প্রথম কথা: মুহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা বড়ই দয়াবান যে, তিনি আমাদের উপর কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। কুরআন এমন একটি কিতাব যার মাধ্যমে আরবের সেই জাহেলী জাতি সৌভাগ্যবান জাতিতে পরিণত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন দিয়েই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ তৈরি করেছিলেন। এতো গুরুত্বপূর্ণ কিতাব আল কুরআন শিক্ষা আজ আমাদের কাছে অবহেলিত। দিন দিন কুরআন শিক্ষা থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। একজন মুসলিম হিসাবে কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব ও যথাযথ ভাবে অনুধাবন করতে পারছি না। মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য হলো কুরআন হাদীস বুঝে দ্বীনের সঠিক পথের দিশা পেয়ে মানব জাতীর দুনিয়ার কল্যাণ ও আখেরাতের মুক্তির জন্যে ঈমানী দায়িত্ব পালন করা, কিন্তু আফসুস কুরআন চর্চা কুরআন বুঝা আশানুরূপ ফল হচ্ছে না, সেজন্য আমাদেরকে কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে।
কুরআন শব্দের অর্থ: পাঠ করা,যা পাঠ করা হয়। আর পরিভাষায়-আল্লাহ তাআলা জিবরাঈল (আ.)এর মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে মানব জাতিরহেদায়াত হিসাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামর উপর যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তার নাম আল কুরআন। (আল মুজামুল ওয়াসিত ও মায়ারিফুল কুরআন,বাংলা, মূল-মুফতি শফী (রহ.) মূলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনটাই কুরআন কেননা কেউ যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ নেতৃত্বে পরিচালিত দ্বীন প্রতিষ্ঠার ২৩ বছরের সংগ্রামী জীবন থেকে কুরআনকে বোঝার চেষ্টা করে, তবেই এ কিতাবকে সহজে ও সঠিকভাবে বোঝা যাবে। শুধু কুরআন বা এর অনুবাদ থেকে যদিএ কিতাবকে কেউ বুঝতে চায় তাহলে সে কিছুই বুঝতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ২৩ বছরের নবুওয়াতী জীবনের পুরা চিত্র রপ্ত করে সে আলোকে কুরআন বুঝার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা তো কুরআনকে আলাদা ভাবে বই হিসেবে পাঠাননি। যে রাসূলের উপর কুরআন নাযিল হয়েছে, তাঁর উপরই এ কিতাব বোঝানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ কিতাবের আসল অর্থ, সঠিক ব্যাখ্যা ও যাবতীয় শিক্ষা একমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন। তাই তিনিই কুরআনের একমাত্র বিশ্বস্ত ব্যাখ্যাকারী বা মুফাসসির। এ পর্যন্ত যত তাফসীর লেখা হয়েছে এবং আরো যত লেখা হবে, তাতে যদি এমন কোনো ব্যাখ্যা থাকে যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাখার বিরোধী, তাহলে তা কিছুতেই শুদ্ধ বলে গ্রহণ করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাখ্যার বিরোধী না হলে যত নতুন কথাই বলা হয়েছে বা হবে তা বিবেচনা করা যেতে পারে এবং যুক্তিপূর্ণ মনে হলে মেনে নেয়া চলে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের বাস্তব নমুনা: তিনিই আসল কুরআন ও জীবন্ত কুরআন। তাঁর কথা, কাজ ও অনুমোদন কুরআনেরই ব্যাখ্যা। এ কারণেই হাদীসকেও ওহী বলে বিশ্বাস করতে হবে। তবে কুরআনের শব্দ যেমন ওহী, হাদীস তেমন নয়। হাদীসের ভাষা ওহী নয় বটে, কিন্তু হাদীসের ভাব ও মর্ম অবশ্যই ওহী। তাই হাদীস কুরআনেরই ব্যাখ্যা। এ জন্য কুরআনের হিফাযতের প্রয়োজনেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী ও হাদীসকে আল্লাহ তাআলা হিফাযত করেছেন। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক পরিচালিত দ্বীন প্রতিষ্ঠার ২৩ বছরের সংগ্রামী জীবন থেকে আলাদা করে কুরআন বোঝার কোনো উপায় নেই। কেউ এ দ্বীন প্রতিষ্ঠার ২৩ বছরের সংগ্রামী জীবনে নিজেকে সম্পৃক্ত করুক বা না করুক, কুরআন বুঝতে হলে তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিচালিত ২৩ বছরের সংগ্রামী জীবনের গতিধারা, এর বিভিন্ন যুগ ও স্তর সম্পর্কে অবশ্যই ভালো করে বুঝতে হবে এবং ঐ সংগ্রামী জীবনের সাথে মিলিয়েই এ মহান কিতাবকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
মূল কথা হলো, দুনিয়ার জীবনটা কীভাবে কাটালে দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি পাওয়া যাবে। সে কথা শিক্ষা দেয়ার জন্যই কুরআন এসেছে। দুনিয়াদারি বাদ দিয়ে বৈরাগী, সন্ন্যাসী ও দরবেশ হওয়ার শিক্ষা দিতে কুরআন আসেনি। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হলে ঘর-সংসার, রুজি- রোজগার, বিয়ে-শাদি, খেত-খামার, ব্যবসা-বাণিজ্য, শাসন-বিচার, যুদ্ধ-সন্ধি ইত্যাদি যত কিছু মানুষকে করতে হয় সবই যাতে আল্লাহর হুকুম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তরীকা অনুযায়ী এসব করা হলে দুনিয়াদারিও দ্বীনদারিতে পরিণত হয়। আর ঐসব কাজ যদি মনগড়া নিয়মে করা হয়, তাহলে সবই শয়তানের কাজ বলে গণ্য। মুমিনের জীবনে দ্বীনদারি ও দুনিয়াদারি আলাদা নয়। আল্লাহর হুকুম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তরীকা অনুযায়ী চললে গোটা জীবনের সব কাজই দ্বীনদারি বলে গণ্য। কারণ কুরআনের বিষয়বস্তুই হলো মানুষের জীবন। অর্থাৎ কিসে মানুষের কল্যাণ এবং কিসে-অকল্যাণ এ কথাই কুরআনের মূল বিষয়বস্তু। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য ও বক্তব্য হচ্ছে, মানুষকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতি অবলম্বনের প্রতি আহবান জানানো এবং আল্লাহর হিদায়াতকে দ্ব্যর্থহীনভাবে পেশ করা।
কুরআনের বৈশিষ্ট:
প্রথমত: মানুষের জীবনের জন্যে যে কথাগুলি বেশি গুরুত্বপূর্ণ সে গুলি কুরআনে একই কথা বার বার উল্লেখ করা হয়েছে-যেন মানুষের মন-মগজে যেই বিষয়গুলো ভালোভাবে ঢোকে। এবং বারবার একই ভাষা বা শব্দে, নতুন ভঙ্গিতে ও আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে একটি কথাকে পূর্ণরূপে হজম করাবার জন্যই বলা হয়েছে। বিশেষ করে আল্লাহর গুনাবলী, তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত, কিতাব, ঈমান, তাকওয়া, সবর, তাওয়াক্কুল ইত্যাদি এ বিষয়গুলো এতই গুরুত্বপূর্ণ যে এ সবের পুনরুক্তি ব্যাপক হওয়াই স্বাভাবিক।
দ্বিতীয়ত: কুরআন হলো একজন মানুষের দুনিয়ার জীবন যাপনে ইসলামী বিধানের নকশা-আল্লাহর তৈরী এ নকশা অনুযায়ী ইসলামের বিরাট সৌধ গড়ার দায়িত্ব যে ইঞ্জিনিয়ারকে দেয়া হয়েছে তিনিই হলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি কুরআনে দেয়া পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করে ইসলামের পরিপূর্ণ রূপ প্রকাশ করেছেন।
কুরআনের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা অনুধাবনের উপায়: কুরআন মাজীদকে বুঝতে হলে প্রারম্ভিক সূত্র হিসেবে এ কিতাব নিজে এবং এর উপস্থাপক হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে, মূল বিষয় বিবৃত করেছেন তা গ্রহণ করতে হবে। এ মূল বিষয় হলো যেমন-সমগ্র বিশ্ব জাহানের প্রভু, সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও একচ্ছত্র শাসক সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের অংশ বিশেষ এ পৃথিবীতে মানুষকেসৃষ্টি করেছেন। তাঁকে দান করেছেন জানার, বুঝার ও চিন্তা করার ক্ষমতা। ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার, ইচ্ছা ও সংকল্প করার এবং নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করার স্বাধীনতা দান করেছেন। এক কথায় মানুষকে একধরনের স্বাধীনতা দান করে তাঁকে দুনিয়ায় নিজের খলিফা বা প্রতিনিধি পদে অভিষিক্ত করেছেন। মানুষকে এই পদে নিযুক্ত করার সময় বিশ্ব জাহানের প্রভু সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানুষের মনে একথা দৃঢ় বদ্ধমূল করে দিয়েছিলেন- আমিই তোমাদের এবং সমগ্র সৃষ্টিলোকের একমাত্র মালিক, মাবুদ ও প্রভু। আমার এই সাম্রাজ্যে তোমরা স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী নও, কারোর অধীন নও এবং আমার ছাড়া আর কারোর তোমাদের বন্দেগী, ও আনুগত্য লাভের অধিকারও নেই। দুনিয়ার এই জীবনে তোমাদেরকে কিছু স্বাধীন ক্ষমতা-ইখতিয়ার দিয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি আসলে তোমাদের জন্যে পরীক্ষাকাল। এই পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে তোমাদের আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। তোমাদের কাজগুলো যাচাই বাছাই করে আমি সিদ্ধান্ত নেবো তোমাদের মধ্য থেকে কে সফল হলো এবং কে হলো ব্যর্থ।
এ কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পর বিশ্ব জাহানের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ মানব জাতিকে পৃথিবীতে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মানব জাতির দুই সদস্য (আদম ও হাওয়া) বিশিষ্ট প্রথম গ্রুপকে তিনি পৃথিবীতে জীবন যাপন করার জন্যে বিধান দান করেন। এই বিধান অনুযায়ী তাঁদের এবং তাঁদের সন্তান সন্তুতিদের দুনিয়ার সমস্ত কাজ কারবার চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের এই প্রাথমিক বংশ ধরেরা মূর্খতা, অজ্ঞতা এবং অন্ধকারের মাঝে সৃষ্টি হননি। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে তাঁদের জীবন সুচনা করেন সম্পূর্ণ আলোর মধ্যে। তারা সত্যকে জানতেন। তাঁদেরকে জীবন বিধান ইসলাম দেয়া হয়েছিলো। আল্লাহর আনুগত্য ছিল তাঁদের জীবন পদ্ধতি।
আল্লাহ যদি তাঁর স্রষ্টা সুলভ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিপথগামী মানুষদেরকে জোর পূর্বক সঠিক কর্মনীতি ও জীবনধারার দিকে ঘুরিয়ে দিতেন তাহলে তা হতো মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত সীমিত স্বাধীনতা দান নীতির পরিপন্থী। আবার এ ধরনের বিদ্রোহ দেখার সাথে সাথেই তিনি যদি মানুষকে ধ্বংস করে দিতেন তাহলে সেটি হতো সমস্ত মানব জাতিকে পৃথিবীতে কাজ করার জন্যে তিনি যে সময় ও সুযোগ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তাঁর সাথে অসামঞ্জস্যশীল। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে তিনি যে দায়িত্বটি গ্রহণ করেছিলেন সেটি ছিল এই যে, মানুষের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে কাজের মাঝখানে যেসব সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে তাঁর মধ্য দিয়েই তিনি তাঁকে পথ নির্দেশনা দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। (কুরআন বুঝা সহজ, আধুনিক প্রকাশনী)
কিভাবে আমরা সঠিকভাবে কুরআন বুঝব? কুরআন সঠিকভাবে বুঝার জন্য কুরআন গবেষণার সঠিক নিয়ম-নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। সে সব নিয়ম-নীতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরছি।
কুরআন বুঝার সহজ পথ অনুসরণ, এ কথটির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে:
এক: কুরআনের তাফসীর প্রথমত কুরআন দিয়ে করা, তারপর সুন্নাহ দিয়ে এবং তারপর সাহাবাগণের বক্তব্যের মাধ্যমে। তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হল কুরআন দিয়ে কুরআনের ব্যাখ্যা করা। যদি কেউ কুরআনকে বিশুদ্ধরূপে বুঝতে চায় তাহলে তার উচিত সামগ্রিকভাবে কুরআনের প্রতি দৃষ্টি দেয়া এবং পুরো আয়াতের পূর্বাপর বক্তব্যের প্রতি খেয়াল রাখা। পাশাপাশি অন্য সূরায় যদি একই বিষয়ে সাথে সম্পৃক্ত আয়াত থাকে তাহলে সে আয়াতের অর্থ কি তা জেনে নেয়া। যদি কোন আয়াতে বক্তব্য অস্পষ্ট থাকে তাহলে অন্য আয়াতে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে, যদি কোথাও বক্তব্য সংক্ষিপ্ত থাকে তাহলে অন্যত্র বিস্তারিত বক্তব্য থাকবে। যারা কুরআনের কিছু অংশ গ্রহণ করে এবং কিছু অংশ বাদ দেয় আল্লাহ কুরআনে তাদের নিন্দা করেছেন, তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর? সূরা আল-বাকারাহ :৮৫। সুতরাং যাদের অন্তরে রয়েছে সত্য বিমুখ প্রবণতা, তারা ফিতনার উদ্দেশ্যে এবং ভুল ব্যাখ্যার অনুসন্ধানে মুতাশাবিহ আয়াতগুলোর পিছনে লেগে থাকে। সূরা আলে-‘ইমরান : ৭
কুরআন দিয়ে কুরআনের তাফসীরের উদাহরণ: আল্লাহর বাণী, আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন। সূরা ত্বহা:১২৩। এখানে ‘আল্লাহর স্মরণ’ দ্বারা উদ্দেশ্য কি কুরআন, নাকি আল্লাহ যে সব কিতাব নাযিল করেছেন সেগুলো, অথবা তাসবীহ তাহলীলের মাধ্যমে আল্লাহর স্মরণ? আমরা যদি আয়াতটির পূর্বাপর বক্তব্যের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারব যে, আল্লাহর যিকর বা স্মরণ’ দ্বারা এখানে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে, অন্যগুলো নয়; কেননা আল্লাহ বলেছেন, তিনি বললেন, তোমরা উভয়েই জান্নাত হতে এক সাথে নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু। অতঃপর যখন তোমাদের কাছে আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, তখন যে আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না। আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার রব! কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন? তিনি বলবেন, এমনিভাবেই তোমার নিকট আমার নিদর্শনাবলী কুরআন এসেছিলো, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল। (সূরা ত্বহা : ১২৩-১২৬)
এরপর আসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ দ্বারা কুরআনের ব্যাখ্যা দেয়ার বিষয়টি। স্বয়ং আল্লাহই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার সুন্নার মাধ্যমে কুরআনের ব্যাখ্যা দেয়ার বিষয়টি অনুমোদন করেছেন। আল্লাহ বলেন, এবং তোমার প্রতি নাযিল করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষের জন্য স্পষ্ট করে দিতে পারো ,যা তাদের প্রতি নাযিল হয়েছে আর যাতে তারা চিন্তা করে। সূরা আন-নাহল :৪৪। ইমাম শাফেয়ী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সব হুকুম দিয়েছেন তার সবই তিনি কুরআন থেকে যা বুঝেছেন তার অন্তর্ভুক্ত। কেননা আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি যথাযথ ভাবে কিতাব নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষের মধ্যে ফয়সালা কর সে অনুযায়ী যা আল্লাহ তোমাকে দেখিয়েছেন। আর তুমি খিয়ানতকারীদের পক্ষে বিতর্ককারী হয়োনা না। সূরা আন-নিসা: ১০৫। কুরআন ও সুন্নাহ দিয়ে কুরআনের তাফসীর করা না গেলে সে ক্ষেত্রে কুরআনের তাফসীর করতে হবে সাহাবাগণের বক্তব্যের মাধ্যমে; কেননা তারাই কুরআন নাযিলের অবস্থা ও প্রেক্ষাপট সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন, যা অন্যরা করতে পারেনি। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে থেকে তারা সঠিক ইলম, প্রজ্ঞা ও ইসলামের মূল মাকাসিদের জ্ঞান দ্বারা আলোকিত হয়েছিলেন। আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা.) বলেন, ‘ঐ সত্ত্বার শপথ যিনি ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য আর কেউ নেই, আল্লাহর কিতাবে যে আয়াতই নাযিল হত, আমি জানতাম সে আয়াতটি কার সম্পর্কে নাযিল হয়েছে এবং কোথায় নাযিল হয়েছে। আমার চেয়েও কিতাবুল্লাহ সম্পর্কে বেশি জানে এমন কারো সন্ধান পেলে অবশ্যই আমি তার কাছে আসতাম।’ তিনি আরো বলেন, আমাদের এক ব্যক্তি যখন দশটি আয়াত শিখত, তিনি সেগুলোর অর্থ ভালভাবে হৃদয়াঙ্গম করা ও আমল করা ছাড়া সেগুলো অতিক্রম করে অন্য আয়াতের দিকে যেতেন না। হাফিয ইবন কাসীর, তারা ইলম ও আমলের মধ্যে চমৎকার সমন্বয় সাধন করেছিলেন।
দুই : আসবাবুন নুযূল তথা নাযিলের কারণ ও প্রেক্ষাপট জানা। আল-কুরআন মূলত আল্লাহর কালাম বা বক্তব্য, যার একটি শাব্দিক অর্থ রয়েছে। অনেক সময়ই সে শাব্দিক অর্থ বুঝার জন্য প্রয়োজন সার্বিক প্রেক্ষাপট ও যাদের উদ্দেশ্যে সম্বোধন তাদের বিষয়টি অবগত হওয়া। এটি জানা না থাকলে কুরআনের আয়াত নিয়ে মুসলিম মানসে দেখা দিতে পারে নানা সমস্যা ও সংশয়। বুকাইর নামক একজন আলেম প্রখ্যাত তাবেয়ী নাফে‘কে জিজ্ঞাসা করলেন, হারুরী সম্প্রদায় সম্পর্কে ইবন উমারের অভিমত কেমন ছিলো? তিনি বললেন, তিনি তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্টিরঅধম বলে মনে করতেন; কেননা কাফিরদের ব্যাপারে নাযিলকৃত আয়াতসমূহকে তারা মুমিনদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করত। তিন : আরবী ভাষা জানা। কুরআন সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। অতএব যে সঠিকভাবে কুরআন বুঝতে চায় তাকে অবশ্যই আরবী ভাষা বুঝতে হবে। সাথে সাথে কথায়, কাজে ও কুরআন নাযিলের নানা প্রেক্ষাপটে আরবদের ‘আদাত ও প্রথার সাথে পরিচিত হতে হবে।
এ তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে যদি আমরা এমন তাফসীর পেতে চাই যা আমাদেরকে কুরআন সঠিকভাবে বুঝতে সাহায্য করবে, তাহলে আমাদেরকে এমন তাফসীর ও ব্যাখা গ্রন্থ চয়ন করতে হবে যাতে উক্ত তিনটি বিষযয়ের প্রতি যথেষ্ঠ গুরুত্ব রয়েছে। এ ধরনের তাফসীর ও ব্যাখ্যা গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, হাফিয ইবন কাসীরের তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, শায়খ আবদুর রহমান আস-সাদীর তাইসীরুল কারীম আর-রাহমান, আবু বাকর আল-জাযায়েরীর আইসারুত তাফাসীর, আবুল আলা মাওদুদীর তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ কুতুবের ফী যিলালিল কুরআন, ড. মুহাম্মাদ আল-আশকার এর যুবদাতুয তাফাসীর ইত্যাদি।
পরিশেষে বলবো, কুরআন বুঝা সহজ কেননা আল্লাহই তা আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। কিন্তু কুরআন বুঝার সঠিক পদ্ধতি আমাদের অনুসরণ করতে হবে। সঠিক পদ্ধতির অনুসরণ ছাড়া যে যার মত কুরআন বুঝার চেষ্টা করলে পদস্খলন অনিবার্য। আল্লাহ আমাদেরকে সকল ভুল বিভ্রান্তি হতে মুক্ত থেকে বিশুদ্ধভাবে কুরআন বুঝার ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের তাওফীক দান করুন। আমীন। সমাপ্ত