হযরত আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা.)
নাম আবদু আমর বা আবদু কা’বা। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল (সা.) তাঁর নতুন নামকরণ করেন আবদুর রহমান। ডাক নাম আবূ মুহাম্মাদ। আব্বার নাম আওফ এবং মার নাম শেফা। আব্বা মা উভয়েই যোহরী গোত্রের লোক ছিলেন। তাঁর দাদা ও নানা উভয়েরই নাম ছিল আওফ। তাঁর বংশ তালিকা নিম্নরূপ আবদুর রহমান ইবন আওফ, ইবন আবদু আওফ, ইবন আবদ, ইবনুল হারেস, ইবন যোহারা, ইবন কেলাব, ইবন মুরারা আল কারশী আযযোহরী।
জানা যায় তিনি আমূল ফীল বা হস্তী বছরের দশ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। এ হিসাবে আবদুর রহমান রাসূল (সা.)-এর দশ বছরের ছোট ছিলেন। কারণ রাসূল (সা.) আমূল ফীলের ঘটনার পঞ্চাশ দিন পর জন্মগ্রহণ করেন। আর রাসূল (সা.) যখন ইসলাম প্রচার শুরু করেন তখন তাঁর বয়স ত্রিশ বছরের কিছু বেশী ছিলো।
মক্কার বিশিষ্ট কিছু লোক নিয়মিত হযরত আবূ বকর (রা.)-এর বাড়িতে মিলিত হয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। হযরত আবদুর রহমান ছিলেন তাদেরই একজন। এখান থেকেই হযরত আবূ বকরের দাওয়াতে তিনি রাসূল (সা.)-এর খেদমতে হাজির হন এবং ইসলাম কবূল করেন। এ সময় রাসূল (সা.) আরকাম ইবন আবূ আরকামের ঘরে অবস্থান করছিলেন। আবদুর রহমান সেই সৌভাগ্যবানদেরই একজন যাঁরা প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। হযরত আবূ বকরের বাড়িতে যাঁরা নিয়মিত মিলিত হতেন ইতিহাসে তাদের পাঁচ জনের নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন, হযরত ওসমান (রা.), হযরত সা’দ (রা.), হযরত তালহা (রা.), হযরত যুবাইর (রা.) ও হযরত আবদুর রহমান (রা.)। আনন্দের খবর হলো এ পাঁচ জনই আবূ বকর (রা.)-এর প্রথম দাওয়াতে প্রথম পর্যায়ে ইসলাম কবূল করেন এবং দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত হন।
নবুওয়াতের প্রথম পর্বে যাঁরা ইসলাম কবূল করেছিলেন তাঁদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন নেমে আসলে নবুওয়াতের পঞ্চম বছরে এগারোজন পুরুষ ও চারজন মহিলা মক্কা থেকে হাবশায় হিজরত করেন। ইসলামের ইতিহাসে হিজরতকারী এ প্রথম কাফিলাটিতে হযরত আবদুর রহমান (রা.) ছিলেন। পরে রাসূল (সা.) যখন মদীনায় হিজরত করেন তখন আবদুর রহমানও মদীনায় হিজরত করেন। এজন্য তাঁকে সাহিবুল হিজরাতাইন’ বা দু’হিজরতের অধিকারী বলা হয়। মদীনায় হিজরতের পর রাসূল (সা.) হযরত আবদুর রহমানের সাথে হযরত সা’দ ইবনুর রাবী (রা.)-এর ভাই সম্পর্ক পাতিয়ে দেন। এরপর একটি শিক্ষণীয় ঘটনা ঘটে- সা’দ (রা.) আবদুর রহমান (রা.) কে বললেন, আনসারদের সকলে জানে আমি একজন ধণ্যাঢ্য ব্যক্তি। আমি আমার সকল সম্পদ সমান দু’ভাগে ভাগ করে দিতে চাই। আমার দু’জন স্ত্রীও আছেন। আমি চাই আপনি তাদের দু’জনকে দেখে একজনকে পছন্দ করুন। আমি তাকে তালাক দেবো। তারপর আপনি তাকে বিয়ে করে নেবেন। উত্তরে আবদুর রহমান বললেন, ‘আল্লাহ আপনার পরিজনের মধ্যে বরকত ও কল্যাণ দান করুন। ভাই, এসব কোনো কিছুর প্রয়োজন আমার নেই। আমাকে শুধু বাজারের পথটি দেখিয়ে দিন’। হযরত আবদুর রহমানকে নিকটস্থ কাইনুকা বাজারে পৌছে দিলে ঐ দিনই তিনি ঘি ও পণীরের ব্যবসা শুরু করেন এবং কিছুটা লাভবান হন। পরদিন থেকে তিনি রীতিমত ব্যবসা শুরু করেন।
তোমরা নিশ্চয়ই হযরত সাদ (রা.) ইসলামী ভ্রাতৃত্বের যে মর্যাদা দিয়েছে তাতে মুগ্ধ হয়েছো। অপরদিকে হযরত আবদুর রহমানও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা অনুসরণ যোগ্য। আসলে ইসলামের শিক্ষাই এমন।
ব্যবসা শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই হযরত আবদুর রহমানের হাতে বেশ পয়সা জমা হয়। তখন তিনি এক আনসারী মহিলাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরপরই তিনি একদিন রাসূল (সা.)-এর দরবারে হাজির হন তখন তাঁর কাপড়ে হলুদের দাগ ছিলো। তা দেখে রাসূল (সা.) বললেন, ‘মোহর কত নির্ধারণ করেছো?’ তিনি বললেন, ‘খেজুরের একটি দানা পরিমাণ সোনা’। এরপর রাসূল (সা.) বললেন, ‘তা হলে ওলীমার ব্যবস্থা করো। বেশী না হয় অন্তত একটা ছাগল দিয়ে হোক’।
পরবর্তীতে তাঁর হাতে যখন ব্যবসা থেকে আরো কিছু নগদ টাকা আসে তখন তিনি ওলীমার ব্যবস্থা করেন। তিনি ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে দ্রুত সাফল্য লাভ করতে থাকেন। এসময়ে উমাইয়া ইবন খালফ নামক মক্কার এক ব্যক্তির সাথে তিনি একটি ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদন করেন।
হিজরী দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। হযরত আবদুর রহমান বদরসহ প্রায় সকল যুদ্ধেই অংশ গ্রহণ করেন এবং সকল যুদ্ধেই তিনি একজন দুঃসাহসিক যোদ্ধা হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হন। বদরের যুদ্ধ চলাকালে হযরত আবদুর রহমান হঠাৎ করে নিজেকে দু’জন কিশোরের ভেতরে দেখতে পান। তিনি এসময় নিজেকে কিছুটা অসহায় মনে করছিলেন, এমন সময় তাদের একজন এসে তাকে আবূ জেহেল কোন দিকে? জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাতিজা, তাকে খুঁজছো কেনো?’ ছেলেটি বললো, ‘আমি আল্লাহর সাথে ওয়াদা করেছি, হয় তাকে কতল করবো, না হয় এজন্য জীবন দেবো’। অন্যজনও একই কথা জানালো। এরপর আবদুর রহমান (রা.) বলেন, ‘তাদের কথা শোনার পর আমি খুশি হলাম। ভাবলাম কতো মহৎ দু’জন কিশোরের মাঝখানেই না দাঁড়িয়ে আছি। ইশারা করে আমি আবূ জেহেলকে দেখানো মাত্র দু’জন কিশোর তরবারি উন্মুক্ত করে বাজপাখির মতো আবূ জেহেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং তাঁকে ধরাশায়ী করে হত্যা করেন’। এ দু’জন কিশোর কারা ছিলেন? এরা ছিলেন আফরার দু’পুত্র হযরত মুয়ায (রা.) ও হযরত মায়ায (রা.)। ইসলাম ও মুসলমানদের সব থেকে বড় শত্রু আবূ জেহেলকে হত্যা করে এঁরা ইসলামের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। ওহুদের যুদ্ধে হযরত আবদুর রহমান ইবন আওফের ভূমিকা ছিলো চোখে পড়ার মতো। উবাই ইবন খালফ নামক এক নরাধম রাসূল (সা.) কে হত্যা করার জন্য এগিয়ে এলে আবদুর রহমান তাকে কতল করার জন্য এগিয়ে যান কিন্তু রাসূল (সা.) আবদুর রহমানকে থামিয়ে দেন। পরে রাসূল (সা.) নিজেই হারিসের বর্শাটি নিয়ে উবাই ইবন খালফকে লক্ষ্য করে সেটি ছুড়ে দেন। এতে উবাই আহত হয়ে চেচাতে চেচাতে পালিয়ে যায় এবং সারফ নামক স্থানে মারা যায়। এ যুদ্ধে আবদুর রহমান মারাত্মকভাবে আহত হন। তাঁর সারা দেহে একত্রিশটি আঘাত পান। সবচেয়ে পায়ের আঘাত ছিল মারাত্মক। যার জন্য সুস্থ হওয়ার পর তিনি খোঁড়া হয়ে যান। মানে পরবর্তী জীবন থেকে তিনি খোঁড়ায়ে হেটেছেন।
মদীনা থেকে প্রায় তিনশো মাইল দূরে দুমাতুল জান্দালে ‘পাঁচ হিজরী সনে রাসূল (সা.) হযরত আবদুর রহমানের নেতৃত্বে এক বাহিনী প্রেরণ করেন। অভিযানে রওয়ানা হওয়ার আগে আবদুর রহমান রাসূল (সা.)-এর নিকট এলে তিনি আবদুর রহমানের মাথায় পাগড়িটি নিজ হাতে খুলে রেখে দিলেন। এরপর ইসলামী পতাকা তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘বিসমিল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় রওয়ানা হও। যারা আল্লাহর নাফরমানী করে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করো। কিন্তু কাউকে ধোকা দিও না, ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে মেরো না। এমন কি দুমাতুল জান্দাল পৌঁছে কলব গোত্রের লোকজনকেই প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করে, তা’হলে তাদের রাজ কন্যাকে বিয়ে করবে। অন্যথায় যুদ্ধ করবে’।
জানা যায় হযরত আবদুর রহমান সেখানে পৌঁছানোর পর একাধারে তিন দিন তাবলীগের কাজ করারপর কলবগোত্রের সরদার আসবাগ ইবন আমর আল কলবী তার বিপুল সংখ্যক সংগী সাথীসহ ইসলাম কবূল করেন। পরে তিনি ঐ সর্দারের কন্যা তামজুরকে বিয়ে করেন। এই তামজুরের গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন হযরত আবূ সালমা ইবন আবদুর রহমান (রা.)।
মক্কা অভিযান কালে রাসূল (সা.) যে ছোট্ট কাফেলাটির সাথে ছিলেন, হযরত আবদুর রহমানও (রা.) সে দলে ছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর বানূ খুজাইম গোত্রের লোকজনের কাছে দাওয়াতী কাজের জন্য হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদকে পাঠালে বানূ খুজাইমা ও খালিদের সাথে ভুলবুঝাবুঝি হয় এবং এক পর্যায়ে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে বানূ খুজাইমার বেশ কিছু লোক নিহত হয়।
বানূ খুজাইমার এ দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে খালিদ ও আবদুরর রহমানের মধ্যে বচসা হয়। এ সংবাদে রাসূল (সা.) খালিদ ইবন ওয়ালিদকে ডেকে বলেন, ‘তুমি সাবোনে আওয়ারীন (প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারী) একজন সাহাবীর সাথে ঝগড়া ও তর্ক করেছো। এমনটি করা তোমার শোভন হয়নি। আল্লাহর কসম, যদি ওহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনার মালিকও তুমি হও এবং তার সবই আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দাও তবুও তুমি আমার সে সব প্রবীণ সাহাবীর একজনেরও সমকক্ষ হতে পারবে না’। এতে স্পষ্ট হলো যে, হযরত আবদুর রহমান কোন পর্যায়ে মানুষ ছিলেন।
তাবূক অভিযানকালে মুসলমানরা ঈমানী পরীক্ষার সম্মুখীন হন। আবদুর রহমান এ পরীক্ষায় অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে উত্তীর্ণ হন। এ যুদ্ধের খরচ বহনের জন্য রাসূল (সা.) সাহায্য চাইলে আবূ বকর, ওসমান ও আবদুর রহমান প্রচুর অর্থ সাহায্য করেন। হযরত আবদুর রহমান তো আটহাজার দিনার নবী (সা.)-এর হাতে তুলে দেন। এ দৃশ্য দেখে মুনাফিকরা রীতিমতো কানাকানি করতে থাকে যে, ‘সে মানুষ দেখানোর জন্য এ অর্থ দান করেছে। তাদের এহেন মিথ্যা অভিযোগের জবাব স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা তওবার ৭১ নং আয়াতে এভাবে দিয়েছেন- ‘এ তো সেই ব্যক্তি যার ওপর আল্লাহর রহমত নাযিল হতে থাকবে’।
হযরত আবূ বকর (রা.) মৃত্যু শয্যায় থাকা কালে পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে অনেকের সাথে পরামর্শ করেন। এক পর্যায় হযরত আবদুর রহমানের সাথে পরামর্শ করেন এবং হযরত ওমরের (রা.) নাম পেশ করেন। আবদুর রহমান (রা.) সব কথা শোনার পর বলেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কে কোনই সন্দেহ নেই। তবে স্বভাবগত ভাবেই তিনি একটু কঠোর’। যে আট জন সাহাবী হযরত আবূ বকরের খেলাফত কালে ফতোয়া ও বিচারের দায়িত্ব পালন করতেন তাঁর মধ্যে আবদুর রহমানও ছিলেন শীর্ষে। তিনি ফীকাহ বিষয়ক একজন মহান পণ্ডিত ছিলেন। এ সম্বন্ধে হযরত ওমর (রা.) বলেছেন, ‘যারা কুরআন বুঝতে চায়, তারা উবাই বিন কাব, যারা ফারায়েজ সম্পর্কে জানতে চায়, তারা যায়িদ বিন সাবিত এবং যারা ফিকাহ সংক্রান্ত বিষয় জানতে চায়, তারা মুয়ায বিন জাবাল ও আবদুর রহমান বিন আওফের সাথে যেনো সম্পর্ক গড়ে তোলে’। বলা যায় আবদুর রহমান (রা.) হযরত ওমর (রা.)-এর সার্বক্ষণিক উপদেষ্টা ছিলেন। প্রায়ই ওমর (রা.) যখন জনগণের খোঁজ খবর নেবার জন্য বের হতেন আবদুর রহমান থাকতেন তাঁর সঙ্গী।
হযরত ওমর (রা.) নামাযে ইমামতি করা অবস্থায় যেদিন ফিরোজ নামক জনৈক অগ্নিপূজাকে কর্তৃক আহত হন, সেদিন তিনি বাকী নামায পড়ানোর জন্য হযরত আবদুর রহমানকে দায়িত্ব দেন। অবশ্য রাসূল (সা.) জীবিত থাকা অবস্থায় একদিন তিনি প্রাকৃতিক কাজে বাইরে গেলে হযরত আবদুর রহমানের ইমামতিতে নামায শুরু হয়। রাসূল (সা.) ফিরে এসে আবদুর রহমানের পেছনে এক্তেদা করেন।
আবদুর রহমানের বিচক্ষণতার জন্য তার সিদ্ধান্তের কারণে অনেক বড় বড় দুর্ঘটনা থেকেও মুসলিম সমাজ রক্ষা পেয়েছে, যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। এমন কি হযরত ওমর (রা.)-এর ইন্তেকালের পর খলীফা নির্বাচন নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে হযরত আবদুর রহমান এ মামলার মীমাংসা করেন। জীবিতাবস্থায় ওমর (রা.) পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের জন্য ছয়জনের একটি প্যানেল ঘোষণা করেন। এর মধ্যে জনগণ তিনজনের ব্যাপারে কোন সমর্থন না দিলে হযরত আবদুর রহমান বলেন, প্রশ্নটা ছয়জনের মধ্যেই সীমিত। যেই তিনজন সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত কারও সমর্থন পাওয়া যায় নি, তাদেরকে আমরা বাদ দিয়ে অপর তিনজন সম্পর্কে আলোচনা করি এতে বিতর্ক অনেক কমে যাবে। এরপর যুবাইর (রা.), হযরত আলী (রা.), তালহা (রা.), ওসমান (রা.), সা’দ (রা.) এবং আবদুর রহমান (রা.)-এর নাম প্রস্তাব করেন।
এ প্রস্তাব শোনারপর হযরত আবদুর রহমান বললেন, ‘এখন দেখছি যে, আমাদের এ তিন জনের মধ্যেই যে কোন একজন খলীফা নির্বাচিত হবে। আমি এ কাজটি আরো সহজ করে দিচ্ছি। আমি নিজে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করছি। এবার শুধু আপনাদের দু’জনের মধ্যে বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকলো’। এরপর তিনি উভয়ের সাথে আলাপ আলোচনা করে হযরত ওসমান (রা.)-এর হাতে নিজেই সর্ব প্রথম বাইয়াত হন।
হযরত ওমর (রা.) এর খিলাফতের প্রথম বছরে আবদুর রহমানকে আমীরুল হজ্ব নিযুক্ত করেন। হযরত ওসমান (রা.)-এর খেলাফতকালে হযরত আবদুর রহমান নিজেকে গুটিয়ে নেন। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার কোন কাজে আর উৎসাহবোধ করেননি, একান্ত নীরব জীবন যাপন করেন। এ অবস্থায় হিজরী ৩২ সনে ৭৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর লাশ মদীনায় বাকী নামক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার জানাযার সময় প্রখ্যাত সাহাবীরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময়ে হযরত আলী বলেন, ‘হে আবদুর রহমান ইবন আওফ। তুমি আল্লাহর কাছে যাচ্ছো। তুমি দুনিয়ার পরিস্কার পানি পেয়েছো এবং ঘোলা আর দূষিত পানি ছেড়ে গেছো’। হযরত সা’দ (রা.) বলেন, ‘ওয়া জাবালাহ!’ অর্থাৎ এই পর্বতটিও আজ আমাদেরকে ছেড়ে চললো। তাঁর জানাযার নামায পড়ান আমীরুল মোমেনীন হযরত ওসমান (রা.)। হযরত আবদুর রহমানের দিলে ছিলো প্রচণ্ড আল্লাহভীতি। তিনি সব সময়েই আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকতেন। এবং কান্নাকাটি করতেন। আর রাসূল (সা.)-এর প্রতি ছিলো তার অগাধ প্রেম ও ভালবাসা। এ প্রেম এতটা ছিলো যে একবার তিনি নওফেল ইবনে আয়াস (রা.) কে নিয়ে খেতে বসে খাবারের মধ্যে আটার রুটি ও গোশত দেখে কাঁদতে শুরু করলেন। কান্নার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘রাসূল (সা.) আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু সারাটা জীবন তিনি ও তাঁর পরিবার পেট ভরে যবের রুটিও খেতে পারেনি। এখন দেখছি যে, আমার বহু কিছু খাচ্ছি। তাই আমার মনে হচ্ছে, রাসূল (সা.)-এরপর এতদিন জীবিত থাকা আমাদের জন্য ঠিক হয়নি’।
হযরত আবদুর রহমান (রা.) সততার ক্ষেত্রে ছিলেন এক মাইল ফলক। এ সম্পর্কে হযরত ওসমান গণী (রা.) বলেন, ‘আবদুর রহমান নিজের স্বপক্ষে অথবা বিপক্ষে সাক্ষী দেওয়ার অধিকারী। অর্থাৎ তিনি যা বলেন তা তাঁর নিজের স্বার্থের পক্ষেই হোক আর বিপক্ষেই হোক, তার জন্য কোন সাক্ষীর প্রয়োজন নেই। বরং তিনি যাই বলেন তাই ঠিক’।
আবদুর রহমান উম্মাহাতুল মোমেনীনের খেদমত করার গৌরব অর্জন করেন। তিনি সব সময় তাঁদের সফর সঙ্গী হতেন। তিনি তাদের পর্দা, যান বাহন এবং অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থাও করতেন। এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) এরশাদ করেছিলেন, ‘আমার পর যে ব্যক্তি আমার পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণ করবে সে ব্যক্তি অত্যন্ত সত্যবাদী এবং নেককার হবে’।
দান দক্ষিণার ক্ষেত্রে হযরত আবদুর রহমানের ভূমিকা কিংবদন্তী হয়ে আছে। যে আবদুর রহমান শূন্য হাতে মদীনায় ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি পরবর্তীকালে নিজগুণে ও আল্লাহর মেহেরবানীতে প্রভূত অর্থের মালিক হন। তিনি সর্বদা এই ভয়ে ভীত থাকতেন যে তার মাল সম্পদ অর্থ কড়িই বুঝি তাকে বিপদে ফেলবে। এ জন্য তিনি সব সময় দুহাতে দান খয়রাত করতেন। একবার তো মদীনায় ঢি ঢি পড়ে গেলো, সিরিয়া থেকে একটি কাফেলা প্রচুর খাদ্য সামগ্রীসহ উপস্থিত হয়েছে। শুধু উট আর উট। এ কাফেলাটি ছিলো আবদুর রহমানের। এ কাফেলায় ছিলো পাঁচশো মতান্তরে সাতশো উট। জানা যায় উটসহ হযরত আবদুর রহমান পুরা বাণিজ্য কাফেলাই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করে দেন।
এতকিছু দান করার পরও তিনি ছিলেন অঢেল অর্থের মালিক। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আল্লাহ পাক আমার ব্যবসায় এতই রহমত দান করেছেন যে, আমি যদি কোন স্থান থেকে একটি পাথর উঠিয়ে নেই, তবুও তার নিচে স্বর্ণ পাওয়া যায়’।
হযরত আবদুর রহমান (রা.) সবার কাছে এত গ্রহণীয় ব্যক্তি ছিলেন যে, হযরত আলী (রা.) হযরত মুহাম্মদ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘আবদুর রহমান আসমান ও যমীনের বিশ্বাস ভাজন ব্যক্তি’। সবথেকে বড় কথা হলো হযরত আবদুর রহমান (রা.) ছিলেন সেই দশজন সাহাবীর একজন, যাঁরা কিনা দুনিয়াতেই বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন।