তার আসল নাম তমাযুর, কিন্তু চপলতা-চঞ্চলতা, প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতা আর সৌন্দর্যের কারণে খানসা লকবে তাকে স্মরণ করা হয়। খানসা অর্থ মাদি হরিণ। তার নামের চেয়ে লকব বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তিনি ছিলেন নজদ-এর অধিবাসী। তার পিতার নাম আমর ইবনুশ শারীদ, ইবনে রবাহ ইবনে ইয়াকযা ইবনে আছিয়্যা ইবনে খফাফ ইবনে ইমরাউল কায়েস। তিনি কায়েস কবীলার সলীম খান্দানের উত্তরসূরী ছিলেন। সালীম খান্দানের রাওয়াহা ইবনে আবদুল আযীয সালমার সাথে তার প্রথম বিয়ে হয়। প্রথম স্বামীর ঔরসে এক পুত্র সন্তান আবদুল্লাহ এবং দ্বিতীয় স্বামীর ঔরসে দু’পুত্র ইয়াযীদ ও মু’আবিয়া এবং এক কন্যা ওমরা জন্ম গ্রহণ করেন। মক্কার আকাশে রেসালাতের সূর্য উদিত হয়ে চারিদিকে আলোর আভা বিকিরণ করলে হযরত খানসার চক্ষুও সে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্যের সাথে তিনিও মদীনায় নবীজীর দরবারে হাযির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত (সা.) দীর্ঘক্ষণ তার কবিতা শুনেন এবং তার কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ ও বিমোহিত হন। প্রথম জীবন তিনি মাঝেমধ্যে দু’একটি কবিতা রচন করেন। কিন্তু বনু আসাদ গোত্রের যুদ্ধে তার আপন ভাই মুআবিয়া নিহত হন। এ যুদ্ধে তার এক বৈপিতৃক ভাই ছখর বনু আসাদ গোত্রের আবূ সওর এর হাতে আহত হয়। তিনি দীর্ঘ এক বছর ধরে এ ভাইয়ের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সুস্থ হননি। প্রিয় বোনকে বিয়োগ ব্যথায় ব্যথিত করে অবশেষে তিনি পরপারের পথে যাত্রা করেন। হযরত খানসা উভয় ভাইকেই অতি ভালোবাসতেন। কিন্তু জ্ঞান, ধৈর্য বদান্যতা, বীরত্ব, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা এবং সৌন্দর্য ইত্যাদির কারণে ছখরকে তিনি বেশি ভালোবাসতেন। এ কারণে ভাই ছখর এর মৃত্যুতে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং তখন থেকে ভাইয়ের শোকগাথায় অনবদ্য কবিতা রচনা শুরু করেন। এসব মরসিয়া বা শোকগাথায় দুঃখ-ব্যথা-বেদনা তিনি এমন হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ব্যক্ত করেন যে, তা শুনে লোকেরা অস্থির হয়ে ওঠতো এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়তো। এখানে তার মর্সিয়ার কয়েকটি শ্লোক এর বাংলা অনুবাদ উল্লেখ করা হচ্ছে। এসব শ্লোকে তার কাব্য প্রতিভা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব বিধৃত ঃ
হে মোর চক্ষদ্বয়! বদান্যতা অবলম্বন করো, কার্পন্য করো না।
ছখর এর মতো দানশীলের জন্য তোমরা কি রোদন করনা।
তোমরা কি রোদন করনা তার জন্য,
যে ছিল সাহসী এবং সুন্দর।
যে ছিল যুব নেতা, তোমরা কি তার জন্য কাঁদবে না?
যার বংশ মর্যাদা ছিল সুউচ্চ আর সে নিজেও ছিল দীর্ঘকায়।
যখন তার দাড়ি-গোফ গজায়নি,
তখনই সে গোত্রের নেতা হয়েছিল।
জাতি যখন মর্যাদায় দিকে হাত প্রসারিত করে, তখন সেও হাত বাড়ায়।
সে এমন মর্যাদায় পৌঁছে, যা ছিল অন্যদের হাতে অনেক ঊর্ধ্বে।
এমন সৌভাগ্য নিয়েই সে তিরোহিত হয়।
তুমি দেখবে, শ্রেষ্ঠত্ব তার ঘরের পথ দেখায়।
প্রশংসিত হওয়াতেই সে মনে করতো সবচেয়ে বড় মর্যাদা।
ইজ্জত-শরাফত আলোচিত হলে তুমি দেখবে যে,
ইজ্জতের চাদরে সে আবৃত।
আরবের নারীদের অভ্যাস অনুযায়ী হযরত খানসা সকাল-সন্ধা তার নিহত ভাইয়ের কবরে বসে তাকে স্মরণ করে কাঁদতেন এবং মর্সিয়া পড়তেন।
ছখর! তুমি আমার চক্ষুকে কাঁদিয়েছ। তাতে কি?
তুমিতো দীর্ঘদিন হাসিয়েও ছিলে মোরে।
যেসব নারী চিৎকার করে রোদন করে,
তাদের সাথে আমিও রোদন করছি।
আর আমিতো তাদের মধ্যে বেশি হকদার,
যারা চিৎকার করে।
তোমাকে দিয়ে আমি অনেক বিপদ কাটিয়েছি,
যখন তুমি বেঁচে ছিলে
কিন্তু এখন কে এসব বড় বিপদ ঠেকাবে?
যখন কোন নিহত ব্যক্তির জন্য ক্রন্দন
করাবে খারাপ মনে করা হয়,
তখন আমি তোমার জন্য ক্রন্দনকে অত্যন্ত সুন্দর মনে করি।
ছখর-এর মান-মর্যাদার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন ঃ
وَإِنَّ صَخراً لَتَأتَمَّ الهُداةُ بِهِ ** كَأَنَّهُ عَلَمٌ في رَأسِهِ نارُ
-বড় বড় লোকেরা ছখর এর আনুগত্য করে।
সে যেন এক পর্বত, যার চুড়ায় রয়েছে আগুন।
এসব মর্সিয়া বা শোকগাথার জন্যই তিনি গোটা আরবে খ্যাত হন। সব রকম কবিতা বিশেষ করে মর্সিয়া বা শোকগাথা রচনায় হযরত খানসা ছিলেন অনন্য। উসূদুল গাবাহ গ্রন্থের রচয়িতা লিখেন ঃ
اجمع أهل العلم بالشعر إنه لم تكن امرأة قبلها ولا بعدها أشعر منها.
-সকল কাব্য রসিক এ ব্যাপারে একমত যে, খানসার আগে বা পরে তার চেয়ে বড় মহিলা কবি আর কেউ ছিল না।
আদ-দুররুল মানসূর গ্রন্থে বলা হয়েছে ঃ
কবি জারীরকে (উমাইয়া যুগের প্রসিদ্ধ কবি মৃত্যু ১১০ হিজরী) জিজ্ঞেস করা হয়, সবচেয়ে বড় কবি কে? জবাবে বলেন, খানসা না হলে আমি হতাম সবচেয়ে বড় কবি। আরবের একজন বড় কবি বাশ্শার বলেন, নারীদের কবিতা বিশেষভাবে দেখলে তাতে কোন না কোন ত্রুটি বা দূর্বলাত অবশ্যই পাওয়া যায়। কেউ জিজ্ঞেস করেন, খানসার কবিতারও কি এদশা? জবাবে তিনি বলেন, তিনি তো পুরুষদের চেয়েও অগ্রসর। আরবের সকল কবি লায়লা আখীলিয়াকে মহিলা কবিদের শিরোমণি বলে স্বীকার করেন, কিন্তু তারাও খানসাকে ব্যতিক্রম বলে মনে করেন। জাহেলী যুগের সাধারণ নিয়ম ছিল যে, আরবের লোকেরা নানা স্থানে আসর জমিয়ে বসতো। তাদের এসব আসরের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের মধ্যে মত বিনিময় এবং কাব্য চর্চা। এসব কবিতা প্রতিযোগিতায় নারী-পুরুষ সমভাবে অংশ গ্রহণ করতো। এ আসর শুরু হতো রবিউল আউয়াল মাসে অর্থাৎ বসন্তকালের শুরুতে। আরবের দূর-দূরান্ত থেকে কাজ-কর্ম ছেড়ে লোকেরা ছুটে আসতো এসব আসরে অংশ গ্রহণ করার জন্য। রবিউল আউয়াল এর শুরুতে এই মেলা জমতো প্রথমে দুমাতুল জ্বন্দলে, সেখান থেকে আসতো হিজর-এর বাজারে, পরে ওম্মান এবং হাযরা মাওত এ গমন করতো। সেখান থেকেই ইয়ামান এর ছানআয়। এসব মেলা কোথাও দশ দিন, কোথাও ২০দিন স্থায়ী হতো। সারা দেশে মেলা শেষে জিলকদ মাসে সর্বশেষ মেলা বসতো ওকায বজারে। পবিত্র হজ্জকে সামনে রেখে মক্কার অদূরে অনুষ্ঠিত এ শেষ মেলায় আরবের সকল সর্দার-গোত্রপতিরা অবশ্যই যোগ দিতো। কোন কারণে কোন গোত্রপতি যোগ দিতে না পারলে তিনি প্রতিনিধি পাঠাতেন। এই শেষ মেলায় আরবদের সব বিষয় চূড়ান্ত করা হতো। অর্থাৎ এখানেই বিভিন্ন গোত্রের সর্দার নিয়োগ করা হতো, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা হতো, নিজেদের মধ্যকার রক্তপাত এবং যুদ্ধ-বিগ্রহের মীমাংসা হতো। ওকাযের এই মেলায়। কোরাইশ বংশের মান-মর্যাদা ছিল সবচেয়ে বেশি। সকল বিষয় নিষ্পত্তি হওয়ার পর প্রত্যেক কবীলার কবিরা নিজ নিজ কবিতা শুনাতেন। এসব কবিতায় থাকতো স্ব-স্ব গোত্রের বাহাদুরী, উদারাতা-দানশীলতা, অতিথি পরায়ণতা, পূর্ব পুরুষদের গুরুত্বপূর্ণ কীর্তিগাথা, শিকার এবং রক্তপাতের বর্ণনা। এখানেই কবি এবং বক্তার মর্যাদা নির্ণীত হতো।
মহিলা কবি খানসাও এসব আসর-মেলায় যোগ দিতেন। এসব আসরে পঠিত তার মর্সিয়া কাব্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলে স্বীকৃতি লাভ করতো। তিনি উটের পিঠে আরোহণ করে মেলায় উপস্থিত হলে কবিরা এসে তার চারিপাশে জড়ো হতো কবিতা শুনার জন্য। এরপর তিনি মর্সিয়া বা শোকগাথা শুনাতেন। তার তাঁবুর সামনে একটা পতাকায় লেখা থাকতো- العرب أرثى আরবের সবচেয়ে বড় শোকগাথা রচয়িতা। এমন গৌরব অন্য কোন কবির ভাগ্য জুটেনি।
জাহেলী যুগে অনেক বড় বড় কবি ছিলেন। নাবেগা যুব্ইয়ানী ছিলেন এসব নামকরা কবিদের একজন। কাব্যে পাণ্ডিত্যের জন্য চারিদিকে তার প্রচুর খ্যাতি ছিল। তার আসল নাম ছিল যিয়াদ ইবনে মু’আবিয়া। কুনিয়াত ছিল উমামা। আবূ ওবায়দা তার সম্পর্কে লিখেনঃ তিনি ছিলেন, প্রথম পর্যায়ের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য। বেশি কবিতা রচনার জন্য তার লকব বা উপাধী হয়েছে নাবেগা। ওকাযের মেলায় তার জন্য লাল তাবু টানানো হতো। অন্য কেউ এ গৌরব লাভ করতো না। কারণ এ গৌরব ছিল সে কবির হক, কবিতায় যিনি ছিলেন সর্বজন স্বীকৃত শিক্ষক। তার কবিতা ছিল সূক্ষ্ম তত্ত্ব সমৃদ্ধ। ছিল অপরূপ বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত। চরিত্রের পরিশুদ্ধিকে তিনি অত্যাবশ্যক মনে করতেন এবং আল্লাহ্র ভয়ে জীবন যাপনকে সর্বোত্তম বিবেচনা করতেন। উদারচিত্ত এ কবি নিজেই ছিলেন তার কথার প্রমাণ। তার প্রশংসাসূচক কাসীদার নৈপূণ্য, প্রফুল্লচিত্ততা, রকমারিত্ব, সততা এবং ভাষা অলংকারের অনেক দৃষ্টান্ত বর্তমান ছিল। ওকাযের মেলায় নাবেগার সামনে কবিতা আবৃত্তি করে কবিরা তার কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ করতো। খানসার কবিতা শুনে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে নাবেগা বলেনঃ
মূলত তুমি নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় কবি। আমি ইতোপূর্বে এ অন্ধ কবির কবিতা না শুনলে (অর্থাৎ আ’শার কবিতা) অবশ্যই তোমাকে এ যুগের সেরা কবি বলে আখ্যায়িত করতাম এবং বলতাম যে, তুমি সংস্কৃতিমনা অসংস্কৃতমনা সকল কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। দুনিয়ায় অনেক কবি ছিলেন, তারা অনেক নাম-কাম এবং যশোকীর্তিও অর্জন করেছেন। কিন্তু হাসসান ইবনে সাবিত যে ফযীলত-মর্যাদা লাভ করেছেন তা অন্য কোন কবির ভাগ্যে জুটেনি। যেসব কবি মহানবীর সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। কিন্তু আল্লাহ হযরত হাসসানকে যে মর্যাদা দিয়েছেন, তা আর কাউকে দেননি। তিনি ছিলেন হযরতের দরবারের কবি। জীবনের ৫৯টি বছর কুফরীর অন্ধকারে কাটিয়ে ৬০ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর তার সমস্ত কাব্য প্রতিভা নিয়োজিত করেন ইসলাম এবং মুসলমানদের খেদমতে। অধিকন্তু তার কাসীদায় থাকতো রাসূলের প্রশংসা, ইসলামের প্রশান্তি, কাফেরদের নিন্দা এবং মহানবীর যুদ্ধ-বিগ্রহের বর্ণনা। তার কবিতা ছিল সাদা-মাটা, লবণাক্ত এবং স্বচ্ছ-শুভ্র।
খানসা সম্পর্কে নাবেগার সিদ্ধান্তে তিনি অত্যন্ত মনক্ষুন্ন হন তিনি নাবেগাকে বলেন, তোমার ফয়সালা মোটেই ঠিক নয়। আমার কবিতা খানসার কবিতার চেয়ে উন্নতমানের। নাবেগার ইঙ্গিতে খানসা বললেন, আপনার শ্রেষ্ঠ কবিতা শুনান দেখি। অতঃপর আমি নিজে তার সমালোচনা করবো। হযরত হাসসান তার এ কবিতাটি শুনানঃ
. لَنا الجَفَناتُ الغُرُّ يلمعنَ بالضّحى ،, وأسيافنا يقطرنَ من نجدة ٍ دما.
আমাদের আছে বড় বড় বরতন, যা সূর্যালেকে চক চক করে।
আর আমাদের তরবারী অনেক উঁচু থেকে রক্ত জরায়।
হযরত হাসসান। তার এ কবিতায় বদান্যতা ও বীরত্বের পরিচয় তুলে ধরেন। তার এ কবিতার সমালোচনায় হযরত খানসা বলেন ঃ
ক. جفاف (জেফাফ) বহুবচনের শব্দ হলেও তাতে আধিক্য বুঝায় না, বরং এর স্থানে جفان (জেফান) বলা হলে অর্থ আরও ব্যাপক হতো।
খ. غر (গুররুন) বলা হয় চেহারার চাকচিক্যকে। بيض (বীযুন) এর চেয়ে ব্যাপক অর্থবোধক।
গ. يلمعن (ইয়ালামআন) বলা হয় কৃত্রিম চাকচিক্যকে। এর স্থলে يشرقن (ইউশরেকনা) বললে ভালো হতো। কারণ, ইশরাক লামআন এর চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী।
ঘ. ضحى (দুহা) -এর পরিবর্তে دجى (দুজা) বললে ভালো হতো। কারণ অন্ধকারে আলোর মূল্য বেশি হয়।
ঙ. اسياف(আসইয়াফ) বহু বচনের শব্দ হলেও তাতে প্রাচুর্য বুঝায় না। এর স্থলে سيوف (সুয়ুফ) শব্দ ব্যবহার করা অধিক যুক্তিযুক্ত ছিল।
চ. يقطرن(ইয়াকতুরনা) এর পরিবর্তে يسلن (ইয়াসেলনা) শব্দ ব্যাপক অর্থবোধক। কারণ, বিন্দু বিন্দু রক্তের প্রবাহ অধিক ক্রিয়া করে।
ছ. دم (দাম) এর পরিবর্তে دماء (দেমা) শব্দের ব্যবহার ভালো হতো। কারণ, এটা বহু বচনের শব্দ। আর দাম এক বচনের।
হযরত হাসসান এ সমালোচনা শুনে চুপ মেরে যান। তিনি এর কোন জবাব দিতে পারেন নি। মোট কথা, কাব্য বিচারে হযরত খানসার স্থান ছিল দ্বিতীয় স্তরের আরব কবিদের মধ্যে সর্ব্বোচ্চ। ১৮৮৮ সালে বৈরুত থেকে তার কবিতার একটি বৃহৎ সংকলন প্রকাশিত হয়। এতে আরও ৬০ জন আরব মহিলা কবির মর্সিয়া কাব্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৮৮৯ সালে-এর ফরাসী অনুবাদ প্রকাশি হয়েছে।
হযরত উমরের শাসনকালে কাদেসিয়ার যুদ্ধ সংগটিত হয়। এ যুদ্ধে ইরানীরা বিপুল শক্তি নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। হযরত খানসা তার চারজন পুত্র সন্তানকে নিয়ে এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করে রাত্রে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। তিনি বলেনঃ আমার প্রিয় সন্তানরা! তোমরা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছ, স্বেচ্ছায় হিজরত করেছিলে। সেই অইবনেশ্বর আল্লাহর শপথ, যিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই। যেমননিভাবে তোমরা মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছ, ঠিক তেমনিভাবে তোমরা পিতার সত্য সন্তান। আমি তোমাদের পিতার সাথে প্রতারাণা করিনি, তোমাদের মামাকেও লাঞ্ছিত করিনি। তোমাদের বংশধারা নিষ্কলুস, নিষ্কলংক। তোমরা জান, কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করার মধ্যে মুসলমানদের জন্য রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট সাওয়াব। এ সত্য তোমরা ভালো করে হৃদয়ঙ্গম করে নেবে যে, অইবনেশ্বর জগতের তুলনায় এ নশ্বর জগত অতি তুচ্ছ, নগন্য। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
মুসলমানরা! ধৈর্য ধারণ কর, একে অপরকে ধৈর্যের তালীম দাও এবং সকলে সম্মিলিত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায় যে, তোমরা কল্যাণ লাভে সমর্থ হবে। (আলে ইমরান : ২০০)
তোমরা যখন দেখবে যে, তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়েছে, যুদ্ধের তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে আর তার স্ফুলিঙ্গ চারিদিকে চিকচিক করছে, তখন তোমরা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়বে এবং নির্দিধায় তরবারী চালাবে আর অইবনেশ্বর আল্লাহর নিকট থেকে বিজয় ও সাহায্য প্রত্যাশা করবে। ইনশা আল্লাহ্ পরকালের শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্বে অবশ্যই তোমারা সফলকাম হবে।
মায়ের উপদেশ অনুযায়ী ইসলামের এ সূর্য সৈনিকরা প্রত্যুষে রণক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পড়ে এবং ইতিহাসের পাতায় শৌর্য-বীর্য আর সাহসিকতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে শেষ পর্যন্ত সকলেই শাহাদাত বরণ করেন। হযরত খানসা শাহাদাত সম্পর্কে জানতে পেরে বলেন, আল্লাহ্র শুকরিয়া, তিনি আমাকে তাদের শাহাদাতের মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহর নিকট আমার প্রত্যাশা, আমি তার রহমতের ছায়ায় আমার সন্তানদের সাথে মিলিত হবো। হযরত উমর শহীদ সন্তানদের প্রত্যেকের জন্য বার্ষিক দু’শ দিরহাম বৃত্তি মঞ্জুর করেন। হযরত খানসা হযরত আয়েশার খেদমতেও হাযির হতেন। তার মাথায় একগাছি পরচুলা বাধা থাকতো। আরবে এটা ছিল শোকের প্রতীক। হযরত আয়েশা বলেলেন, ইসলামে এটা নিষিদ্ধ। তিনি বললেন, হযরত এতো আমার জানা নেই। কিন্তু আমি যে এটা বেঁধেছি তার একটা বিশেষ কারণ আছে। আয়েশা জিজ্ঞেস করলেন, কি সে বিশেষ কারণ? হযরত খানসা বললেন ঃ আমার পিতা যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেন, তিনি ছিলেন অত্যন্ত বেহিসেবী, অপব্যয়ী। তাই তিনি আমার এবং তার নিজের সমস্ত সম্পদই জুয়া খেলায় উড়িয়ে দেন। আমি নিঃস্ব হয়ে পড়লে আমার ভাই ছখর তার সমস্ত সম্পদ দু’ভাগ করে এক ভাগ আমাকে দান করেন। আমার স্বামী আবারও অল্প দিনের মধ্যে তা উজাড় করে দিলে আমার ভাই ছখর আমাদের দুঃখ কষ্টের জন্য দুঃখ করে পুনরায় তার সম্পদ দু’ভাগ করে এক ভাগ আমাকে দান করেন। এবার তার বউ তাকে বলে যে, তুমি যে এভাবে খানসাকে সব দিয়ে দিচ্ছ, এটা কতকাল এভাবে চলবে? আর তার স্বামী তো সবই জুয়ার আড্ডায় উড়াজ করে দেবে। ছখর এর জবাবে তার স্ত্রীকে এই কবিতাটি পড়ে শুনান ঃ আল্লাহর শপথ, আমি তাকে সম্পদের নিকৃষ্ট অংশ দেবোনা। সে তো সতী-সাধ্বী, আমার জন্য তার লজ্জাই যথেষ্ট। আমি মারা গেলে সে (আমার শোকে) তার ওড়না ছিড়বে। আর চুলের গোছা বানাবে। তাই ভাই ছখর এর স্মৃতি হিসেবে আমি চুলের এ গোছা বানিয়েছি। কাদেসিয়া যুদ্ধের প্রায় ৭ বৎসর পর ২৪ হিজরীতে হযরত খানসা ইন্তিকাল করেন। বর্ণনা মতে মুআবিয়া ইবনে আবূ সুফিয়ানের শাসনকালে কোন বিজন প্রান্তরে তিনি ইন্তিকাল করেন।