(তৃতীয় পর্ব)
কিয়ামতের দিন আল্লাহ সৃষ্টির প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি মানুষকে তার ইহজগতের রক্ষিত আমলনামা দেখাবেন, যাতে মিথ্যার কোন লেশ থাকবে না। আর সে আমলনামা বোধগম্য হ’তে কোন মানুষেরই বিন্দুমাত্র দেরী হবে না। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, وَكُلَّ إِنْسَانٍ أَلْزَمْنَاهُ طَآئِرَهُ فِيْ عُنُقِهِ وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَاباً يَلْقَاهُ مَنشُوْراً، اقْرَأْ كَتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيْباً– ‘প্রত্যেক মানুষের কৃতকর্মকে আমরা তার গ্রীবালগ্ন করে রেখেছি। আর কিয়ামতের দিন আমরা তাকে বের করে দেখাব একটি আমলনামা, যা সে খোলা অবস্থায় পাবে। (সেদিন আমরা বলব,) তুমি তোমার আমলনামা পাঠ কর। আজ তুমি নিজেই নিজের হিসাবের জন্য যথেষ্ট’ (বনী ইসরাঈল ১৭/১৩-১৪
অন্যত্র তিনি বলেন, وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِيْنَ مُشْفِقِيْنَ مِمَّا فِيْهِ وَيَقُوْلُوْنَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيْرَةً وَلَا كَبِيْرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوْا مَا عَمِلُوْا حَاضِراً وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَداً ‘অতঃপর পেশ করা হবে আমলনামা। তখন তাতে যা আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদের দেখবে আতংকগ্রস্ত। তারা বলবে, হায় আফসোস! এটা কেমন আমলনামা যে, ছোট-বড় কোন কিছুই ছাড়েনি, সবকিছুই গণনা করেছে? আর তারা তাদের কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক কাউকে যুলুম করেন না’ (কাহফ ১৮/৪৯)।
আল্লাহ আরও বলেন, يَوْمَئِذٍ يَصْدُرُ النَّاسُ أَشْتَاتاً لِّيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ، فَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْراً يَّرَهُ، وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرّاً يَّرَهُ– ‘সেদিন মানুষ বিভিন্ন দলে প্রকাশ পাবে, যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সমূহ দেখানো যায়। অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা সে দেখতে পাবে। আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও সে দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৬-৮)।
আল্লাহর সাক্ষাতে অবিশ্বাসীদের নিয়ে বহু আলোচনা রয়েছে, যেমন, ‘তাদের মন্দ কর্মগুলো তাদের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়বে এবং যে আযাব নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত, তা তাদেরকে গ্রাস করবে। বলা হবে, আজ আমি তোমাদেরকে ভুলে যাব, যেমন তোমরা এ দিনের সাক্ষাতকে ভুলে গিয়েছিলে। তোমাদের আবাসস্থল জাহান্নাম এবং তোমাদের সাহায্যকারী নেই’ (জাছিয়া ৪৫/৩৩-৩৪)
অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَقَالَ الَّذِيْنَ لَا يَرْجُوْنَ لِقَاءَنَا لَوْلَا أُنْزِلَ عَلَيْنَا الْمَلَائِكَةُ أَوْ نَرَى رَبَّنَا لَقَدِ اسْتَكْبَرُوْا فِيْ أَنْفُسِهِمْ وَعَتَوْ عُتُوّاً كَبِيْراً، يَوْمَ يَرَوْنَ الْمَلَائِكَةَ لَا بُشْرَى يَوْمَئِذٍ لِّلْمُجْرِمِيْنَ وَيَقُوْلُوْنَ حِجْراً مَّحْجُوْراً، وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوْا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاء مَّنثُوْراً– ‘আর যারা আমাদের সাক্ষাৎ কামনা করে না তারা বলে, কেন আমাদের কাছে ফেরেশতা নাযিল করা হয় না অথবা কেন আমরা আমাদের প্রতিপালককে দেখি না? তারা নিজেদের অন্তরে অহংকার লুকিয়ে রাখে এবং গুরুতর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়। যেদিন তারা ফেরেশতাদের দেখবে, সেদিন পাপীদের জন্য কোন সুসংবাদ থাকবে না এবং তারা বলবে, বাঁচাও বাঁচাও। আর আমরা সেদিন তাদের কৃতকর্মসমূহের দিকে মনোনিবেশ করব। অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (ফুরকান ২৫/২১-২৩)।
কিয়ামত দিবসের মহাসংকটপূর্ণ পরিবেশের বর্ণনায় এসেছে,
فَإِذَا جَاءَتِ الطَّامَّةُ الْكُبْرَى، يَوْمَ يَتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ مَا سَعَى، وَبُرِّزَتِ الْجَحِيْمُ لِمَنْ يَرَى، فَأَمَّا مَنْ طَغَى، وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا، فَإِنَّ الْجَحِيْمَ هِيَ الْمَأْوَى، وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى، فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى، يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا، فِيْمَ أَنْتَ مِنْ ذِكْرَاهَا، إِلَى رَبِّكَ مُنْتَهَاهَا، إِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرُ مَنْ يَخْشَاهَا، كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوْا إِلَّا عَشِيَّةً أَوْ ضُحَاهَا–
‘অতঃপর যখন মহাসংকট এসে যাবে, সেদিন মানুষ তার কৃতকর্মসমূহ স্মরণ করবে এবং দর্শকের জন্য জাহান্নামকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তখন যে ব্যক্তি সীমালংঘন করেছে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে জাহান্নাম তার ঠিকানা হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার প্রভুর সম্মুখে দন্ডায়মান হওয়ার ভয় করেছে এবং নিজেকে প্রবৃত্তির গোলামী হতে বিরত রেখেছে, জান্নাত তার ঠিকানা হবে। তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে, ক্বিয়ামত কখন হবে? এ বিষয়ে বলার জন্য তুমি কে? এর চূড়ান্ত জ্ঞান তো তোমার প্রভুর নিকটে। তুমি তো কেবল সতর্ককারী ঐ ব্যক্তির জন্য যে ক্বিয়ামতকে ভয় করে। যেদিন তারা তা দেখবে, সেদিন তাদের মনে হবে যেন তারা দুনিয়াতে ছিল একটি সন্ধ্যা বা একটি সকাল’ (নাযি‘আত ৭৯/৩৪-৪৬)।
উপরোক্ত আলোচনায় একটা বিষয় সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়েছে যে, পরকালে আল্লাহর সাথে মানুষের সাক্ষাৎ ঘটবে। সে সময় আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভের জন্য পার্থিব জীবনে সাধ্যমত সৎকাজ করতে হবে। আর পরকালীন ভয়াবহতার কথা বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করে মহান আল্লাহ মানুষকে সৎ আমল করতে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আদেশ ও উপদেশ বাণী কোন বিশেষ বান্দার জন্য প্রেরণ করেননি। বরং তিনি সবার জন্যই একই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন। যেমন- সকল বান্দার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, أَلَا يَظُنُّ أُولَئِكَ أَنَّهُم مَّبْعُوْثُوْنَ، لِيَوْمٍ عَظِيْمٍ، يَوْمَ يَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ– ‘তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে? সেই মহা দিবসে, যেদিন মানুষ দন্ডায়মান হবে বিশ্বপালকের সম্মুখে’ (মুতাফফিফীন ৮৩/৪-৬)।
প্রকৃত আল্লাহভীরুদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ ‘যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দন্ডায়মান হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্যে রয়েছে দু’টি উদ্যান’ (আর-রহমান ৫৫/৪৬)।
আল্লাহভীতির এরূপ বাস্তব দৃষ্টান্ত আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু হৃদয়ের আকর্ষণ ছাড়া আল্লাহভীতির কোন মূল্যায়ণ হবে না। কারণ আল্লাহ হচ্ছেন অন্তর্যামী, তাঁর কাছে অন্তরের বিষয়ই অধিক গ্রহণীয়। এমনকি তিনি কোন কোন ক্ষেত্রে অন্তরের বিষয়াদি ছাড়া মৌখিক বিষয়ের বা কথার কোন মূল্য দেন না। আল্লাহ বলেন, لاَّ يُؤَاخِذُكُمُ اللهُ بِاللَّغْوِ فِيْ أَيْمَانِكُمْ وَلَكِنْ يُؤَاخِذُكُمْ بِمَا كَسَبَتْ قُلُوْبُكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ حَلِيْمٌ ‘অর্থহীন শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদের ধরবেন না। তবে ঐসব শপথের জন্য তিনি তোমাদের পাকড়াও করবেন, যা তোমরা মনের সংকল্প অনুযায়ী করে থাক। বস্তুতঃ আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও সহনশীল’ (বাক্বারাহ ২/২২৫)।
পরিশুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তি সফলকাম হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ، إِلَّا مَنْ أَتَى اللهَ بِقَلْبٍ سَلِيْمٍ– ‘সেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না। কেবল যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে আল্লাহর নিকটে আসবে, সে ব্যতীত’ (শো‘আরা ২৬/৮৮-৮৯)।
আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সাক্ষাৎ সম্পর্কে আমাদের নবী (ছাঃ) অনেক হাদীছ রেখে গেছেন। এখানে কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করা হ’ল- জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদিন পূর্ণিমার রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের মাঝে আসলেন। তিনি বললেন, অচিরেই ক্বিয়ামতের দিন তোমরা তোমাদের রব (আল্লাহর)-কে দেখতে পাবে, যেমন এ চাঁদকে দেখতে পাচ্ছ’ (বুখারী হা/৭৪৩৬)।
আদী ইবনে হাতেম (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের সাথে তাঁর রব (আল্লাহ তা‘আলা) কথা বলবেন। তার এবং আল্লাহর মধ্যে কোন দোভাষী থাকবে না। সে তার ডানে তাকিয়ে আমল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। সামনে তাকিয়ে জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। তাই এক টুকরো খেজুরের বিনিময়ে হ’লেও জাহান্নামকে ভয় কর’ (বুখারী হা/৬৫৩৯)।
ছাফওয়ান ইবনে মুহরিয হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরকে জিজ্ঞেস করল যে, আল্লাহর সাথে তাঁর ঈমানদার বান্দার নির্জনে কথাবার্তা সম্পর্কে আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কি বলতে শুনেছেন? তিনি বললেন, তোমাদের কেউ তার রবের কাছে গেলে তিনি তাঁর উপর পর্দা দিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, এসব কাজ কি তুমি করেছ? সে বলবে, হ্যাঁ করেছি। আল্লাহ আবার জিজ্ঞেস করবেন, তুমি কি একাজ ও একাজ করেছ। সে বলবে, হ্যাঁ। আল্লাহ এভাবে তার স্বীকৃতি নিবেন, তারপর বলবেন, আমি দুনিয়ায় তোমার এসব কাজ গোপন করে রেখেছিলাম, আর আজকে তা মাফ করে দিলাম’ (বুখারী হা/২৪৪১
মহান প্রতিপালক আল্লাহর সামনে তাঁর বান্দার হাযির হওয়ার প্রথম নির্ধারিত স্থান হবে ইহজগত ও পরজগতের মধ্যস্থল হাশর। ঐ দিন সমস্ত মানুষ সমবেত হবে এবং প্রত্যেকের আমল পরীক্ষা করে বিচার হবে। ঐ দিনের দীর্ঘতা পঞ্চাশ হাযার বছর হবে। যা কল্পনা করাও এক অসম্ভব ব্যাপার। ঐ দিনের ভয়াবহতা অবিশ্বাসীদের জন্যে যে শোচনীয় পরিণতি ডেকে আনবে তা সেদিনের দীর্ঘতাকে আরও অসম্ভব দীর্ঘ করে তুলবে।
এসব আলোচনা মানুষকে সৎপথে আনার প্রচেষ্টা মাত্র। আল্লাহ মানুষকে সেই দিবসে হাযির করবেন, যেদিন মানুষ তার কর্ম অনুযায়ী জান্নাতী বা জাহান্নামী হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে, একটি মাত্র ফুৎকার এবং পৃথিবী ও পর্বতমালা উত্তোলিত হবে ও চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হবে। সেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে। সেদিন আকাশ বিদীর্ণ ও বিক্ষিপ্ত হবে এবং ফেরেশতাগণ আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে। আট জন ফেরেশতা আপনার পালনকর্তার আরশকে তাদের ঊর্ধ্বে বহন করবে। সেদিন তোমাদেরকে উপস্থিত করা হবে। তোমাদের কোন কিছু গোপন থাকবে না। অতঃপর যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে, সে বলবে, নাও, তোমরা আমলনামা পড়ে দেখ। আমি জানতাম যে, আমাকে হিসাবের সম্মুখীন হ’তে হবে। অতঃপর সে সুখী জীবন-যাপন করবে, সুউচ্চ জান্নাতে। তার ফলসমূহ অবনমিত থাকবে। (বলা হবে,) বিগত দিনে তোমরা যা প্রেরণ করেছিলে, তার প্রতিদানে তোমরা খাও এবং পান কর তৃপ্তি সহকারে। যার আমলনামা তার বাম হাতে দেয়া হবে, সে বলবে, হায় আমায় যদি আমার আমলনামা না দেয়া হ’ত, আমি যদি না জানতাম আমার হিসাব! হায়, আমার মৃত্যুই যদি শেষ হ’ত! আমার ধন-সম্পদ আমার কোন উপকারে আসল না। আমার ক্ষমতাও বরবাদ হয়ে গেল। ফেরেশতাদেরকে বলা হবে, ধর একে, গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও, অতঃপর নিক্ষেপ কর জাহান্নামে। অতঃপর তাকে শৃঙ্খলিত কর সত্তর গজ দীর্ঘ এক শিকলে। নিশ্চয়ই সে মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল না এবং মিসকীনকে আহার্য দিতে উৎসাহিত করত না’ (হাককাহ ৬৯/১৩-৩৪)