Originally posted 2013-03-20 06:13:55.
হাফেজ ইমদাদুল হক
ইসলাম সার্বজনীন এক জীবনাদর্শ, যা মানুষকে এমন নীতি-নৈতিকতা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়ে থাকে যার মাধ্যমে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি, ধন-সম্পদ ও মান-মর্যাদার হিফাজত হয়। ইসলাম মানবজাতির পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এতে জীবনের প্রতিটি বিষয় সুবিন্যস্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে মানুষের যা কল্যাণ তা গ্রহণ এবং যা অকল্যাণ তা পরিহার করার জন্য সস্পষ্টভাবে নির্দেশ রয়েছে। তাই হাদীস ও মহাগ্রন্থ আল-কুরআন গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে দেখা যায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন আল্লাহর নবী এবং সাহাবায়ে কেরামগণ প্রাণান্তকর চেষ্টা-সাধনা করেছেন। আবার কখনো কখনো নিজেদের অবসাদ দূর করার জন্য মাঝে মধ্যে বিনোদন, কবিতা পাঠ এবং আমোদ-প্রমোদ, আহ্লাদ করেছেন। কিন্তু এ বিষয়গুলো এমনই যে, এর সীমা খুবই নিয়ন্ত্রিত। এর বাইরে গেলে তা হবে হারাম, (নিষিদ্ধ) মাকরুহ, (নিন্দনীয়) মাকরুহ তানযিহী অর্থাত, অনুত্তম। যে বিনোদন দ্বীন থেকে পথভ্রষ্ট হওয়ার অথবা অপরকে পথভ্রষ্ট করার উপায় হয়, তা অবৈধ। আর যে আমোদ-প্রমোদ বা আনন্দ অনুষ্ঠান, মানুষকে কুফরের দিকে নিয়ে যায় না বা গোমরাহ হয় না, তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। আল্লাহ তা’আলার বান্দা হিসাবে মুসলিম তার জীবনের প্রতিটি পর্বকে সাজাতে হবে মহান আল্লাহ তা’আলার নির্দিষ্ট রীতি অনুযায়ী। যাতে তার মধ্যে আল্লাহ তা’আলার দাসত্ব পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত হয়। এই মর্মে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : আপনি বলুন : আমার নামাজ, আমার কোরবাণী এবং আমার জীবন ও মরন বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে। তাঁর কোন অংশীদার নেই। আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আনুগত্যশীল। (সূরা আনআ’ম-১৬২/১৬৩)
উক্ত আয়াতের অর্থ এই যে, আমার নামাজ, আমার সমগ্র ইবাদত, আমার জীবন, আমার মরণ-সবই বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে নিবেদিত। এটিই হচ্ছে পূর্ণ বিশ্বাস ও আন্তরিকতার ফল। মানুষ জীবনের প্রতিটি কাজে ও প্রতিটি অবস্থায় একথা মনে রাখবে যে, আমার এবং সমগ্র বিশ্বের একজন পালনকর্তা আছেন, আমি তার দাস এবং সর্বদা তার দৃষ্টিতে রয়েছি। সৃষ্টির শুরু থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মানুষের জীবনাচারের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে তাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে মিশে আছে হাসি-তামাশা ও আনন্দ-রসিকতা। এ ক্রিড়া-কৌতুক ও আনন্দ-রসিকতা মানুষের জীবনে বয়ে আনে এক অনাবিল প্রান চাঞ্চল্য ও উদ্যমতা। মানুষকে করে ঘনিষ্ঠ। তাদের আবদ্ধ করে এক অকৃত্রিম ভালবাসার মায়াডোরে। বর্তমানে মানুষের মাঝে ক্রিড়া-কৌতুক ও হাসি-তামাশার প্রচলন একটু বেশি। তাই তার ধরণ-প্রকৃতি, হুকুম ও প্রকার এবং এ বিষয়ে শরয়ী দৃষ্টিকোণ কি? সে সম্পর্কে জানা আবশ্যক হয়ে দাড়িয়েছে। যাতে মুসলমানরা সেগুলো মেনে চলতে পারে ও একঘেয়েমি দূরকারী এ সুন্দর পদ্ধতি পরিত্যাগ করতে না হয় এবং এর শরয়ী দিকনির্দেশনা অবলম্বন করে যেন পুণ্য অর্জন করতে পারে পাশাপাশি নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখতে পারে। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ব্যক্তি জীবনে রসিকতা করেছেন। তিনি রসিকতা করার মাধ্যমে সাহাবাদের রসিকতা করার সীমা বা পরিধি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার রসিকতাগুলো কাউকে কষ্ট দিত না এবং মিথ্যার লেশমাত্রও ছিল না। হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার তাকে এ বলে সম্বোধন করেছিলেন : (হে দুই কান বিশিষ্ট ব্যক্তি) হাদীসের একজন বর্ণনাকারী আবু উসামা বলেন : অর্থাত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাথে রসিকতা করছিলেন। (আবু দাউদ) এমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুন্দর ও মার্জিতভাবে কথা বলতেন ও রসিকতা করতেন। একইভাবে তিনি সাহাবাদের সুন্দর ও শিক্ষণীয় বিষয়ে রসিকতা করার প্রতি সমর্থন করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাস্তব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল মানব কুলের জন্য এক উজ্জল দৃষ্টান্ত স্বরূপ। তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি কথাও বলতেন না। তার বাস্তব জীবনের প্রতিটি চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, কথা-বার্তা এমনকি কোনো দিকে তাকানোও ছিল বিশ্বমানবের জন্য এক উদার শিক্ষণীয় বিষয়। আমরা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ব্যক্তি জীবন থেকে রসিকতা করার সীমাসহ বাস্তব জীবনের সব ক্ষেত্রে তার আদর্শের ভিত্তিতে আমাদের জীবনকে আলোকিত জীবন হিসেবে গড়ার জন্য সংকল্প বদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : একদা আবিসিনিয়ার কিছু যুবক মদীনা তাইয়্যেবার সামরিক কলা-কৌশল অনুশীলনকল্পে বর্শা ইত্যাদি নিয়ে খেলায় প্রবৃত্ত ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে নিজের পেছনে দাঁড় করিয়ে তাদের খেলা উপভোগ করাচ্ছিলেন। তিনি তাদের বলেছিলেন, খেলাধুলা অব্যাহত রাখো (বুখারী-মুসলিম ও বায়হাকী) অন্য রেওয়াতে আরো আছে তোমাদের ধর্মে শুষ্কতা ও কঠোরতা পরিলক্ষিত হোক এটা আমি পছন্দ করি না।
হযরত হানযালাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হানযালাহ মুনাফিক হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : কীভাবে? আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যখন আপনার কাছে থাকি আর আপনি আমাদেরকে জান্নাত-জাহন্নামের কথা স্মরণ করান, মনে হয় যেন চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছি। যখন আপনার নিকট থেকে চলে যাই আর আমাদের স্ত্রী সন্তান-সন্ততি এবং বিভিন্ন সাংসারিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তখন এর অনেক কিছুই ভূলে যাই। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ : আমার নিকট থাকা কালীন সময়ে তোমাদের অবস্থা যেমন হয় যদি তোমরা সর্বদা ঐ অবস্থায় থাকতে এবং যিকিরের সাথে পূর্ণসময় অতিবাহিত করতে, তাহলে অবশ্যই ফেরেশতারা তোমাদের বিছানায় ও চলার রাস্তায় তোমাদের সাথে করমর্দন করত। কিন্তু হে হানযালাহ কিছু সময় এভাবে কিছু সময় ঐ ভাবে। কথাটি তিনবার বললেন। (মুসলিম)
রাসূলের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা : হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : কোন এক সফরে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ছিলেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন : আমি রাসূলের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রবৃত্ব হলাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পিছনে ফেলে দিলাম। অতঃপর যখন আমার শরীর মোটা হয়ে গেল আবার প্রতিযোগিতা করলাম রাসূল বিজয়ী হলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : এই বিজয় ঐ বিজয়ের পরিবর্তে। (আহমদ, আবু দাউদ, নাসায়ী)
সুতরাং যেকোনো আচার-অনুষ্ঠানে ইসলামের নির্ধারিত সীমা সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে, যাতে করে পাপ তথা সীমা অতিক্রম করে বাড়াবাড়ির পর্যায় যাতে না যায় এটা অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে। আনন্দের নামে কৌতুক করে যাচ্ছেতাই বলা, বা করা, কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : মুমিনগণ, কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তাওবা না করে তারাই যালেম। মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ্ তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু। (সূরা হুজরাত-১১/১২)
হে আল্লাহ! আমাদেরকে ইসলামের নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে, কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনার তাওফীক দান করুন। আমীন….