পবিত্র মাহে রমযান আসে মানুষের নৈতিক উন্নতি, চারিত্রিক দৃঢ়তা, শারীরিক সুস্থতা ও সামাজিক সাম্য ও শান্তির বার্তানিয়ে। তাকওয়া, ধৈর্য, ত্যাগ, সাধনা, মানব প্রেম, স্বচ্ছ চিন্তা প্রভৃতি নৈতিক গুণাবলীর বিকাশ সাধনের শিক্ষা দেয় এ রমযান। মানব সমাজে কেবল অস্ত্র-সস্ত্র, কলাকৌশল প্রভৃতি বস্তুগত উন্নতি কাঙ্খিত শান্তি ও সুখ আনতে পারেনি, পারবেও না। বরং এসব বস্তুগত উন্নতির সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ও সদ্ব্যবহারের জন্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি। যার দ্বারা পার্থিব যাবতীয় উন্নতি মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করার পরিবর্তে মানবতার খেদমতেই নিয়োজিত হবে। আজকের পৃথিবীতে নৈতিক চরিত্রের অভাবেই মানুষের হাতের তৈরি মারণাস্ত্র গোটা মানব সভ্যতার জন্য মৃত্যু পরওয়ানা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একমাত্র নৈতিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। এরই গুণে তারা দুনিয়াতে আল্লাহ্র খেলাফত তথা প্রতিনিধিত্বের মর্যাদার অধিকারী। আর যখন তা খুয়ে বসে মানুষ তখন হয়ে যায় অপরাপর জানোয়ারের ন্যায়; বরং তার চাইতেও অধম। কুরআন মজীদে আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘আমি তো বহু জ্বিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের অন্তর আছে, কিন্তু তার দ্বারা তারা উপলদ্ধি করে না। তাদের চক্ষু আছে, তার দ্বারা তারা দেখে না এবং তাদের কর্ণ আছে, তার দ্বারা শ্রবণ করে না। এরা চতুস্পদ জন্তুর ন্যায়, বরং তার চেয়েও অধিক বিভ্রান্ত। তারাই হল গাফেল। (সূরা আরাফ : ১৭৯)
মানুষকে পশুত্বের এ হীন স্তর থেকে আশরাফুল মাখলুকাতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন করানোর জন্যই প্রতি বছর আসে মাহে রমযান। রমযান কী ভাবে মানুষের জীবনে নৈতিক চরিত্রের বিকাশ সাধন করে এখানে তা আলোচনা করতে চাই।
প্রত্যহ সূবহে সাদেক হতে সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ্ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাবতীয় পানাহার ও স্ত্রী-সহবাস হতে বিরত থাকার নাম রোযা। এ সময় ক্ষুধা পিপাসার অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও রোযাদার আল্লাহ্র ভয়ে খায় না এক মুঠো খাবার অথবা এক চুমুক পানি। প্রাণপ্রিয়া স্ত্রী পাশে থাকা সত্তে¦ও তাকে পেতে চায় না আল্লাহ্র ভয়ে। এভাবে লোভ-লালসা ও যৌন উত্তেজনা, যেগুলো প্রধানত মানুষকে গোমরাহীতে নিয়ে যায় এবং সমাজে যাবতীয় অশান্তির জন্ম দেয়, তার সাথে রোযাদারের সংগ্রাম চলে এক মাসকাল। এ কৃচ্ছ সাধনা ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষ নিজের প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। দেহ পরিচালিত হয় নৈতিক চরিত্র ও বিবেকের পথ-নিন্দেশ মোতাবেক। এভাবেই মানব দেহের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় আল্লাহ্র রাজত্ব।
সারাদিন রোযার উপবাসে ক্ষুধার যন্ত্রণা। এরপর ইফতারের সময় যে সামান্যটুকু খাবার সামনে নিল তাও একা নিজে খেয়ে উদরপƒর্তি করল না রোযাদার। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের হাদীস এসে মনের মীনারায় আযান দিল:“যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে তা সে ব্যক্তির গোনাহের ক্ষমা ও দোযখ হতে মুক্তি লাভের সম্বল হবে এবং তাকে ওই রোযাদারের রোযার সমতুল্য অতিরিক্ত সওয়াব দেওয়া হবে।” (সহীহ ইবনে খুযায়মা ও বায়হাকী)
এ অফুরন্ত সওয়াবের বাসনায় রোযাদার দিন শেষের সামান্যটুকু খাবারে অপর রোযাদার ভাইকে নিয়ে মিলেমিশে ইফতার করল। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, প্রেমপ্রীতি, ভালবাসা ও সহযোগিতার এ অনুশীলন সত্যিই অপূর্ব। যারা সমাজের ওপর তলার কর্তা, তারাও রমযানে উপোস থেকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় অনাহার-উপবাসের কি করুণ যন্ত্রণা। তাই তারা নিজের সঞ্চিত অর্থের একটি অংশ যাকাত হিসাবে বিতরণ করে গরীবদের মাঝে। রমযান শেষ হতেই তারা ফিতরা দিয়ে দেয় অভাবী লোকদের হাতে। আর সে যাকাত-ফিতরায় গরীবদের সংসারে ফিরে আসে স্বচ্ছলতা। ধনীর ধনের প্রতি হিংসা আক্রোশের পরিবর্তে গরীবদের মনে জাগ্রত হয় শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার ভাবধারা। আল্লাহ্র ওয়াস্তে নিঃস্বার্থ দান করে ধনীরাও পায় অনাবিল তৃপ্তি। এমনি করে মাহে রমযানে ধনী ও গরীবের মাঝে মমত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার অনুশীলন হয়।
দুনিয়ার সর্বত্র আজ ধনী-গরীবে শ্রেণী সংগ্রাম, হানাহানি, রক্তপাত চলছে। সমাজের একদিকে পুঁজিপতিদের স্বর্গসৌধ, অন্যদিকে সেই সৌধের প্রাচীর ঘেঁষে অনাহার-ক্লিষ্ট দরিদ্র মানুষের নিরন্ন মিছিল। এক্ষেত্রে রমযানুল মোবারকের আদর্শই এই শ্রেণী সংগ্রাম, সর্বহারা আর পুঁজিপতির আকাশ-পাতাল ব্যবধান দূর করে সমাজে সাম্য ও শান্তি¥ধারা নামাতে পারে। রমযানের পর ঈদের দিনে আমরা সাম্য মৈত্রির সেই শান্তিময় সমাজ ব্যবস্থারই প্রদর্শনী দেখতে পাই প্রতিটি মুমিনের ঘরে ঘরে আর ঈদের ময়দানে।
সন্ধ্যায় ইফতারের পর ক্ষুধা-তেষ্টার যন্ত্রণায় ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর যখন বিছানায় মিশে যেতে চায় তখনই তাগাদা আসে তারাবীহ্ নামাযের। এবার যুবক, বৃদ্ধ, কিশোর মিলে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারাবীহ্ নামায আদায় করে শহর মহল্লার মসজিদসমূহে। তারাবীহ্র পর একটু বিশ্রামের জন্য যেই না নিদ্রামগ্ন হয় আবার শেষ রাতে সেহ্রী খাওয়ার সাড়া পড়ে সারা পাড়া, মহল্লা, গ্রাম, শহর জুড়ে। রাতের আঁধারে আল্লাহ্র ইবাদতের প্রস্তুতি গ্রহণের এ উৎসব, এ আয়োজন সত্যিই অপূর্ব। বাস্তবিকই রমযানে এহেন কর্মব্যস্ততা আর তৎপরতা মানুষের যাবতীয় অলসতা-বিলাসিতা দূর করে দেয়। নিত্য-নতুন কর্মচাঞ্চল্য ও কর্ম ব্যস্ততায় উজ্জীবিত করে রোযাদারকে। প্রত্যেকের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় সুষ্ঠু নিয়ম শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সর্বসম্মত মত, মানুষ যখন রমযান মাসে সারাদিন উপবাস থাকে তখন তাদের পেট থেকে দীর্ঘ এগার মাসের পুঞ্জীভূত ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে বেরিয়ে যায়। বছরের দীর্ঘ এগার মাস একটানা খাঁটুনীর পর মানব দেহের পরিপাক যন্ত্র রমযানের এক মাসে বিশ্রাম গ্রহণ ও ওয়েলিং এর সুযোগ লাভ করে। ফলে মানুষের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার মূলকেন্দ্র পাকস্থলী পাক-সাফ হয়ে মানুষ স্বাস্থ্য, মনোবল ও স্বচ্ছ চিন্তাধারার অধিকারী হয়।
বস্তুত: মাহে রমযান হচ্ছে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, আত্মগঠন ও সামাজিক উন্নতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার এক মাসের ট্রেনিং কোর্স। কিন্তু মুসলমানরা নিছক ট্রেনিং এর মনোভাব নিয়ে এ রোযা ব্রত পালন করেন না। বরং আল্লাহ্র ইবাদত হিসেবে এবং তাঁরই সন্তুষ্টি লাভের অদম্য আগ্রহে সব কিছুকে বরণ করেন। রোযাদারের মনে সারাক্ষণ জাগরুক থাকে আল্লাহ্র ভয় ও আখেরাতে আল্লাহ্র অফুরান প্রতিদান লাভের বাসনা। এজন্য রোযার প্রধান শর্ত হচ্ছে, পানাহার ও স্ত্রী সহবাস ত্যাগের সাথে সাথে আল্লাহ্র ইবাদত ও সওয়াবের নিয়ত করা। রোযার এ নিয়ত রোযাদারের মনে সঞ্চার করে এক দুর্জেয় শক্তি। আল্লাহ্র দাসত্ব ও খেলাফতের যথার্থ উপলব্ধি হাসিল করে রোযাদার এ নিরবচ্ছিন্ন সাধনার মধ্য দিয়ে।
আল্লাহ্র বান্দাদেরকে আজীবন আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধ পালনে অভ্যস্ত করে তুলে ত্রিশ দিনের এ সংগ্রাম। আল্লাহ্র ভয়, খেলাফতের দায়িত্বানুভূতি ও পরকালে জবাবদেহীতার জাগ্রত আতঙ্ক বদ্ধমূল হয় প্রত্যেকের অন্তরে। যে ব্যক্তি আল্লাহ্র নিন্দেশ পালনার্থে রমযানে নিজের হালাল খাবার ও হালাল স্ত্রীকে বর্জন করেছে পরবর্তী সময়ে সেই ব্যক্তি আল্লাহ্র আদেশ লংঘন করার সাহস পায় না-যদি সে বাস্তব উপলব্ধি নিয়ে রোযা রেখে থাকে। হাদীস শরীফে এ কথাই বুঝানো হয়েছে-
“যে ব্যক্তি রমযান মাসে ঈমান ও এহতেসাব (আত্ম বিশ্লেষণ)-সহকারে রোযা রাখে, তার পূর্ববর্তী সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়।” (বুখারী ও মুসলিম)এমনিভাবে রোযা সম্বন্ধে হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ্ পাক বলেন,“রোযা একমাত্র আমার জন্য এবং তার প্রতিদান আমি নিজ হাতে দেব।”(বুখারী ও মুসলিম)
দুনিয়ার যত অন্যায়-অবিচার বিশৃঙ্খলা, হত্যা, ধর্ষণ, যুলুম একমাত্র আল্লাহ্র প্রতি অবিশ্বাস ও আখেরাতের প্রতি ঔদাসিনতা তথা নাস্তক্যবাদেরই ফসল। রমযান এক্ষেত্রে সবক দেয় আল্লাহ্র ভয়, আত্ম-উপলব্ধি ও পরকালে জবাবদিহি হবার তীব্র অনুভূতি। যারা এমন অনুভুতি ও ট্রেনিং হিসেবে রোযা রাখেন,তাদের জন্য কোন গোয়েন্দা পুলিশ, সৈন্য সামন্ত অথবা দুর্নীতি দমন বিভাগের প্রয়োজন হয় না। তারা আল্লাহ্র ভয়ে নিজে নিজেই সংযত হয়ে যায়। আদর্শ নাগরিক, সোনার মানুষ, আল্লাহ্র প্রতিনিধি, দ্বীনের মুজাহিদ প্রভৃতি যে কোন উপাধিই প্রযোজ্য হয় তখন তাদের জন্য। মূলত এ জন্যই আল্লাহ্ পাক ফরয করেছেন রমযানের রোযা। কুরআন মজিদ বলে-“হে ঈমানদারগণ তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যাতে তোমরা মুত্তাকী-সংযমী হতে পার।”-(সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)
রোযাদারের সামগ্রিক জীবনে যদি রোযার এ নৈতিক সামাজিক শিক্ষার কোন প্রতিফলন না ঘটে, তাহলে আল্লাহর কাছে সে রোযার কোন মূল্য হয় না। আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন :”হযরত আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে রোযাদার অন্যায় অশ্লীল কথাবার্তা ও পাপাচার ত্যাগ করে না, তার পানাহার ত্যাগ করে উপবাস থাকাতে আল্লাহ্র কোন প্রয়োজন নেই।”(মুসনাদে আহমদ, সহীহুল বুখারী, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ)
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে পবিত্র মাসে রমযানের রোযাগুলো সঠিকভাবে রাখার তাওফীক দান করুন। আমীন