরেলভি র:, জামাল উদ্দিন আফগানি র:, হাজী শরীয়ত উল্লাহ, মীর নিসার আলী তিতুমীর র: প্রমুখেরাও অনেক জুলুম-নির্যাতন-শাহাদত-নির্বাসনের মুখোমুখি হয়েছেন। আজো তাদের উত্তরসূরিরা ইসলামী আন্দোলনকে বলছে, মৌলবাদী, জঙ্গি, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী বলে অপবাদ দিচ্ছে। গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করেছে, প্রহসনের বিচারের মুখোমুখি করেছে। যুগে যুগে জেল-জুলুম-নির্যাতনের রূপ ভিন্ন ভিন্ন হলেও মূল উদ্দেশ্য মহাসত্যকে অস্বীকার করা, শাশ্বত আদর্শকে যেকোনো উপায়ে ধ্বংস করা। নির্যাতনের মাত্রা কঠিনতর হতে পারে, ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। এ পথ ফুল বিছানো নয়। এটাই হলো আন্দোলনের শিা এবং আন্দোলন-সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তরুণদের উদ্দেশে শহীদ ইমাম হাসানুল বান্না ও ইউসুফ আল কারজাভি : আমাদের যে মহান আন্দোলন তা নবী-রাসূলদের প্রদর্শিত পথে এবং বিশ্বনিয়ন্তার সন্তুষ্টির জন্যই। তরুণ-যুবকেরা অগ্রগামী হয়ে ঝাণ্ডা হাতে তুলে নেবে, যাদের দৃঢ় সঙ্কল্প হবেÑ হয় বিজয় নয় শাহাদত; হয় ষড়যন্ত্রকে রুখে দেয়া, নয় রাজপথে টিকে মরণপণ লড়াই করতে হবে। হাসানুল বান্না বলেছেন, ‘তোমরা এ জাতির বুকে এক নতুন আত্মা। আল কুরআনের সাহায্যে এ জাতিকে দেবে নতুন জীবন। তোমরা এক নতুন আলো। আল্লাহর পরিচিতি লাভ করে তোমরা জ্বলজ্বল করছো, তোমরা বস্তুবাদের বিনাশ করবে। তোমরা এক বুলন্দ কণ্ঠ। রাসূলুল্লাহ সা:-এর বাণী নতুনভাবে ঘোষণা করতে তোমরা উত্থিত। তিনি তাই তো ডাক দিয়েছেন তাদের ল করে। জাতির হে তরুণ-যুবকেরা জেগে ওঠো, বর্তমান বিশ্বের প্রোপট ঘোষণা করছে আগামী শতাব্দী ইসলামের শতাব্দী।’ ইউসুফ আল কারজাভি তরুণদের উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘ইসলামই হচ্ছে আমাদের জীবনে প্রথম ও শেষ আদর্শ। এতেই আশ্রয় নিতে হবে এবং এর থেকেই শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। ঈমান ও আমলে পরিপূর্ণ হয়ে সতর্ক হতে হবে, গোঁড়ামি ও বাড়াবাড়ি বর্জন করতে হবে এবং আন্দোলনে কোনো চরমপন্থা অবলম্বন করা যাবে না।’ কাজেই আমাদেরকে নেতৃত্বের যথাযথ আনুগত্য করে যেকোনো কঠিন অবস্থায় কর্মসূচি সফল করতে হবে।
চরম প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হবে : ইসলামের প্রতিটি সঙ্কটে বীর তরুণ-যুবকেরাই এগিয়ে এসেছেন। বুক ফুলিয়ে গর্দান উঁচিয়ে অভিযানে বের হয়েছেন। জীবনের মায়া তুচ্ছ করে মহাসমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ইসলামের যুদ্ধগুলোতে বেশির ভাগ সেনাপতিই ছিলেন যুবক। হজরত আলী রা:, উসামা বিন জায়েদ রা:, খালিদ বিন ওয়ালিদ রা:, তারেক বিন জিয়াদ রা:, মুসা বিন নুসাইর রা:, ওকবা বিন নাফে রা:, সালাহ উদ্দিন আইয়ুবি রহ:, মুহাম্মদ বিন কাসিম, বখতিয়ার খিলজী রহ:রাই ঊষর মরুর ধূসর দিগন্ত পাড়ি দিয়েছেন, বিজয় নিশান ছিনিয়ে এনেছেন। শৌর্যবীর্যে অবাক করে দিয়েছেন সমকালীন পৃথিবীকে। ফলে নতুন এক সভ্যতার জন্ম হয়েছিল। তাই আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সর্বপ্রকার ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে সফলতার দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে নিতে যুবকদের অনুপ্রাণিত করতে সাইয়্যেদ আবুল আ’লা রহ: বলেছেন, ‘এ কাজের জন্য এমন একদল দুঃসাহসী যুবকের প্রয়োজন, যারা সত্যের প্রতি ঈমান এনে তার ওপর পাহাড়ের মতো অটল থাকবে। অন্য কোনো দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে না। পৃথিবীতে যা-ই ঘটুক না কেন, তারা নিজেদের ল্য-উদ্দেশ্যের পথ থেকে এক ইঞ্চিও বিচ্যুত হবে না।’
হে তরুণ, হে যুবক; মনে রাখবেন, রাত যত গভীর হয়, ভোরের আলো তত দ্রুত ফুটে ওঠে। জুলুম-নির্যাতন যতই বাড়ে, জালিমের পতন ততই অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। অতএব জালিমের পতন অনিবার্য।= সমাপ্ত-