পরহেযগারিতা বা আল্লাহভীরুতা দ্বীনের ভিত্তিসমূহের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। তাক্বওয়া ও পরহেযগারিতা ছাড়া ঈমান কখনোই পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। ঈমান হ’ল একটি বৃক্ষের ন্যায় আর পরহেযগারিতা হ’ল তার সৌন্দর্য। পানি যেমন কাপড় থেকে সকল প্রকার অপবিত্রতা দূর করে দেয়, পরহেযগারিতা তেমনি মানবাত্মাকে যাবতীয় মানবিক ব্যাধি হ’তে মুক্ত করে সুন্দর মানুষে পরিণত করে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে পরহেযগারিতার সংজ্ঞা, তা অবলম্বনের উপকারিতা এবং অর্জনের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।-
পরহেযগারিতার সংজ্ঞা :
আভিধানিক অর্থে বিরত থাকা, সংকোচ বোধ করা, হারাম থেকে বিরত থাকা, (বিশেষ অর্থে) হালাল ও মুবাহ বস্তু থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি।[লিসানুল ‘আরাব ৮/৩৮৮।]
পারিভাষিক অর্থে শরীফ জুরজানী বলেন, ‘দ্বীনদারী হ’ল, হারাম কর্মে লিপ্ত হওয়ার ভয়ে সন্দেহযুক্ত বিষয়সমূহ হ’তে বেঁচে থাকা’।[শরীফ জুরজানী]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘যে কাজ করলে আখেরাতে ক্ষতির আশংকা থাকে, তা পরিহার করাকে পরহেযগারিতা বলা হয়’।[ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ ]
ইবরাহীম ইবনে আদহাম বলেন, ‘পরহেযগারিতা হ’ল- সকল প্রকার সন্দেহযুক্ত বস্তু, অনর্থক কর্মকান্ড ও অতিরঞ্জিত কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকা’।[ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারেজুস সালেকীন ]
পরহেযগারিতার সংজ্ঞায় রাসূল (ছাঃ)-এর নিম্নোক্ত বাণীটি প্রণিধানযোগ্য। যেমন তিনি বলেছেন ‘ব্যক্তির ইসলামী সৌন্দর্য হ’ল, অনর্থক কর্মকান্ড পরিহার করা’।. ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪৮৩৯, সনদ ছহীহ।
পরহেযগারিতার স্তর সমূহ :
রাগেব ইস্পাহানী পরহেযগারিতাকে তিনটি স্তরে বিন্যাস করেছেন।-
(১) ওয়াজিব : সকল প্রকার হারাম থেকে বেঁচে থাকা। এ প্রকারের পরহেযগারিতা অর্জন করা সকল মানুষের উপর ওয়াজিব।
(২) মুস্তাহাব : সন্দেহপূর্ণ বস্ত্তসমূহ থেকে বেঁচে থাকা। মধ্যম স্তরের পরহেযগার ব্যক্তিদের জন্য এ স্তরটি প্রযোজ্য।
(৩) মাফযূল : অনেক মুবাহ এবং স্বল্প প্রয়োজনীয় বস্ত্ত সমূহ থেকেও বিরত থাকা। নবী-রাসূল, শহীদগণ এবং ছালেহ বান্দাদের জন্য এ স্তরটি প্রযোজ্য।[রাগেব ইস্পাহানী
পরহেযগারিতা অবলম্বনের গুরুত্ব ও মর্যাদা :
পরহেযগারিতা অবলম্বনের প্রভূত মর্যাদা সম্পর্কে বহু হাদীছে আলোকপাত করা হয়েছে। একদা রাসূল (ছাঃ) আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে পরহেযগারিতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়ে বলেন, َ ‘হে আবু হুরায়রা! তুমি পরহেযগার হও, তাহ’লে তুমি সকল মানুষের চেয়ে বড় ইবাদতকারীতে পরিণত হবে’।[ইবনু মাজাহ হা/৪২১৭, সনদ ছহীহ।
সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের সর্বোত্তম দ্বীন হ’ল পরহেযগারিতা’।[হাকেম, আলবানী, ছহীহ আত-তারগীব হা/৬৮।
রাসূল (ছাঃ) যেভাবে দ্বীনদারী অবলম্বনের উপরে গুরুত্ব দিয়েছেন, অনুরূপভাবে সালাফে ছালেহীনও দ্বীনদারী অবলম্বনের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁরা কথা ও কাজের মাধ্যমে মানুষকে তাক্বওয়া অর্জন ও দ্বীনদারী অবলম্বন করার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন। যেমন- ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
‘শেষ রাতে নড়াচড়া করা অর্থাৎ তাহাজ্জুদ পড়া বা যিকির- আযকার করা প্রকৃত দ্বীন নয়, বরং দ্বীন হ’ল, পরহেযগারিতা অবলম্বন করা’।[ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, যুহুদ
অর্থাৎ যারা নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ে। অথচ হারাম-হালালের মধ্যে কোন পার্থক্য করে না, মানুষের হকের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করে না, ন্যায়-অন্যায়ের মাঝে কোন বাছ-বিচার করে না, তারা কখনোই দ্বীনদার নয়। ক্বিয়ামতের কঠিন দিনে তাদের এরূপ আমল কোনই কাজে আসবে না।
হাসান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, সর্বোত্তম ইবাদত হ’ল, সর্বদা দ্বীনী চিন্তা-ভাবনা রাখা এবং পরহেযগারিতা অবলম্বন করা।[ইবনু আবীদ্দুনিয়া, আল-ওয়ার‘ঊ
অর্থাৎ যারা প্রতিটি কর্মে দ্বীনকে প্রাধান্য দেয় ও পরহেযগারিতা অবলম্বন করে, তাদের মধ্যে প্রকৃত মানবতা উদ্ভাসিত হয়। তখন তাদের মধ্যে আল্লাহর হক, মানুষের হক ও স্বীয় আত্মার হকের ব্যাপারে পূর্ণ দায়িত্ববোধ ও সচেতনতা সৃষ্টি হয়। মানুষের হক তারা নষ্ট করে না এবং আল্লাহ রাববুল আলামীনের হকও তারা যথাযথভাবে আদায় করে। তাদের দ্বারা কোন প্রকার অন্যায়-অত্যাচার সংঘটিত হয় না। সকল প্রকার হারাম থেকে তারা বিরত থাকে।
মুতাররিফ বিন শিখখীর বলেন, তোমরা দুইজন লোকের সাথে সাক্ষাৎ করলে দেখবে, একজন অনেক ছালাত ও ছিয়াম আদায় করে এবং বেশী বেশী আল্লাহর রাস্তায় দান করে। আর অপর ব্যক্তি যে বেশী ছালাত বা ছিয়াম আদায় করে না এবং বেশী বেশী ছাদাক্বাও করে না। সে তার থেকে উত্তম। তাকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, তা কিভাবে সম্ভব? তখন তিনি বললেন, লোকটি তার অপর ভাইয়ের তুলনায় আল্লাহর নিষেধকৃত বিষয় সমূহে অধিক সতর্ক ও পরহেযগার।[ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, আয-যুহ্দ, পৃঃ ১০৪]
এখানে একটি কথা স্পষ্ট হয়, শুধু ছালাত-ছিয়াম ও দান-ছাদাক্বা দিয়ে দ্বীনদার হওয়া যায় না। দ্বীনদার হওয়ার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই হারাম থেকে বেঁচে থাকতে হবে। হারাম থেকে বেঁচে থাকা নফল ইবাদত-বন্দেগী হ’তে অধিক যরূরী।
পরহেযগারিতা অবলম্বনের উপকারিতা :
পরহেযগারিতা দুনিয়া ও আখেরাতে ব্যাপক কল্যাণ বয়ে আনে। ইহজগতে মহান রাববুল আলামীন মানুষের মধ্যে তার এমন গ্রহণযোগ্যতা দান করেন, যার মাধ্যমে সে মানুষের ভালবাসার পাত্রে পরিণত হয়, যদিও তার জ্ঞান-বুদ্ধির ঘাটতি থাকে। আর আখেরাতে তার জন্য মহাপুরস্কার অপেক্ষা করে। যার বাস্তবতা আমরা সর্বদাই দেখে থাকি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى ‘অবশ্যই সে সাফল্য লাভ করবে, যে আত্মশুদ্ধি অর্জন করবে’ (আ‘লা ৮৭/১৪)।
১. অল্প আমলে অধিক ছওয়াব লাভ
ইউসুফ বিন আসবাত বলেন, অধিক আমল করার চাইতে স্বল্প পরহেযগারিতা অর্জন করাই যথেষ্ট।[আবু নাঈম ইস্পাহানী, এক ব্যক্তি আবু আব্দুর রহমান আল-আমেরীকে বলল, আপনি আমাকে উপদেশ দিন। উত্তরে তিনি মাটি থেকে একটি প্রস্তরখন্ড উঠিয়ে নিয়ে বললেন, এ প্রস্তরখন্ড পরিমাণ তাক্বওয়া তোমার অন্তরে প্রবেশ করা সমগ্র যমীনবাসীর ছালাত হ’তেও উত্তম।[. হিলয়াতুল আউলিয়া ৮/২৮৮।
অনেক মানুষ আছে যারা অধিক ইবাদত করে। কিন্তু তাদের ইবাদতে কোন খুলূছিয়াত নেই। তাদের এ ধরনের ইবাদত নিষ্ফল ও অকার্যকর। সুতরাং একথা স্মর্তব্য যে, শুধু অধিক ইবাদতই মানুষের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। বরং পরহেযগার ব্যক্তির ইখলাছপূর্ণ স্বল্প আমলই পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট।
২. সন্দেহযুক্ত বস্তু হ’তে বিরত থাকার সক্ষমতা অর্জন
পরহেযগারিতা মানুষকে সন্দেহপূর্ণ বস্ত্তসমূহ থেকে বিরত রাখে। আবু আব্দুল্লাহ আল-ইনতাকী বলেন, যে ভয় করে সে ধৈর্য ধারণ করে। আর যে ধৈর্য ধারণ করে সে পরহেযগারিতা অবলম্বন করে। আর যে পরহেযগারিতা অবলম্বন করে সে সন্দেহজনক বস্ত্ত থেকে বিরত থাকে।হিলয়াতুল আউলিয়া ৯/২৯০।
৩. দো‘আ কবুল হওয়া
পরহেযগারিতা দো‘আ কবুলের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়। মুহাম্মদ বিন ওয়াসে‘ বলেন, পরহেযগারিতার সাথে সামান্য দো‘আই যথেষ্ট। যেমন খাবারের সাথে সামান্য লবণই যথেষ্ট হয়। অর্থাৎ পরহেযগার ব্যক্তির সামান্য দো‘আই আল্লাহ তা‘আলা দ্রুত কবুল করেন।[বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/১১৪৯।
৪. ইলম অর্জনে বরকত
আল্লামা ছিদ্দীক হাসান খান কানৌজি (১৮৩২-১৮৯০ইং) বলেন, একজন আলেমের জন্য যরূরী হ’ল তাক্বওয়া ও পরহেযগারিতা অবলম্বন করা। যখন কোন আলেমের মধ্যে তাক্বওয়া বা পরহেযগারিতা থাকবে তখন তার ইলমের ফায়েদা ও উপকারিতা বেশী হবে।(শু‘আবুল ঈমান হা/১১৪৯]
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) তাঁর উস্তাদ ওয়াকী‘ যে উপদেশ দেন, তা নিম্নরূপ :
‘আমি আমার উস্তাদ ওয়াকী‘কে আমার দুর্বল মুখস্থ শক্তির বিষয়ে অভিযোগ করলে তিনি আমাকে পাপ বর্জনের উপদেশ দিলেন এবং বললেন, দ্বীনী ইলম হ’ল আল্লাহর নূর। আর আল্লাহর নূর কোন গোনাহগারকে দেওয়া হয় না’।
কেননা ইলম মহান প্রভু প্রদত্ত এক অমূল্য নূর সদৃশ। আর পাপ হ’ল অন্ধকারের ন্যায়। অন্ধকার এবং আলো কখনোই একসাথে অবস্থান করতে পারে না। তাই যখনই বান্দা ছোট-বড় সকল ধরনের পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়, তখনই তার হৃদয়ে ইলমের নূর প্রবেশ করে। যা দ্বারা সে নিজে উপকৃত হয় এবং অন্যকে উপকৃত করতে সক্ষম হয়।
৫. হক কবুলের মানসিকতা সৃষ্টি
সুফিয়ান ছাওরী বলেন, আমি যখনই কোন মানুষের নফসের চাহিদার বিরোধিতা করি, তখনই তাকে দেখতে পাই সে আমার উপর বিরক্ত হয়। আসলে বর্তমানে আলেম ও পরহেযগার লোকের খুব অভাব দেখা দিয়েছে।[হিলয়াতুল আউলিয়া ৭/১৯]
প্রকৃত আলেম বা পরহেযগার ব্যক্তিগণ কখনোই তাদের মতের বিরোধিতাকারীর উপর বিরক্ত হন না। বরং তাদের যদি কেউ উপদেশ দেয়, তাতে তারা খুশী হন এবং উপদেশ গ্রহণ করেন।
৬. আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন
আত্মার সংশোধন অত্যন্ত যরূরী বিষয়। আত্মার সংশোধন ছাড়া মানুষ কখনোই পরহেযগার হ’তে পারে না। আর যখন মানুষ পরহেযগার হবে না, তখন তাকে পদে পদে বিপদে পড়তে হবে। তবে মানুষ যখন পরহেযগার হয়, তখন সে অন্যের সংশোধনের পূর্বে নিজের সংশোধনে অধিক সচেষ্ট হয়। একজন মানুষের পরহেযগারিতা তার নিজের দোষ-ত্রুটি সংশোধনের কারণ হয়ে থাকে। মানুষ যখন পরহেযগার হয়, তার মধ্যে কোনরূপ হিংসা-বিদ্বেষ ও অহংকার থাকে না। ইবরাহীম বিন দাঊদ বলেন,
‘যদি কোন মানুষ জ্ঞানী ও মুত্তাক্বী হয়, তার তাক্বওয়া তাকে মানুষের দোষ-ত্রুটি নিয়ে মন্তব্য বা সমালোচনা করা হ’তে বোবা বানিয়ে দেয়। যেমন একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে তার ব্যথা-বেদনা অন্যান্য লোকের ব্যথা-বেদনা নিয়ে চিন্তা করা হ’তে বিরত রাখে।. আল-ওয়ারঊ হা/২১৮, পৃঃ ১২৩।
পরহেযগার ব্যক্তি সব সময় তার নিজের ভুল-ত্রুটি নিয়ে চিন্তিত থাকে। নিজেকে সঠিক ও সৎ পথে পরিচালনার জন্য ব্যস্ত থাকে। ফলে অন্যের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণের সুযোগ সে খুব কমই পেয়ে থাকে।
৭. চারিত্রিক মাধুর্য বৃদ্ধি :
উত্তম চরিত্র এক অমূল্য মানবীয় সম্পদ। উত্তম চরিত্র মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতে চূড়ান্ত মর্যাদা ও সফলতার দুয়ার খুলে দেয়। মানুষের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। মানুষ তাকে তাদের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে। আর এ গুণ অর্জনের জন্য পরহেযগারিতার কোন বিকল্প নেই।
আব্দুল করীম আল-জাযারী বলেন, একজন পরহেযগার ব্যক্তি কখনোই ঝগড়া-বিবাদ করে না। তারা মানুষের সাথে সুন্দর ব্যবহার করে।[শু‘আবুল ঈমান হা/৮১২৯।]
কোন সমাজে একজন পরহেযগার লোক থাকলে সে মানুষের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়। লোকেরা তার কাছে বুদ্ধি-পরামর্শের জন্য যায়। বিপদ-আপদে তার থেকে পরামর্শ গ্রহণ করে। যাবতীয় গোপন বিষয় তার কাছে বলে। দুঃখ-দুর্দশা ও হতাশার সময় তার কাছে এসে সান্ত্বনা পায়।
৮. দুনিয়া ও আখেরাতের সৌভাগ্য অর্জন
পরহেযগার ব্যক্তি দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা অর্জন করে। ফুযায়েল বিন আয়ায বলেন, পাঁচটি বিষয় সৌভাগ্য লাভের কারণ : অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস, দ্বীনি ব্যাপারে পরহেযগারিতা, দুনিয়া বিমুখতা, লজ্জাশীলতা এবং জ্ঞান।[হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/২১৬