Main Menu
أكاديمية سبيلي Sabeeli Academy

প্রবাসে আনন্দ বেদনার ঈদ

Originally posted 2013-08-02 18:49:27.

আনন্দ বেদনার ঈদ

আনন্দ বেদনার ঈদ

ফজলে এলাহী (সউদী আরব)

এ মহাবিশ্বে বিস্তৃত থকথকে অন্ধকারের মাঝে যেমন আলোক বিচ্ছুরণকারী নক্ষত্রের বিরাজমান, তেমনি আমাদের জীবন জোড়া দুঃখ-বেদনার মাঝে হরেক রকম খুশী-আনন্দ বিরাজমান। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু আনন্দ দরকার, ভূমিগুলো যেভাবে নক্ষত্রের আলোতে উদ্ভাসিত হয় সেভাবেই সেটুকু আনন্দের সমাহারে উল্লাসিত হয় এখানে জীবনের কাফেলা। হরেক রকম আনন্দের মাঝে কিছু তো একান্ত ব্যক্তিগত, আপনার মাঝে আপন ভুবনে আপন মনেই হেসে-হেসে তা উপভোগ্য হয়ে থাকে। এ ছাড়া রয়েছে প্রিয়জনের সাথে ভাগাভাগি করা আনন্দ, পারিবারিক উৎসব, সামাজিক প্রথা, আঞ্চলিক রীতি রেওয়াজ ইত্যাদি। এসবের বাইরেও ধর্মভেদে মানুষদের জন্য রয়েছে বেশ কিছু আনন্দঘন মৌসম অথবা দিনের আয়োজন। যে সবে একাধারে চিত্তে আসে বিনোদন, অন্তরে আসে প্রশান্তি, চরিত্রে যুক্ত হয় উদারতা, উত্তম ব্যবহার, জাগতিক নির্মোহতার মাত্রা উচ্চকিত হয়ে যেখানে ভুলে যেতে সচেষ্ট হয় মানুষেরা নিজেদের মধ্যকার উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ, বুকে বুক মিলিয়ে ধুয়ে মুছে ফেলে অতীত দিনের সকল মনমালিন্য, মুসলিম জীবনে তেমনি এক আনন্দ উৎসবের নাম ‘ঈদ’। ঈদ আসে বছরের দু’বার রমযানের শেষে শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ নিয়ে আসে ‘ঈদুল ফিতর’ বা রোযার ঈদ আর যিলহজ্জের দশ তারিখে ত্যাগের মহিমায় হাজার-হাজার বছরের ঐতিহ্যকে উদ্ভাসিত করে অনুষ্ঠিত হয় ‘ঈদুল আযহা’ বা কুরবানীর ঈদ। দীর্ঘ একটি মাস রোযা রাখার পর পশ্চিমাকাশ জুড়ে ঈদের বাঁকা চাঁদটি দেখার জন্য অপেক্ষমান থাকি আমরা সবাই; আমাদের মাঝে এখন সে আনন্দক্ষণ উপস্থিত। যেন পৃথিবীর চৌকাঠে কখন শব্দ হবে ঠক্ ঠক্ ঠক্.. সে অপেক্ষায় নতুন পোশাক সাজিয়ে, আতর গোলাপ মেখে তৈরী হয়ে থাকি ঈদ উদযাপনের জন্য। কি পবিত্রতায় পরিপূর্ণ মুসলিম সমাজের এই ঈদ আনন্দ। সাধ্যানুযায়ী পবিত্র হয়ে প্রতিজন মুসলিম ছুটে চলে ঈদগাহের পানে। সেখানে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে তাদের পরম প্রিয় প্রভু বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ তা’আলার প্রতি পরিপূর্ণ ভালবাসা, বিনয়ে এবং ভয়ে। প্রতিটি ঈদের নামাযই ঈদের চূড়ান্ত ক্ষণ। তারপর ধীরে-ধীরে আনন্দের ভাগাভাগিতে স্তিমিত হয় ঈদের আনন্দ-রবি। আর এ আনন্দকে দীর্ঘায়িত করা হয়েছে ঈদের দিন ও ঈদের পরবর্তী তিন দিন পর্যন্ত। যদিও এ তিন দিনের ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে রোযা রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে কুরবানীর ঈদের পরবর্তী তিন দিনের বেলায় আর রোযার ঈদে শুধু ঈদের দিনটি। ‘ঈদ’ এ শব্দটি একটি উৎসবের নাম হিসেবে পরিচিত পেলেও এটি একটি ইবাদত, যা মুসলিম সমাজ তাদের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার আদেশে পালন করে থাকে। ঈদ নামক এ আনন্দঘন উৎসবে শরীয়ত সম্মত অনুষ্ঠানাদির সাথে-সাথে অঞ্চলভেদে বেশ কিছু রীতি জড়িয়ে পড়েছে যা আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য থেকে এসেছে। এসবের মধ্যেও কিছু-কিছু বিষয় তো অবশ্যই বর্জনীয়, যেমন: ইসলামী শরীয়তে বর্জনীয় গান-বাজনা, চলচ্চিত্র, নাটক, রেডিও টিভির অনুষ্ঠানাদি, বই-পুস্তকের প্রকাশ প্রদর্শন, দর্শন ইত্যাদি এবং ইসলাম সম্মত উক্ত বিষয়গুলো অবশ্যই গ্রহণীয় এবং বৈধ। এসব ছাড়া জীবনাচারের এমন কিছু দিক ঈদ নামক মুসলমানদের এ উৎসবের সাথে যুক্ত হয়েছে, যে ব্যাপারে ইসলাম নিষেধ করেনি, বরং এতে পারিবারিক, বংশীয়, আত্মীয়তা এবং প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্কে উন্নয়ন ঘটে। তেমনি কিছু ব্যাপার আমাদের অঞ্চলে বিশেষ গুরুত্বের সাথে প্রচলিত রয়েছে। সে সবের মধ্যে রয়েছে: পরিবার, বংশ, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া- প্রতিবেশী সবার সাথে ঈদের দিনে সাক্ষাত করা, সালাম বিনিময় করা, মনোমালিন্য থাকলে ঈদ উপলক্ষে কোলাকুলির মাধ্যমে তার অবসান ঘটানো, একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে মিষ্টিমুখ করা, এমনকি প্রতিবেশীর সাথে জমিজমা সংক্রান্ত বা অন্য কোন বিবাদ মীমাংসার আয়োজন (কেননা, ঈদ উপলক্ষে সবাইকে একত্রে পাওয়া যায়) এবং অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সম্পাদন ইত্যাদি ব্যাপারগুলো খুব সহজেই সম্পাদিত হয় ঈদকে কেন্দ্র করে। এছাড়াও পারিবারিক পর্যায়ে কর্তাগুরুজনদের জন্য, নিজদের এবং ছোটদের জন্য বছরের অন্য সময় কেনা হোক বা না হোক, ঈদে তো অবশ্যই নতুন পোশাক কিনে থাকেন। এটা যেন ঈদের জন্য অনেকটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে, যদিও ইসলামে এ ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধ্যকতা রাখেনি। (তবে ঈদের দিন উত্তম পোশাক পরিধান করা সুন্নত) ব্যক্তি বিশেষে নতুন পোশাক ক্রয় করা এবং কোলাকুলি করাকে বাধ্যতামূলক ভাবার কারণে সতর্ক আলেমগণের কেউ-কেউ এ দুটি বিষয়ে অনুৎসাহিত করে থাকেন। অবশ্য শুধু আনন্দের ভাগাভাগির জন্য এবং প্রচলিত তাই করছি, এ হিসেবে পালিত হলে এবং বাধ্যতামূলক মনে না করে পালন করলে কোন দোষ হবার কথা নয়। তবে এ দু’টো বিষয়কে ঈদের ইবাদত হিসেবে মনে করা এবং এ থেকে সওয়াবের আশা যুক্ত করে বাধ্যতামূলক মনে করলেই দোষনীয় হতে পারে। “প্রবাসীর ঈদ” আমাদের প্রবাসীদের ক্ষেত্রে বিশেষ যে দিকটি, তা হলো আমরা ঈদের এই আনন্দ ভাগাভাগি থেকে বঞ্চিত থাকি। আর তাই ঈদের শরীয়ত নির্দেশিত বিধি-বিধান পালন শেষে অর্থাৎ নামায শেষে আমাদের জন্য আর কিছু বাকী থাকে না। খুব বেশি পরিশ্রান্তরা ঘুমিয়ে পড়েন আর অতি উৎসাহীরা কিছু আনন্দ খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন প্রবাসী কোন আত্মীয়, বন্ধু ও পরিচিত মুখদের সাথে সাক্ষাৎ করতে। কিন্তু দুধের সাধ যেমন ঘোলে মেটে না, তেমনি আমাদের আনন্দগুলো কষ্টে রূপান্তরিত হয়ে যায় আর কষ্টগুলোকে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করি একটা বিষাদীয় হাসির আড়ালে। অবশ্য যারা স্বপরিবারে প্রবাসী তাদের ব্যাপারটা কিছুটা ভিন্ন হবার কথা, তবে কখেনোই পরিপূর্ণ স্বদেশী সুখ নেই। কেননা বৃহৎ পরিবার, আজন্ম দেখা প্রতিবেশী ও স্বজনদের থেকে দূরত্ব সে সুখের একটা বিরাট অংশ কেড়ে নিয়েছে। একটা নতুন জামা কিনে দেয়ার পর সন্তানের মুখের যে হাসি, একাকী পৃথিবীর আর কোথায় তা পাওয়া যাবে? মনে পড়ে, ছেলেবেলায় নতুন জামা পাবার একটা মৌসম ছিল ঈদ। কিন্তু প্রবাসে সে সবের কথা মনে থাকে না, প্রয়োজন হলে নতুন কেনা হয়, তাতে কোন আলাদা আনন্দ থাকে না। মাথার উপর গুরুজনের বুলানো হাতের স্পর্শ কত অর্থের বিনিময়ে খরিদ করা যাবে? ছেলে বেলায় গুরুজনদের সালাম করে পকেট ভারী করার পাওনাটা আজো অসামান্য মনে হয়। আনন্দিত প্রহরগুলোতে প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার আনন্দ ভাষায় সর্বদাই অপ্রকাশিত থাকে। এ ধারার বঞ্চনা আমাদের প্রবাসীদের জন্য খুব স্বাভাবিক। তাই কেউ কাউকে বলি না, বলতে পারি না অথবা বলা যায় না। কেবল নিজের মনে নিজের ভুবনে নিজেই পুড়তে থাকা হয়। আর সব প্রবাসীদের মত আমিও ব্যক্তিগত জীবনে প্রবাসের ঈদগুলোতে তাই তেমন কোন উল্লেখযোগ্য স্মৃতি খুঁজে পাচ্ছি না, সবগুলো ঈদই গতানুগতিক, সুতোয় গাঁথা মালা যেমন। অথবা তসবীহর দানার মত সময় গুণে-গুণে আঙ্গুলের ওপাশটায় এসেছিল আবার সুতো বেয়ে মিশে গেছে নিজের দানাদের সাথে একাকার হয়ে। যা কিছু স্মৃতি, কল্পনার পটে আঁকা অতীত দিনের বাস্তব চিত্র, তা কেবলি ছেলে বেলা এবং কৈশর পেরোনো দিনগুলোতে। এর পরে প্রবাস জীবনের অনেকটাই উষর মরু প্রান্তরের মত উষ্ণ বেদনা আর ধূসরতায় ভরপুর। তবে প্রভুর প্রশংসার স্বতঃস্ফূর্ততায় কোন কার্পণ্যের সুযোগ নেই, আলহামদুলিল্লাহ। পৃথিবীর মানদন্ডে অনেক ভালো আছি। শহরে ঈদের একটি চাঁদরাতের কথা মনে পড়ছে খুব। আমি আর আমার বন্ধু মিলে, আমার ও তাদের পরিবারের ঈদের পোশাক কেনার জন্য বেরিয়েছিলাম ঈদের আগের দিন দুপুরে। তখনকার দিনগুলোই ছিল এমন যে, বেরুনোটাই বড় কথা। কোথায়া যাবো, কি করবো, সে সবের কোন পরিকল্পনা আগে থেকে থাকতো না আমাদের। কেনা-কাটা করতে করতে রাত ১২ টা কি ১ টা করে ফেললাম। বাসায় ফিরে দেখি গ্রাম থেকে আসা বন্ধুর এক দূরসম্পর্কীয় ভাগ্নের জন্য কিছু কেনা হয়নি। কি করা, গুরুজনদের জন্য ছিল মহামুশকিল আর আমাদের জন্য দারুন এডভেঞ্জার, বেরিয়ে পড়লাম রাত আড়াইটায়, গুলিস্তানের দোকানগুলো খুঁজে পেতে তার জন্য পোশাক কিনে ফিরলাম শেষ রাতে। অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর আনন্দটা সেদিন হয়ত তেমনটি বুঝিনি, কিন্তু এখন পুরোপুরি উপলব্ধি করছি। ঈদ মানে আনন্দ, আর আনন্দ তখনি পরিপূর্ণ হয় যখন ধনী-গরীব, স্বজন প্রতিবেশী, সুসম্পর্ক-দুঃসম্পর্ক ইত্যকার ভেদাভেদ ভুলে সবাই একাকার হয়ে যায়। অন্যের তরে নিজের সম্পদ বিলিয়ে দেয়া শিক্ষা দেয় আমাদেরকে ঈদুল ফিতর, যার বাস্তবতা ঈদের আগে-আগে হকদারদের নিকট ফিতরা পৌঁছে দেয়া। ত্যাগেরই আনন্দের পরিপূর্ণতা আসে, দাতা তা দেখতে পান অন্যের হাসিতে সুখে। স্বার্থপরতার বিপরীত উদারতা, ভ্রাতৃত্ব সৌহার্দতা এক অনুপম শিক্ষা নিয়ে বছর-বছর আমাদের দুয়ারে এসে আনন্দের কড়া বাজায় ঈদ। আমরা কি সাড়া দেব না? দেয়া প্রয়োজন পরিপূর্ণ উৎসাহে উদ্দীপনায়, আনন্দে, জীবনের জন্য, জগতের জন্য, আনন্দের জন্য।

Related Post