সালাত হলো সব ইবাদতের শিরোমণি। সালাত আদায়ের ব্যাপারে আল্লাহ সবচেয়ে বেশি তাগিদ করেছেন। বান্দা ও আল্লাহর মাঝে সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার অন্যতম সেতুবন্ধ হলো সালাত। কুরআন শরিফে ৮২ বার ‘সালাত কায়েমের’ নির্দেশ এসেছে। আল্লহ পাক বলেন, (‘আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান আনয়নকারীগণই আল্লাহর মসজিদসমূহ সরগরম রাখে।’ (সূরা তওবা-১৮)।
ঈমানের প্রথম পরীৰা হয়ে যায় নামাজের মাধ্যমে। আজান হওয়ার সাথে সাথে দেরি না করে ঈমান আনয়নকারী ব্যক্তি যখন জামায়াতের সাথে নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে গিয়ে নামাজে শামিল হয়, তখন বোঝা যায় কালেমাপড়-য়া ব্যক্তিটি আল্লহর আনুগত্য তথা ইসলামের যাবতীয় অনুশাসন মেনে চলতে রাজি।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত– রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি আজান শুনে ওজর ছাড়া মসজিদে না গিয়ে একাকী নামাজ আদায় করল, তার নামাজ কবুল করা হবে না। লোকেরা বলল, ওজর কী? রাসূল সা: বললেন, ভয় ও রোগ।’ (আবু দাউদ)।
এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, নামাজ একাকী নয় বরং তা জামাতবদ্ধভাবে আদায় করতে হবে। হজরত আবদুল্লাহ হ ইবনে মাসউদ রা: বলেন, রাসূল সা:-এর যুগে আমাদের অবস্হা ছিল এ রকম- মোনাফেক হিসেবে সুপরিচিত অথবা রোগী ছাড়া আমাদের আর কেউ জামাতবদ্ধ নামাজ থেকে পিছিয়ে থাকত না। এমনকি রোগীও দু’জন লোকের সাহায্যে মসজিদে পৌঁছাত এবং জামাতে অংশগ্রহণ করত। আবদুলস্নাহ ইবনে মাসউদ রা: আরো বলেন, রাসূল সা: আমাদেরকে সুন্নাতুল হুদা (বিধিবদ্ধ সুন্নত) শিক্ষা দিয়েছেন এবং যে মসজিদে আজান দেয়া হয়, সে মসজিদে গিয়ে জামাতে জামাজ পড়াও সুন্নতুল হুদার অন্তর্ভুক্ত। (সুন্নাতুল হুদা বা বিধিবদ্ধ সুন্নত বলা হয় আইনগত মর্যাদা অধিকারী সুন্নতকে, যা করার জন্য উম্মতকে আদেশ দেয়া হয়েছে।)
জামাতে নামাজের মাধ্যমে পরস্পরকে জানার একটা সুযোগ তো আছেই, তারপরও একজন আরেক জনের সুখ-দুঃখে এবং প্রয়োজনে এগিয়ে আসতে পারে। আর এই জামাতে নামাজের কারণে একজন ধনী ও একজন গরিব লোক আলিঙ্গন করে এবং তার কুশলাদি জানতে চায়। একজন মন্ত্রী যখন একজন সাধারণ ব্যক্তির পাশে দাঁড়ান, তখন সাম্য ও মৈত্রীর যে শিৰা মন্ত্রী অর্জন করেন, তাতে মন্ত্রীর রাজত্বের অহমিকা হয়ে যায়। তখন মন্ত্রী সাহেব ভাবতে পারেন, তিনি তো সাধারণ ব্যক্তিকে নিয়েই মন্ত্রী এবং সাধারণ ব্যক্তির কল্যাণ করাই তার নামাজের শিৰা। নামাজের শিৰা তো রক্তপাতের, চাঁদাবাজির, টেন্ডারবাজির শিৰা নয়। হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, একজন অন্ধ সাহাবি হুজুর সা:-কে বললেন, হুজুর আমার কোনো পথপ্রদর্শক নেই, যে আমাকে পথ দেখিয়ে মসজিদের দিকে নিয়ে আসবে, তিনি হুজুর সা:-এর কাছে মসজিদে শরিক না হয়ে ঘরে নামাজ পড়ার জন্য রম্নখসাত চাইতেছিলেন। হুজুর সা: তাকে রম্নখসাত দিলেন। তিনি যখন ফিরে যাচ্ছিলেন হুজুর সা: তখন আবার তাকে ডাকলেন এবং বললেন, তুমি কি (ঘরে বসে) আজানের শব্দ শুনতে পাও? তিনি বললেন হ্যাঁ, তখন হুজুর বললেন, তাহলে তোমাকে মসজিদে হাজির হতে হবে।’সুতরাং উপরি উক্ত হাদিসও জামাতের অপরিহার্যতার একটি অকাট্য প্রমাণ। কেননা মসজিদের কাছে বসবাসকারী একজন অন্ধ সাহাবিকেও হুজুর সা: জামাত তরক করার এজাজত দেননি।
জামাতে নামাজ আমাদেরকে নেতার নির্দেশ পালন করার শিৰা দেয়। রাসূল সা: বলেন, ‘যে ইমামের আগে মাথা ওঠায় সে কি ভয় করে না যে, তার মাথাকে আলস্নাহ গাধার মাথায় রূপানৱর করে দেবেন। (বুখারি শরিফ, আবু হুরায়রা রা:)। সূরা নিসার ১০২ নম্বর আয়াতে আলস্নাহ বলেন- ‘এবং হে নবী যখন আপনি মুসলমানদের সাথে থাকবেন তখন তাদের নামাজ পড়িয়ে দেবেন।’আর এটাই হচ্ছে যুদ্ধের নামাজ আদায় করা সম্পর্কে নির্দেশ। যুদ্ধের মতো কঠিন ও নাজুক পরিসি’তিতেও রাসূল সা: সাহাবাদের নিয়ে জামাতে নামাজ আদায় করেছিলেন।
একদিন একজন লোক আজানের পর নামাজ না পড়েই মসজিদ থেকে বের হয়ে গেল। এ দেখে হজরত আবু হুরায়রা রা: বললেন, ‘ওই ব্যক্তি রাসূল সা:-এর নাফরমানি করল এবং তাঁর পবিত্র আদেশ অমান্য করল।’
তাই আসুন, একটু ভাবি হজরত আবু হুরায়রা রা: জামাত তরককারীদের কী বললেন। এরপরও কি কোনো মুসলমানের জামাত তরক করার সাহস হতে পারে? কোনো ঈমানদার কি নবী করিম সা:-এর নাফরমানি করতে পারে?
রাসূল সা: ও সাহাবায়ে কেরামের জামাতের প্রতি অতিরিক্ত যত্নবান হওয়া দ্বারা ইমামদের কেউ কেউ ফরজ নামাজ জামাতের সাথে আদায় করাকে ফরজে আইন বলেছেন। আবার কেউ কেউ ফরজে কেফায়া বলেছেন। ইমাম আবু হানিফা রা: জামাতে নামাজ পড়াকে সুন্নতে মোয়াক্কাদা বলেছেন। তবে বেশির ভাগ হানাফি আলেমের মতে, জামাতের সাথে ফরজ নামাজ আদায় করা ওয়াজিব।
সালাতের মাধ্যমে আমরা পারিবারিক ও সামাজিক অবৰয় রোধ করতে পারি। সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করতে পারি, অর্থনৈতিক প্রয়োজন, আধ্যাত্মিক প্রয়োজনে, রাষ্ট্রনীতিতে সালাতের গুরম্নত্ব ব্যাপক। আলস্নাহ কর্তৃক আমাদের জন্য নির্ধারিত সবচেয়ে অধিক মাত্রায় পালনীয় ইবাদত হলো সালাত। পবিত্র কুরআনের সূরা ত্বহার ১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, -আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, কাজেই তুমি আমার ইবাদত করো এবং আমাকে স্মরণ করার জন্য নামায কায়েম করো, মুসলমানদের জিন্দেগি হলো জামাতবদ্ধ জিন্দেগি, কিন’ এর ব্যতিক্রম যদি আমরা করতে চাই, তার ফল হবে আমাদের জন্য বেদনাদায়ক ও ভয়ঙ্কর।আমরা অনেক সময় লৰ করি যে, ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে এবং অফিস-আদালতে একা একা দায়সারা গোছের নামাজ সেরে নিই, যা কুরআন ও হাদিসের সুস্পষ্ট পরিপনন্থী।
তাই আসুন সালাত কায়েম থেকে শুরম্ন করে জীবনের প্রতিটি কাজ যেন আমরা জামাতবদ্ধ, সুশৃঙ্খল ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে একটা সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়ে আল্লহর দ্বীনকে আল্লহহর জমিনে বাসৱবায়ন করার মাধ্যমে আলস্নাহর রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরি।
sohrab. hossain manik
আমি একজন চাকরি জীবি তাই কাজের কারনে অনেক সময় জামাতে নামায পরতে পারিনা। অর্থাৎআমাদের বস আমাদেরকে আলাদা আলাদা হয়ে নামায পরতে বলেছেন, তবে নামায আদায় করতে নিশেধ করেন নি তিনি বলেছেন, আজকে যারা জামাতে নামায পরবে আগামী কাল তারা একাকী নামায পরবে এই ভাবে তোমরা সবাই পালাক্রমে জামাতে যাবে একসাথে সবাই নয়। এ্রব্যপারে মাসয়ালা চাইছি।
mamoon
আপনার প্রশ্নের উত্তর নিম্নের প্রশ্নের উত্তরে পাবেন। বিস্তারিতভাবেই উত্তর প্রদান করা হয়েছে; কুয়েতে থেকে প্রকাশিত মাসিক আল-হুদা পত্রিকায়–
প্রশ্ন: অনেক ভাইদের দেখা যায় যে, ঘরে কয়েক জন মিলে জামায়াতে নামায পড়েন। অথচ মসজিদ তাদের বাসার কাছে, আযান স্পষ্ট শুনা যায়। এখানে আমার প্রশ্ন হলো মসজিদ কাছে থাকাবস্থায় বাসায় কয়েক জন মিলে জামায়াতে নামায পড়লে তা ঠিক হবে কি না? আব্দুর রহীম, ফাইহা, কুয়েত।
উত্তর: ইসলামে জামায়াতের সঙ্গে নামায পড়ার খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এর জন্য খুবই তাগিদ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-“তোমরা নামায পড়ো নামাযিদের সাথে।” অর্থাৎ তোমারা জামায়াতসহকারে নামায পড়ো। (সূরা বাকারা: ৪৩) এর ব্যাখ্যায় তাফসীরে জালালাইন, তাফসিরে বায়দাবি ও তাফসিরে কাশশাফ ইত্যাদিতে বলা হয়েছে- “তোমরা মুসল্লিদের সঙ্গে জামায়াতে নামায পড়ো। একা একা পড়ো না। ” নবী কারীম সা. ইরশাদ করেন- “জামায়াতের সাথে নামাযে সাতাশ গুণ বেশি পূণ্য নিহিত রয়েছে। ” (বুখারি, মুসলিম, তিরমিযি) তিনি আরো ইরশাদ করেন- “একা নামায পড়া অপেক্ষা দু’জনে জামায়াতে নামায পড়া উত্তম। দু’জন অপেক্ষা বহুজন মিলে জামায়াতে নামায পড়া আল্লাহর কাছে আরো বেশি পছন্দনীয় এবং উত্তম। ” (আবু দাউদ) তিনি আরো ইরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি এশার নামায জামায়াতের সাথে পড়বে, সে অর্ধরাত বন্দেগির সওয়াব পাবে। যে ব্যক্তি এশা ও ফজর জামায়াতের সাথে পড়বে, পূর্ণ রাত বন্দেগি করার পূণ্য লাভ করবে। ” (তিরমিযি) এজন্য নবীজি সা. কখনো জামায়াত তরক করতেন না। এমনকি অসুস্থ অবস্থায় যখন তিনি হাঁটতে পারতেন না, তখনো দুই সাহাবির কাঁধে ভর করে পা টেনে টেনে নামাযের জামায়াতে হাজির হয়েছেন। জামায়াতবিহীন একা একা নামায পড়েননি। এমন কি নবীজি তো এতটুকুও বলেছে- “আমার তো মনে চায় মুয়াজ্জিনকে আজান দিতে বলব এবং কাউকে নামায পড়াতে বলব আর আমি আগুনের অঙ্গার নিয়ে যাব, যে আজান শুনার পরও মসজিদে জামায়াতে হাযির হওয়ার জন্য বের হয়নি- তার ঘর জ্বালিয়ে দিই। ” (বুখারি, মুসলিম)
উপরের আলোচনা হতে একথা প্রতীয়মান হলো যে, জামায়াতের সাথে নামায পড়া ওয়াজিব। আর একথাও প্রমাণিত হলো যে, এই জামায়াত হতে হবে মসজিদে, কর্মস্থল কিংবা বাসা নয়। বিধানটি তাদের জন্য যারা মসজিদে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে বা সুযোগ রয়েছে। এবং মাকই ছাড়া সাধারণ আজানের শব্দ শুনতে পায়। উপরে বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেন: “আমার তো মনে চায় মুয়াজ্জিনকে আজান দিতে বলব এবং কাউকে নামায পড়াতে বলব আর আমি আগুনের অঙ্গার নিয়ে যাব, যে আজান শুনার পরও মসজিদে জামায়াতে হাযির হওয়ার জন্য বের হয়নি- তার ঘর জ্বালিয়ে দিই। এ হাদীস থেকে বুঝা যায়, কিছু লোক আযান শোনার পরও তারা মসজিদে হাযির না হয়ে বাসায়ই জামায়াতে কিংবা একাকী নামায পড়ে নিতো।
আর জামায়াতে নামাযের যত ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, সবগুলোই মসজিদের জামায়াতের কথা বলা হয়েছে, যা হাদীসের বর্ণনাশৈলী থেকে বুঝা যায়। সুতরাং যদি কেউ নিজ বাসায় কিংবা কর্মস্থলে কয়েক জন মিলে জামায়াতে নামায আদায় করে, তাহলে মসজিদের আদায় করলে যে সাওয়াব অর্জন হত, তা থেকে তারা বঞ্চিত থাকবে। যদিও নামাযের ফরয়িত আদায় হবে যাবে। পক্ষান্তরে যদি কারো উযর থাকে, যে কারণে মসজিদে উপস্থিত হতে পারেন না, এমন ব্যক্তি ঘরে একাকী নামায পড়লেও আল্লাহ তাকে পূর্ণ জামায়াতের সাওয়াব দান করবেন। তবে শর্ত হলো সুস্থ কিংবা উযর মুক্ত অবস্থায় লোকটি যথারীতি জামায়াতের সাথে নামায আদায়ে অবস্থ থাকতে হবে। রাসূল (সা.) বলেন:
إذا مَرِضَ العبدُ أو سافرَ كُتِبَ له مثلُ ما كان يعملُ صحيحاً مقيماً ) . “الشرح الممتع” ( ৪ / ৩২৩ )
যখন কেউ অসুস্থ হয় কিংবা ভ্রমণে থাকে, তাকে সেই সাওয়াব দান করা হবে যা তিনি সুস্থ ও মুকীম অবস্থায় করেছেন। শরহে মুমতে ৪/৩২৩)
সুতরাং আপনার বন্ধুদের বলুন যে, আপনাদের ফরয দায়িত্ব যদিও আদায় হয়ে যায়, কিন্তু মসজিদে জামায়াতের সাথে পড়লে যে সাওয়াব হবে, সেই সাওয়াব হতে বঞ্চিত হবেন, তাই সময় ও সুযোগ থাকলে মসজিদে গিয়েই নামায পড়া জরুরি। আল্লাহ আমাদের সকলকে জামায়াতের সাথে নামায আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমীন