মৃত্যু সর্বকালে সবার জন্যই কষ্টকর। এতে দেশ, অঞ্চল, ভাষা ও রঙের কোনো পার্থক্য নেই। একজন মানুষ তার প্রিয়জনদের রেখে অজানা-অচেনা দেশে চলে যাওয়া কতটা বেদনাদায়ক, একমাত্র ভুক্তভোগীরাই তা হাড়ে হাড়ে অনুধাবন করতে পারে। এ মর্মন্তুদ যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ কারোই নেই। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, পিতা-পুত্রের আদর-সোহাগ, ভাই-ভাইয়ের ¯-মমতা যেন বিলীন হয়ে যায় মুহূর্তেই। বিধাতার এ অমোঘ বিধানকে মেনে নিয়ে সবাইকে বিদায় নিতেই হয় এ ধরাপৃষ্ঠ থেকে। যারা চলে যান তাদের জন্য কী করণীয় রয়েছে তাদের আত্মীয়দের, তারা কি আজীবনই শোক পালন করবে, মাতম করবে? নাকি প্রতি বছর মৃত্যুর তারিখ ফিরে এলে কিছু দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করবে, কিছু মিষ্টি বিতরণ করে শেষ করে দেবে। আর বড় মাপের লোক হলে আলোচনা সভা করে কাঙালিভোজ করে দিবসটি পালন করবে ।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, ইসলামেও শোক পালনের নির্দিষ্ট নিয়মনীতি রয়েছে। তা হলো কেউ মারা গেলে শোক পালন করবে তিন দিন। তিন দিন পরে শোক পালনের কোনো সুযোগ নেই, বরং চতুর্থ দিন থেকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে, তবে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী চার মাস দশ দিন অথবা গর্ভস্থিত সন্তান (যদি থাকে) প্রসব হওয়া পর্যন্ত শোক পালন করবে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : ‘কোনো মহিলা যে আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাস করে, সে যেন তিন দিনের অতিরিক্ত শোক পালন না করে, তবে স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে। (বুখারি, মুসলিম)। অতএব ইসলামের বিধান হলো কেউই তিন দিনের অতিরিক্ত শোক পালন করবে না। শুধু মহিলারা স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন অথবা সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত শোক পালন করবেন ।
ইসলামে মৃত্যুর চতুর্থ দিনে কুলখানি করা এবং চল্লিশতম দিবসে চেহলাম করার কোনো বিধান নেই। এমনিভাবে মৃত্যু দিবস পালন করা, মৃত্যু দিবস উপলক্ষে দোয়া ও মিলাদের বিশেষ আয়োজন করা, নতুন করে আবার শোক দিবস পালন করা ইসলামে নেই। মৃত ব্যক্তিদের ব্যাপারে যা করণীয় ইসলামে রয়েছে তা হলো, সব সময়ই তাদের জন্য দোয়া করা। এর জন্য কোনো দিনক্ষণ ঠিক করার প্রয়োজন নেই। যেকোনো সময়ই দোয়া করতে পারবে। তবে বিশেষ করে যে সময় দোয়া কবুলের কথা হাদিসে রয়েছে, সে সময়ে নিজের জন্য, জীবিত-মৃত সবার জন্যই দোয়া করতে ভুলে যাবেন না। সে সময়গুলো হলো : রাতের শেষাংশে যখন আল্লাহ প্রথম আকাশে অবতরণ করে বান্দাদের ডাকতে থাকেন কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি যাকে আমি ক্ষমা করে দেবো, কোনো বিপদগ্রস্ত আছে কি যাকে আমি বিপদ থেকে উদ্ধার করব? এমনিভাবে আল্লাহ বান্দাদেরকে ডাকতে থাকেন। আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়, নামাজের সালাম ফিরানোর আগে, সিজদারত অবস্থায়, দোয়া কুনুতের সময়, জুমার দিবসে আসরের পর সূর্যাস্তের আগে, ইফতারের আগে, সফর অবস্থায়, বায়তুল্লাহ তাওয়াফের সময়, মাকামে ইব্রাহিমের নামাজের পর, ছাফা-মারওয়া সায়ির সময়, আরাফায় অবস্থানের সময়, মুজদালিফায়, মিনায়, প্রথম ও দ্বিতীয় শয়তানকে কঙ্কর মারার পর। এ সময়গুলো বিশেষ করে দোয়া কবুলের সময়। এ ছাড়া অন্যান্য সময়ে দোয়া কবুল হবে না, এমনটি নয়; বরং সব সময় দোয়া কবুলের আশা রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন : ‘তোমরা আমাকে ডাকো। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো।’ (সূরা গাফির৬০ )
আল্লাহ আরো বলেন, ‘আমার বান্দা যখন আমার সম্পর্কে প্রশ্ন করে (আমি দূরে কি নিকটে) আমি অতি নিকটে। যখনই কেউ আমাকে ডাকে, আমি সে ডাকে সাড়া দিই (সূরা বাকারা১৬৮)
নিজের আত্মীয়স্বজনের জন্য অন্যের নিকট দোয়া চাওয়া যেতে পারে। তবে নিজে দোয়া করাই অধিক উত্তম। বিশেষ করে পিতামাতার জন্য সন্তান সব সময়ই দোয়া করবে। রাসূলুল্লাহ সা:কে জনৈক সাহাবি প্রশ্ন করলেন হে আল্লাহর রাসূল, পিতামাতার মৃত্যুর পর তাদের প্রতি সন্তানের আর কিছু করণীয় আছে কি? রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, হ্যাঁ, তাদের প্রতি চারটি করণীয় অবশিষ্ট থাকে ১. তাদের জন্য সব সময় দোয়া করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা, ২. তাদের ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা, ৩. তাদের মাধ্যমে যাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তাদের সাথে আত্মীয়তার সুসম্পর্ক বজায় রাখা, ৪. তাদের বন্ধুদের সম্মান করা। (আবু দাউদ)। আবার টাকার বিনিময়ে কারি বা হাফেজ ভাড়া করে কুরআন খতম করে দোয়া কারার বিধানও ইসলামে নেই। মোটকথা মৃতব্যক্তির জন্য শোক পালনের প্রথা পূর্বোল্লিখিত নিয়মের বাইরে ইসলামে আর কোনো নিয়ম নেই। দোয়া করার বিধান সব সময়ই রয়েছে, কোনো দিবসকেন্দ্রিক নয়। অতএব মুসলিম হিসেবে ইসলামের বিধান মেনে চলা আমাদের কর্তব্য। শোক পালনের বেলায় ইসলামের নির্দেশিত পথেই শোক পালন করা উচিত। সমাপ্ত ,