সাধারণভাবে নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাতকেই শুধু ইবাদত মনে করা হয়। বেশির ভাগ মুসলমানএসব ইবাদতে নিয়োজিত থাকতে পেরে নিজেকে ধন্যও মনে করেন এবং মনে মনে ভাবেন- এগুলোইশুধু ইবাদত। সেজন্য একজন মুসলমান নামাজও পড়েন আবার একই সাথে নিজের চেতন অথবা অবচেতনমনেই ইসলামবিরোধী কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েন। আল্লাহ ঘোষণা করছেন- ‘সৎকর্ম শুধু এই নয়যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হলো এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহরওপর, কিয়ামত দিবসের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং সমস্ত নবী-রাসূলের ওপর; আর সম্পদ ব্যয়করবে তাঁরই মহব্বতে আত্মীয়স্বজন, এতিম-মিসকিন, মুসাফির, ভিক্ষুক ও মুক্তিকামীক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দেয় এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞাসম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগশোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্যধারণকারী, তারাই হলোসত্যাশ্রয়ী; আর তারাই পরহেজগার।’ [সূরা বাকারা : ১৭৭]। পবিত্র কুরআনেরব্যাখ্যানুযায়ী বিপদে ধৈর্যধারণ করা, কৃত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা ও রোগশোকে নিজেকেস্থির রাখাও ইবাদত। পবিত্র কুরআন বলছে- ‘হে ইমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তি ওশুভ-অশুভ নির্ধারণের তীর অপবিত্র শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা এগুলো থেকে দূরে থাকো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ [সূরা মায়েদা : ৯০]। পবিত্র কুরআনের এ আয়াতে যানিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেসব কাজ করা থেকে বিরত থাকাই ইবাদত। মদ, জুয়া ও মূর্তিপূজানিষিদ্ধ; সেগুলো থেকে মুক্ত থাকাও ইবাদত। পবিত্র কুরআনের এসব আয়াতকে বুঝতেব্যাখ্য-বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না।
একটু খেয়াল করলে পরিষ্কার হয়ে ওঠে, পবিত্র কুরআনে মুসলমানদের জন্য সুদ হারাম করাহয়েছে। কুরআন বলছে- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছেতা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হও।’ [সূরা বাকারা : ২৭৮]। সহি মুসলিম শরিফের হাদিসেএসেছে- ‘হজরত জাবের রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেন, সুদগ্রহীতা, সুদদাতা, সুদেরলেখক এবং সুদের সাক্ষী সবাই সমান অপরাধী।’ [খণ্ড-৩, অধ্যায়-৬২৮, হাদিস নম্বর ৩৮৮১]।অথচ সুদের কারবারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি করার জন্য মুসলমানেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন।আবার এসব সুদ-কারবারি প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই একটি ফরজকে উপেক্ষা করে আরেকটি ফরজ নামাজজামাতের সাথে পড়াকে একমাত্র ইবাদত ভেবে পরিতৃপ্তির চাদরে নিজেকে ঢেকে রাখা হচ্ছে।কিন্তু মানুষ বেমালুম ভুলে যাচ্ছে যে, ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবন থেকে সুদকে প্রতিরোধকরা এবং সেখান থেকে নিজেকে দূরে রাখা মুসলমানদের জন্য একটি মস্তবড় ফরজ ইবাদত। সেইইবাদতের তোয়াক্কা না করে একই সাথে সুদভিত্তিক কারবারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি আবারসেখানেই লম্বা জামাত করে নামাজ আদায় করি- এ রকম মুসলমানিত্বের অনুমোদন ইসলামে হয়তোপাওয়া যাবে না। তা ছাড়া ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে হালাল উপার্জন। কীসাঙ্ঘাতিকভাবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক এসব কার্যকলাপ অবলীলায় মুসলমানদের জীবনেপ্রতিনিয়ত ঘটে চলছে ।
আরো একটু গভীরভাবে ভাবলে দেখা যায়, কি রাজনৈতিক জীবন, কি রাষ্ট্রীয় জীবন, কিঅর্থনৈতিক জীবন, কি সামাজিক জীবন, পারিবারিক জীবন, ব্যক্তি জীবনসহ সব বিষয়েমুসলমানদের জীবন ইসলামের সাথে মারাত্মকভাবে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে। আল্লাহ ঘোষণাকরছেন- ‘হে নবী, মুসলিম মহিলাদের বলেন, তারা যেন নিজেদের চক্ষুদয়কে অবনমিত রাখে এবংনিজেদের লজ্জাস্থানগুলোর হেফাজত করে ও নিজেদের সাজসজ্জা না দেখায়…।’ [সূরা নূর :৩১]। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বেশির ভাগ মুসলিম মেয়ে আজ এ আয়াতের নির্দেশনাকে পাশকাটিয়ে প্রতিনিয়ত বিউটিপার্লার চর্চা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে। পবিত্র কুরআন ওহাদিস মেয়েদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করাকে নিষিদ্ধ করেছে, অথচ মুসলিম সমাজে মেয়েদেরসৌন্দর্য প্রদর্শনের যেন মিছিল শুরু হয়েছে। সেই মিছিলকে আরো বিকশিত করার লক্ষ্যেনগর-বন্দরের অলিগলিতে গড়ে উঠেছে অগণিত বিউটিপার্লার। বিউটিপার্লারগুলো বলছে, এমনভাবে তোমাকে সাজিয়ে দেয়া হবে যেন চোখের পলক না পড়ে। আর কুরআন-হাদিস বলছে- ‘তোমারদৃষ্টিকে অবনমিত রাখো, তোমরা তোমাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়িও না’। বলাবাহুল্য, এসব বিউটিপার্লার থেকে সেজেগুজে বিয়ের অনুষ্ঠান, জন্মদিনের অনুষ্ঠান কিংবাপার্টিতে যোগ দিয়ে সৌন্দর্য প্রদর্শনের মহড়া দিচ্ছেন মুসলিম নারী-পুরুষেরা, যাপ্রত্যক্ষভাবে কুরআন অবমাননার সাথে সম্পৃক্ত। শুধু তা-ই নয়, ইসলামপরিপন্থী ফ্যাশনশোগুলোতে মুসলিম তরুণ-তরুণীদের ভিড় দেখে হতবাক না হয়ে পারা যায় না। বিশেষ ভঙ্গিমায়সেখানে নিজেকে উপস্থাপন করে মিডিয়ার মাধ্যমে সমগ্র দুনিয়াকে তাদের সৌন্দর্য উপভোগকরার সুযোগ করে দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছেন, যা ইসলামী বিধানের সাথে সম্পূর্ণরূপেসাংঘর্ষিক। এসব বিষয়ে কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজেকে বিরত রাখাএবং অন্যদেরও তা থেকে বিরত রাখার পরিবেশ তৈরি করে দেয়াকেও নামাজ-রোজার মতো পরিপূর্ণইবাদত বলা হয়ে থাকে। অভিভাবকেরা যদি তাদের সন্তানদের এসব থেকে দূরে রাখতে পারেন, তাহলে সেটিও তাদের ইবাদতের মধ্যে গণ্য হবে বলে বিশিষ্ট আলেমগণ মনে করেন। আর এসববিলাসিতার প্রভাবেই পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে।
ইসলামী জীবনবিধানে শুধু উপাসনাকে ইবাদত বোঝায় না। ‘ইবাদত’শব্দটি ব্যাপক অর্থেব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইবাদতের আরবি মূল শব্দ হচ্ছে ‘আবদুন’, যার অর্থ গোলাম, চাকর বাসার্ভেন্ট। তাহলে ‘ইবাদত’শব্দের অর্থ দাঁড়ায় গোলামি করা। অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁররাসূলের নির্দেশিত পন্থায় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পরিচালিত করার নামই হচ্ছে ইবাদত।মানুষকে সৃষ্টিও করা হয়েছে সেই ইবাদতের উদ্দেশ্যে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ঘোষণাকরছে- ‘জিন ও মানুষ জাতিকে আমি শুধু আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’অন্য একআয়াতে বলা হয়েছে- ‘তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর ও রাসূলের, আর যদি তোমরা তা থেকে মুখফিরিয়ে নাও তাহলে জেনে রাখো আল্লাহ কাফেরদের ভালোবাসেন না।’ [সূরা ইমরান : ৩২]। এদু’টি আয়াতেই ইবাদতের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মানবজীবনের সর্বস্তরে আল্লাহরনির্দেশের প্রতি আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর আনুগত্য করার মানে যে শুধু নামাজপড়া, রোজা রাখা, হজ করা, জাকাত দেয়া এবং এসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা; তা নয়। আল্লাহঘোষণা করেন- ‘আমি মানব জাতিকে আমার প্রতিনিধি করে সৃষ্টি করেছি, আর অন্যসব জীবকেসৃষ্টি করেছি মানুষের কল্যাণের জন্য। মানুষ আমার হুকুম পালন করবে; আমার খেলাফতেরদায়িত্ব পালন করবে।’কুরআন শরিফের এ আয়াতটিও ইবাদতের পরিচয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণাউপস্থাপন করেছে। পবিত্র কুরআনের সূরা জুমআর একটি আয়াত ইবাদতের সংজ্ঞাকে আরোপরিষ্কার করে দিয়েছে। বলা হয়েছে- ‘নামাজ আদায় করার পর জমিনে ছড়িয়ে পড়ো, আল্লাহরঅনুগ্রহের সন্ধানে ব্যাপৃত হও এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো; যাতে তোমরা সফলকামহও।’ [ সূরা জুমআ : ১০]। পবিত্র কুরআনের এসব বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, নিজেরআয়-রোজগার, তার থেকে ব্যয়, আহার-নিদ্রা, পোশাক-আসাক, আত্মীয়স্বজন, পরিবার-পরিজন, পিতামাতা সব কিছুর ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশিত রূপরেখায় নিজেকে মানিয়ে চলার নামইহচ্ছে ইবাদত। ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক কিছু দায়িত্বেসম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করাও ইবাদতের আওতায় পড়ে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণাকরেন- ‘আর তোমরা সম্মিলিতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো এবং তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়োনা।’ [সূরা আল ইমরান : ১০৩]। কুরআন বলছে- ‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভালো কাজের এবং বারণ করবে অন্যায়কাজ থেকে; আর তারাই হলো সফলকাম।’ [ সূরা আল ইমরান : ১০৪]। কাজেই মানুষকে ভালো কাজেরজন্য ডাকা এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য প্রচেষ্টা করাও ইবাদতের অন্তর্ভূক্ত ।======