হুব্বে রাসূল, ইত্তেবায়ে রাসূল ও নুসরাতে রিসালাতুন্নবী (সা.)

হুব্বে রাসূল, ইত্তেবায়ে রাসূল ও নুস্রাতে রিসালাতুন্নবী (সা.)

হুব্বে রাসূল, ইত্তেবায়ে রাসূল ও নুস্রাতে রিসালাতুন্নবী (সা.)

পূর্বে প্রকাশিতের পর

হুব্বে রাসূল, ইত্তেবায়ে রাসূল ও নুসরাতে রিসালাতুন্নবী (সা.)

(দুই) ইত্তেবায়ে রাসূল (সা.)ঃ
“হে নবী! লোকদের বলে দাও, তোমরা যদি প্রকৃতই আল্লাহর প্রতি ভালবাসা পোষণ করে থাক তবে আমার ইত্তেবা-অনুসরণ করো”। (সূরা: আলে ইমরান- ৩১)

ইত্তেবা অর্থ: আভিধানিক অর্থে ইত্তেবা অর্থ হল; কারো পদচিহ্ন দেখে দেখে চলা। মান্য করা, আনুগত্য করা, মেনে চলা, আদেশ ও নিষেধ পালন করা। উপরন্ত কোন কর্তৃপক্ষের আদেশ অনুযায়ী কাজ করা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়।
শরিয়তের পরিভাষায় ইত্তেবা: দ্বীনের সকল বিষয় তথা ‘আক্বিদা-বিশ্বাস, কথা, কাজ, গ্রহণ-বর্জনসহ সর্বক্ষেত্রে রাসূলের পরিপূর্ণ অনুসরণ করাকে ইত্তেবা বলে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কাজটি যেভাবে করেছেন সেটি ঠিক সেভাবে করাই হল রাসূলের ইত্তেবা বা অনুসরণ। রাসূলের ইত্তেবা ছাড়া কোন ইবাদত শুদ্ধ হয় না। এ কারণেই ইবাদতের ক্ষেত্রে রাসূলের ইত্তেবার কোন বিকল্প নাই। কোন ইবাদত শুদ্ধ হওয়ার জন্য বা ইবাদতটি ইবাদত হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্য শর্ত হল, তার মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইত্তেবা পাওয়া যেতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতটি যেভাবে করেছেন সেভাবে আদায় করতে হবে এবং তার মধ্যে কোন প্রকার বিকৃতি বা কমবেশ করা চলবে না।

আজকের মুসলিম মিল্লাতের দুর্যোগের কারণ ও তা থেকে মুক্তি লাভ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ইত্তেবা বা অনুস্বরণের মধ্যেই নিহিত। ইত্তেবায়ে রাসূলের (সা.) অর্থ রাসূলের আখলাকের হুবহু অনুসরণ। নবী কারীম (সা.) এর অনুসরণের ক্ষেত্রে আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা বা দুনিয়ায় প্রচলিত নিয়মনীতি ও পরিস্থিতির কোন দোহাই পেশ করা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। তাঁর অনুসরণ জীবনের কোন একটি অংশে সীমিত নয়, নয় জীবনের কোন একটি ক্ষেত্রে বরং প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি বিষয়েই তিনিই একমাত্র অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। তাঁর মোকাবিলায় কোন বুজুর্গকে পেশ করা হবে পরম দৃষ্টতার নামান্তর। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঐ আল্লাহর কসম যার হাতে মুহাম্মদ এর জীবন, আজকে যদি তৌরাত বহনকারী নবী মুসা (আ:) আবির্ভূত হন আর তোমরা আমাকে বাদ দিয়ে তাঁর ইত্তেবা করতে, তবে নিশ্চয় তোমরা হেদায়েতের পথ থেকে গোমরাহ হয়ে যেতে’। (মুসনাদে আহমদ)
এ থেকে সুস্পষ্ট যে তাঁর ইত্তেবা বা অনুসরণের ক্ষেত্রে জামানার কোন অলি বা বুজুর্গ অথবা সম্মানিত কোন মুরব্বি বা আকাবারকে পেশ করার তো প্রশ্নই ওঠে না, যেখানে পূর্বেকার নবীদের পর্যন্তও ইত্তেবা করার কোন অবকাশ নাই। রাসূলুল্লাহকে (সা.) অনুসরণের ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম (রা) আমাদের কাছে উত্তম আদর্শ। রাসূলের (সা.) উপর ঈমান আনার পর তাঁকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোন শর্ত, কোন যুক্তি বা বুদ্ধি প্রয়োগ প্রকারান্তরে রিসালাত অস্বীকারেরই নামান্তর। এ অন্ধ ইত্তেবা শুধু রাসূলের জন্যই। আর সকল ক্ষেত্রে সকল প্রকার আনুগত্য ও অনুসরণ রাসূল (সা.) এর আনুগত্যেরই শর্তাধীন। এ ক্ষেত্রে কুরআনের বক্তব্য হলো: وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا রাসূল তোমাদের জন্য যা এনেছেন, বিনা শর্তে তোমরা তা গ্রহণ করো। আর তা থেকে বিরত থাক, যা তিনি নিষেধ করেছেন। (সূরা: হাশর-৭)
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর আনিত ব্যবস্থাকে বা কোন বিষয়ে আল্লাহর রাসূলের (সা.) ফায়সালাকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যারা ইতস্ততায় থাকে বা সম্পূর্ণ সন্তুষ্টির সাথে গ্রহণ করে না, আল্লাহ তাআলা সে সমস্ত দাবিদার মুসলমানদের ঈমানের দাবিকে অস্বীকার করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলছেন: فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا﴿٦٥﴾
‘না, হে রাসূল! আপনার রবের কসম, তারা কিছুতেই মুমিন হতে পারে না, যতক্ষণ না তারা তাদের পারস্পরিক মতভেদের বিষয় ও ব্যাপারসমূহে আপনাকে বিচারপতি মেনে নেবে, অতঃপর আপনার দেয়া ফায়সালা সম্পর্কে তারা নিজেদের অন্তরে রাখবে না বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ বরং তাঁর সম্মুখেই নিজেদের সুপর্দ করে দিবে সম্পূর্ণ আস্থা ও এতমিনানের সহিত।’ ( সূরা: নিসা ৬০)
আল্লাহ তা’আলা বলেন: “আর এটি তো আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এ গুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর”। (আল ইমরান-১৫৩)

ইমাম কুরতবী (রহ.) বলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত যাতে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রাসূলের ইত্তেবা করার আদেশ দিয়েছেন এবং তার পথের ইত্তেবা ছাড়া অন্য সব পথ পরিহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর আয়াতে সীরাতে মুস্তাকীম-এর অর্থ হল, আল্লাহর পথ যে পথের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে আহ্বান করেছেন। আর তা হল রাসূলের ইত্তেবা ও তার সুন্নাতের অনুসরণ। আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন:
فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (سورة النور ৬৩)
“অতএব যারা তার নির্দেশের বিরোধিতা করে, তারা যেন তাদের উপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব পৌঁছার ভয় করে। (সুরা নূর-৬৩) আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন: “সেই ব্যক্তিই ঈমানের স্বাদ পেয়েছে, যে রব হিসেবে আল্লাহকে, দ্বীন হিসেবে ইসলামকে এবং রাসূল হিসেবে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিয়েছে”। (মুসলিম)

(তিন) নুস্রাতে রিসালাতুন্নবী (সা.)ঃ
মুহাম্মদ (সা.) এর রিসালাত চিরঞ্জিব। পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর নবুওয়াত থাকবে। অথচ তিনি এ দীর্ঘ হায়াত নিয়ে এ পৃথিবীতে আসেন নি। কোন নবী রাসূলকে আল্লাহ তাআলা এমনভাবে সৃষ্টি করেন নি যে, তাদের আহার বিহারের প্রয়োজন হতোনা অথবা তাঁরা বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল ধরে। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে: তাদের আমি এমন কোন দেহ দেইনি যে তাঁদেরকে খেতে হতো না, অথচ তারা বেঁচে থাকবেন চিরকাল ধরে। (সুরা আম্বিয়া- ৮) হুজুরে পাক (সা.) এর ওফাতের পর আগামী দিনের পৃথিবীর কাছে মুহাম্মদ (সা.) এর নবুয়াতের মিশনকে পৌছে দেয়ার দায়িত্ব উম্মতে মুহাম্মদী (সা.) এর ওপর। এই দায়িত্বের কারনেই উম্মতে মুহাম্মদীকে (সা.) শ্রেষ্টত্ব দেয়া হয়েছে অপরাপর উম্মতগণের উপর। যে দ্বীন প্রতিষ্ঠার ময়দানে নবীজি (সা.) তিল্ তিল্ করে ব্যয় করলেন তাঁর নবুওয়াতী জীবন, হাজারো জুলুম নির্যাতন ভোগ করলেন অকাতেরে। বরদাস্ত করলেন অগনিত সাহাবীর শাহাদাতের বেদননা। সেই দ্বীনে হক্বকে বিজয়ী করার জন্য যদি আমরা নবী পাকের উম্মত হিসেবে সার্বক্ষনিকভাবে প্রস্তুত থাকি, এরই জন্যে উজার করে দিতে পারি আমাদের সমূহ সহায় সম্পদ, দূর্গম পথের সমস্ত নির্মমতা-নিষ্ঠুরতাকে অকুন্ঠ চিত্তে গ্রহণে সাহসী হই, বিলিয়ে দিতে পারি এ পথে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু আর দ্বীনে মুহাম্মদীকে (সা.) বিকৃত করার তামাম চক্রান্তকে জীবন দিয়ে রুখতে পারি, তবে নিঃসন্দেহে তাই হবে রিসালাতে মুহাম্মদী (সা.) এর ওপর সবচে বড় নুসরাত বা সাহায্য। আল্লাহতাআলা অবিশ্যই বেহেস্ত দেয়ার আগে তাঁর বান্দাদের দেখে নেবেন যে, তাঁর দ্বীনের ময়দানে কারা নবীজির সাহায্যকারী ছিলেন: শ্চিয়ই আল্লাহতাআলা অদৃশ্য থেকে দেখে নেবেন, তোমাদের মধ্যে কারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করেছিলে দ্বীনের ময়দানে; নিশ্চয় তিনি মহাশক্তিধর ও পরাক্রমশালী”। (সুরা হাদীদ- ২৫)
আমরা যদি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর রেসালাতকে সাহায্য করতে এগিয়ে না আসি, তবে আল্লাহতাআলা তার দ্বীনের প্রয়োজনে সাহায্য করার যোগ্যতা সম্পন্ন জাতিকে আমাদের স্থলে হাজির করবেন, আর আমরা এ দায়িত্ব পালনের অযোগ্য বলে প্রমানিত হবো এবং তারই পরিনামে দুনিয়ার জীবনে আমাদের জন্য থাকবে পরাধীণতার আযাব আর পরকালে কঠিন পীড়াদায়ক শাস্তি। কুরআন এ বিষয়ে ঘোষনা করছে: ‘যদি তোমরা নবীর সহযোগীতায় বের না হও, তবে তোমাদের জন্য রয়েছে কঠিন পীড়াদায়ক শাস্তি। আর তোমাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত করা হবে বিজাতীয় সম্প্রদায়কে। তোমরা আল্লাহর দ্বীনের কোন ক্ষতি করতে পারবে না; আল্লাহর ক্ষমতা তামাম সৃষ্টির ওপর ক্রিয়াশীল।’ (সুরা তাওবা- ৩৯)
নুসরাতে রিসালার ব্যাপারে আল্লাতাআলা তাঁর পয়গাম্বরকে আরো আশ্বাস দিয়ে বলেন: ‘যদি তোমরা তাকে সাহায্য না করো, তবে তাঁর সাহায্যের জন্য একা আল্লাহই যেেথষ্ট।’ (সুরা তাওবা- ৪০)

Related Post