মানবজাতির ইতিহাসে মাঝে মাঝে এমন মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটে, যারা ইতিহাসের গতিধারাকে পাল্টে দেন, তাদের চিন্তা চেতনা ও সাধনায় সমাজে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। তাদের মহত্তম জীবন, প্রচারিত আদর্শ ও কর্মতৎপরতায় নতুন সভ্যতার পত্তন ঘটে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনুসন্ধিৎসার সৃষ্টি হয়; এমনকি অনেকে বিশ্বব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধনে সক্ষম হন। মানবসমাজে অসাধারণ অবদানের জন্য আমরা তাদের মহামানব বা বিভিন্ন সম্মানজনক বিশেষণে আখ্যায়িত করি।
প্রথম শ্রেণীতে পড়েন মহান স্রষ্টার ওহিপ্রাপ্ত, বার্তাবাহক নবী-রাসূলেরা। নবী-রাসূল হিসেবে তাঁরা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। মানবজাতির কাছে আল্লাহর দ্বীন প্রচার, মানবজাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শন এবং মানবজাতিকে ইহ-পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণের পথ দেখানোর উদ্দেশ্যে মহান স্রষ্টা তাঁদের পৃথিবীতে পাঠান। আল্লাহ তাঁদের বিশেষভাবে মানবজাতির আদর্শরূপে সৃষ্টি করেন। তাঁরা উন্নত-মহৎ আদর্শ ও নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী এবং সব ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে হন। তাঁরা যদিও আমাদের মতোই মানুষ, কিন্তু মানবজাতি যাতে তাঁদের অনুসরণ করে উন্নত মানবিক গুণাবলি অর্জন করতে পারে, সে জন্য আল্লাহ তাঁদের প্রকৃত মানবিক গুণাবলিতে ভূষিত করেন। তাই তাঁরা মহামানব। তাঁদের সাথে সাধারণ মানুষের তুলনা করা চলে না। তাঁরা মানবজাতির জন্য আদর্শ, অনুসরণীয় মহত্তম ব্যক্তিত্ব।
আর দ্বিতীয় শ্রেণীর মহামানব হলেন নবী-রাসূলদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী কিছুসংখ্যক মহৎ ব্যক্তি। যুগে যুগে তারা আবির্ভূত হয়ে সমাজ ও সভ্যতায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। এরা নবী-রাসূলদের মতো ওহী জ্ঞানের অধিকারী নন, কিন্তু নবী-রাসূলদের পদাঙ্ক অনুসারী হিসেবে ওহী জ্ঞানে তারা উদ্ভাসিত এবং স্বীয় জীবন ও সমাজে সে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে সদা তৎপর।
মহানবী মুহাম্মাদ সা: ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীপ্রাপ্ত রাসূল। মহান স্রষ্টা যুগে যুগে যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ, খাতামুন নাবিইন, ইমামুল মুরসালিন। অতএব, তিনি প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত এবং প্রথমোক্তদের মধ্যেও প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তাঁর সম্পর্কে বলেন :
‘তোমাকে মানুষের জন্য রাসূলরূপে প্রেরণ করেছি; সাথী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। (সূরা নিসা, আয়াত : ৭৯-৮০)
রাসূলগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। মহানবীও সা: আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। উপরিউক্ত আয়াতে সে কথাই স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলের আনুগত্য মানে আল্লাহর আনুগত্য; আর রাসূলের আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা লাভ করা যায়: মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন:
বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। (সূরা আলে ইমরান: ৩১)
রাসূলে কারীম (সা.) যা বলতেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীপ্রাপ্ত হওয়ার পরই বলতেন। আল্লাহ এরশাদ করেন:
এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। কুরআন ওহী, যা প্রত্যাদেশ হয়। (সূরা নাজম: ৩-৪)
তাই জগতের অন্য মহামানবদের মতো শুধু একজন মহামানব বললে তাঁকে যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয় না। তিনি ছিলেন সর্বগুণে গুণান্বিত দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম মহামানব। মুসলিমগণ তো বটেই, দুনিয়ার বহু বিশিষ্ট অমুসলিম মনীষী ও চিন্তাবিদও তাঁকে মানবজাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবরূপে আখ্যায়িত করেছেন।
তিনি কিয়ামত পর্যন্ত সকলের জন্য নবী। তাঁর শুভাগমনের মাধ্যমে সুসমাপ্ত হয়েছে নবী-আগমনের ধারা। তিনি ‘খাতামুন্নাবিয়ীন’ ও ‘রহমাতুল্লিল আলামীন’। তাঁর সুমহান আদর্শে ও অতুলনীয় চরিত্র-সুষমায় জগৎবাসী মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছে। তিনি ছিলেন আল্লাহ তাআলার বান্দা ও রাসূল, মানবতার পূর্ণ বিকশিত রূপ। তাই গোটা মানবজাতির জন্য তিনি আদর্শ। আপনজনেরা তাঁর প্রতি ঈমান এনে জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। আর অন্যেরা তাঁর মানবীয় গুণাবলিতে মুগ্ধ হয়ে মুক্ত কণ্ঠে প্রশংসা করেছেন। এই সংক্ষিপ্ত লেখায় তাদেরই কিছু অনুভূতি তুলে ধরছি।
ভারতের বিখ্যাত লেখক গুরুদত্ত সিং নবীজীর প্রতি তার গভীর ভালবাসা জানিয়েছেন এভাবে-‘সত্যের আলো ছড়াতে, পুণ্যের পথ দেখাতে এক মহামানবের আবির্ভাব হল। তাঁর শুভদর্শনে দৃষ্টি যাদের প্রেমমুগ্ধ হল এবং হৃদয় যাদের ভালবাসায় স্নিগ্ধ হল জনম তাদের সার্থক হল। এ পরশমণির পরশ-সৌভাগ্য যারা লাভ করল খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি তারা হল। এ স্বর্গ-পুষ্পের সান্নিধ্য- সৌরভ যারা পেল বিশ্ববাগানে তারা গোলাপের খোশবু ছড়াল।’
এডওয়ার্ড গীবন ছিলেন বড় ঐতিহাসিক। তিনি লিখেছেন: ‘মুহাম্মাদ এত ভালো ছিলেন যে, যারা তার কাছে আশ্রয় নিত, তিনি তাদের রক্ষা করতেন। তাঁর মুখের কথা ছিল মধুর মতো। যারা তাঁকে দেখেছে তারা ভক্তি করেছে এবং যারা তাঁর কাছে গিয়েছে তারা তাঁকে ভালবেসেছে। … এত বড় হয়েও তিনি নিজের কাজ নিজে করতেন। ঘর ঝাড়ু দিতেন এবং নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন।’
ফিলিপ কে হিট্টি ছিলেন বড় জ্ঞানী, তিনি বলেন: ‘উত্তম চরিত্র ও সুন্দর ব্যবহার দ্বারা তিনি মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। সব সময় তিনি ন্যায়ের পথে চলেছেন। কখনো কোনো অন্যায় করেননি এবং ওয়াদা ভঙ্গ করেননি। যারা তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল, যারা তাঁকে দেশছাড়া করেছিল তাদেরও তিনি ক্ষমা করেছেন। মক্কাবিজয়ের সময় কোনো প্রতিশোধ নেননি।’
ল্যামার্টিন ছিলেন ফরাসী দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, তিনি বলেন, ‘মুহাম্মাদের চেয়ে উত্তম মানুষ পৃথিবীতে আর কে আছে? তিনি যেমন ছিলেন নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী তেমনি ছিলেন সাহসী, সৎ ও সত্যবাদী। যেমন ছিলেন দয়ালু ও দানশীল তেমনি ছিলেন ধৈর্যশীল ও ক্ষমাশীল। মানবজাতির ইতিহাসে তার তুলনা কোথাও খুঁজে পাবে না তুমি।’
ডক্টর গুস্তাভ উইল ছিলেন জার্মানির বিখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তি, তিনি বলেছেন, ‘মুহাম্মাদের চরিত্র ছিল পবিত্র। সকল অঞ্চল থেকে তাঁর কাছে বিপুল সম্পদ আসত, কিন্তু তিনি নিজের জন্য কিছুই রাখতেন না। মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। তাঁর বাসস্থান, পোশাক ও পানাহার ছিল খুব সাধারণ। তিনি অসুস্থদের দেখতে যেতেন এবং নিজ হাতে তাদের সেবা করতেন। অসহায়-দরিদ্র, বিধবা ও এতীমদের জন্য তিনি ছিলেন পিতার মতো স্নেহশীল।’
জর্জ বার্নার্ড শ ইউরোপের সুপ্রসিদ্ধ দার্শনিক ও সাহিত্যিক, তিনি লিখেছেন, ‘মুহাম্মাদের ধর্মকে আমি সবসময় শ্রদ্ধা করেছি। মুহাম্মাদ-জীবনী আমি গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়েছি। আমার বিশ্বাস, তিনি ছিলেন মানবজাতির ত্রাণকর্তা। পৃথিবীতে আজ এত যে সমস্যা, এত যে অশান্তি, আমি মনে করি, তাঁর মতো ব্যক্তি সারাবিশ্বের শাসনভার গ্রহণ করলে সব সমস্যার সমাধান হত এবং পৃথিবীতে সুখ-শান্তি ফিরে আসত।’
ডক্টর মার্কোস উড নামে একজন বড় জ্ঞানী ছিলেন তিনি বলেছেন, ‘ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য মুহাম্মাদ যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে, এমনকি জীবন বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। তাঁকে বড় বড় প্রলোভন দেওয়া হয়েছে, কঠিন কঠিন নির্যাতন চালানো হয়েছে, আপনজনেরা তাঁকে দেশছাড়া করেছে, কিন্তু তিনি মাথা নত করেননি, লোভ ও প্রলোভন তাঁকে সত্যের পথ থেকে সরাতে পারেনি এবং নির্যাতন ও নিপীড়ন তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ করতে পারেনি।’
কিন্তু হতভাগা বহু মুসলমান আছে, যারা এই বিশ্বসেরা রাসূল অনুসরণ করে না, তাঁর আদর্শ গ্রহণ করে না। পদে পদে তাঁকে অপমান করে। যারা তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলে, তাদেরকে বিনা অপরাধে হত্যা করে। তার আদর্শকে মিটিয়ে দিতে চায়।
মহান আল্লাহ যাঁকে সর্বোত্তম আদর্শ ও শ্রেষ্ঠতম চরিত্রবিশিষ্ট করে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তাঁকে মানব ইতিহাসের সর্বোত্তম আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যও মনোনীত করেন। ফলে তিনি যেমন মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি, তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজও সর্বকালের আদর্শ ও অনুসরণীয় সমাজ। অনুরূপ সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বের শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত, হতাশাগ্রস্ত মানুষের মুক্তি ও প্রত্যাশিত সাম্য, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারে। সে জন্য অবশ্য মহানবীর সা: আদর্শে অনুপ্রাণিত নিষ্ঠাবান, উন্নত চরিত্রবিশিষ্ট, ত্যাগী মানুষ প্রয়োজন।
হতাশাগ্রস্ত, অশান্তিপূর্ণ পৃথিবীতে আজ শান্তি ও কল্যাণকর মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা প্রতিটি মানুষের। যুগে যুগে বিভিন্ন মতদর্শন ও পদ্ধতিতে যে সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা মানবজাতির জন্য প্রকৃত কল্যাণ বয়ে আনতে পারেনি। তাই আমাদের আজ প্রকৃত শান্তিপূর্ণ কল্যাণকর মানব সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আল-কুরআন ও মহানবীর সা: জীবনাদর্শকে ধারণ করে তা বাস্তবায়নের জন্য সর্বতোভাবে সচেষ্ট হতে হবে। তাই বন্ধুরা! আসুন আমরা সকলে তাঁর আদর্শকে জীবনে চলার সাথী বানিয়ে নেই। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন