আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি এই দুনিয়া। কুদরতের মহান নিদর্শন প্রকাশ পেয়েছে তার সুনিপুণ সৃষ্টিতে। সে কুদরতের ইশারায় সুসজ্জিত হয়েছে জগতের প্রতিটি বস্তু। মহান স্রষ্টা যাবতীয় উপকরণের সমাবেশ ঘটিয়েছেন সৃষ্টিকুলের জন্য। সৃষ্টির সজীবতা বাড়ার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থাই করা হয়েছে। সৃষ্টির ধারাক্রম বজায় রাখতে তিনি দান করেছেন প্রকৃতি। আবহাওয়া, জলবায়ু, দিন-রাত্রি এসব কিছুই প্রাকৃতিক উপাদান। তার ইচ্ছানুযায়ী স্বাভাবিক গতিতে চলছে দুনিয়ার সব কিছু। তিনি যেভাবে নির্দেশ করেছেন সেভাবেই সব কিছু সম্পাদিত হচ্ছে। প্রকৃতিও তার আয়ত্তের বাইরে নয়। প্রকৃতি তার মহান সৃষ্টির ঐশী প্রজ্ঞার নিদর্শন। সৃষ্টি জগতের জন্য এটি একটি নিয়ামতও বটে।
প্রকৃতিতে আল্লাহ তায়ালা বৈচিত্র্য দান করেছেন যেন একঘেয়েমি ও একপেশে মনে না হয়। রাত-দিন, ঠাণ্ডা-গরম, আলো-অন্ধকার প্রভৃতি নানা অবস্থার সৃষ্টি করেছেন প্রকৃতিতে। প্রকৃতিতে এই বিচিত্রতা না থাকলে দুনিয়ার ভারসাম্য বজায় থাকত না। যেকোনো এক অবস্থা কখনো সুখকর নয়। অতিমাত্রায় কিছুই মঙ্গলজনক হয় না। পৃথিবীর গতিধারায় নিত্যনতুন অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার কারণে সৃষ্টিকুল তার জীবনের পরম সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে। দিন-রাত্রির যেমন পরিবর্তন ঘটে, তেমনি ঋতুরও পরিবর্তন হয়। আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির ফলে আবহাওয়া ও জলবায়ুতে ভিন্নতা দেখা দেয়। এ জন্য কোথাও ভীষণ ঠাণ্ডা আবার কোথাও প্রচণ্ড গরম বিরাজ করে। পৃথিবীর সব স্থানে একসাথে একই অবস্থা হয় না। এক মেরুতে ঠাণ্ডা থাকলে অপর মেরুতে থাকে গরম। একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যখন গরমে মানুষ অতিষ্ঠ, তখন ইউরোপীয় দেশগুলোতে ঠাণ্ডার কারণে জমে যাওয়ার অবস্থা হয়। তবে হয়তো আল্লাহর বিশেষ কৃপাদৃষ্টির কারণে আমাদের বাংলাদেশের প্রকৃতিটি খুবই সহনীয়। এখানে নাতিশীতোষ্ণ প্রকৃতি বিরাজ করে। অতিমাত্রায় শীত ও গরম পড়ে না কখনো। আবহাওয়ার পরিবর্তন অনুসারে আমাদের দেশের ঋতুকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোথাও এই ষড়ঋতুর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তবে স্বাভাবিকভাবে দু’টি ঋতুই আমাদের দেশে বেশি অনুভূত হয়ে থাকে গ্রীষ্ম ও শীতকালে। গ্রীষ্মকালে গরম আর শীতকালে ঠাণ্ডা বিরাজ করে। শীতকালে যেমন কিছু দিন অত্যন্ত ঠাণ্ডা অনুভূত হয়, তেমনি গ্রীষ্মকালে কিছু দিন প্রচণ্ড গরম লাগে। তবে অন্যান্য দেশের মতো প্রান্তিক অবস্থার সৃষ্টি হয় না।
বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য এ দুই মাস আমাদের গ্রীষ্মকাল। এ সময় সাধারণত তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। স্থানভেদে এর তারতম্য হয়। এ সময়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ দিন বড় থাকে। ভূপৃষ্ঠ অনেক সময় ধরে সূর্যের তাপ পায়। এতে জমিনের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থেকে কিছুটা বেড়ে যায়। ফলে প্রচণ্ড গরম পড়ে। বৃষ্টি না হলে এর পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। খরায় সব কিছু হাহাকার করতে থাকে। মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী গরমে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। দাবদাহের কারণে মানুষ প্রচণ্ড তৃষ্ণা ও কান্তি অনুভব করে। এতে মানুষের যে কষ্ট হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বৈজ্ঞানিকেরা এই অবস্থার জন্য আবহাওয়া পরিবর্তনের কথা বললেও এর ধর্মীয় একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। রাসূল সা: ইরশাদ করেন ‘জান্নাত ও জাহান্নাম বছরে দুইবার নিঃশ্বাস ফেলে। ওই সময় অধিক ঠাণ্ডা ও প্রচণ্ড গরম অনুভূত হয়। এ হাদিসের আলোকে এ কথা স্পষ্ট যে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অধিক ঠাণ্ডা কিংবা গরম জাহান্নামের নিঃশ্বাস। মূলত এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে জগদ্বাসীকে জাহান্নামের ভয়াবহতার কিঞ্চিৎ উপলব্ধি করানো। প্রকৃত জাহান্নামের অবস্থা এর চেয়েও হাজার গুণ বেশি। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ইরশাদ করেন ‘নিশ্চয়ই আসমান ও জমিন সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য।’ ঋতুর পরিবর্তনের মধ্যে জ্ঞানীরা নিরূপণ করতে পারেন সৃষ্টির প্রকৃতি। য়িষ্ণু জীবনের পরোক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে এতে। গ্রীষ্মের দাবদাহ যে পরবর্তী অনন্ত জীবনের ভয়াবহ অবস্থার সূক্ষ্ম ইঙ্গিত তা কেবল জ্ঞানীরাই অনুধাবন করতে পারেন। এর থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা জীবনের প্রবাহকে সঠিক পথে পরিচালনা করার পাথেয় সংগ্রহ করতে পারেন। এই সূক্ষ্ম ইঙ্গিতকে কাজে লাগাতে পারলে গ্রীষ্মের এই দাবদাহ আমাদের জীবনের জন্য শুভ বার্তাই বয়ে আনে।
অন্য দিকে গ্রীষ্মকাল আমাদের জীবনের জন্য বড় একট নিয়ামত হিসেবে গণ্য হতে পারে। কারণ, এই ঋতুকে বলা হয় ফলের ঋতু। নানা ধরনের ফলমূল উৎপন্ন হয় এই ঋতুতেই। জান্নাতি খাদ্য ফল মহান আল্লাহর দেয়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। এমন কোনো মানুষ পাওয়া দুষ্কর যিনি ফল পছন্দ করেন না। বৈচিত্র্যময় অসংখ্য ফলের ডালি আল্লাহ আমাদের জন্য দান করেছেন। আল কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে ‘তোমাদের জন্য খেজুর ও আঙ্গুর বাগান সৃষ্টি করেছি। তোমাদের জন্য প্রচুর ফল আছে এবং তোমরা তা থেকে আহার করো।’ আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামত এই ফলের বেশির ভাগই উৎপন্ন হয় গ্রীষ্মকালে। আর ফল পাকার জন্য রোদ ও গরমের খুবই প্রয়োজন। গরমের তীব্রতা বাড়লে ফলগুলোও দ্রুত পেকে যায়। মানুষের জন্য আল্লাহর নিয়ামত ত্বরান্বিত হয়। সে হিসেবে গ্রীষ্মের দাবদাহ আমাদের জীবনের জন্য রহমত বলেই গণ্য হবে। এ ঋতুর কারণেই আমরা রসে ভরা সুস্বাদু ফলের স্বাদ আস্বাদন করতে পারি।
আল্লাহ কোনো দিনকালকেই অভিশপ্ত করেননি। সাময়িক দৃষ্টিতে কোনো কোনো সময়কে আমাদের জীবনের জন্য অভিশাপ হিসেবে মনে হলেও এতে রহমত নিহিত। গ্রীষ্মের দাবদাহও সেগুলোর একটি ।