Originally posted 2013-07-30 15:07:24.
ডা. এইচ. এম. এ. আর মামুনুর রশীদ
মাহে রমযানের রোজা প্রত্যেক বালেগ মুসলমান নর-নারীর জন্য অবশ্যকর্তব্য। দুঃখের বিষয়, এ বরকতপূর্ণ ও কল্যাণময় রোজা বিপুল সংখ্যক জনগণ পেপটিক আলসারভীতির কারণে রাখেন না। আমি ডাক্তার হিসেবে এ বিষয়টি যখন বিজ্ঞান ও ইসলামের দৃষ্টিতে দেখি তখন দেখতে পাই যে, রোজ পেপটিক আলসার সৃষ্টি করে না।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন: হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (সূরা বাকারা: ১৮৩)
রমযান শরীফের রোজা পাগল ও নাবালেগ ব্যতীত নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, অন্ধ-বধির-বধির সকলের উপর ফরয। শরীয়তে বর্ণিত ওজর ব্যতীত রমযানের রোজা না রাখা কারো জন্য বৈধ নয়। এ আয়াতে কারীমা থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল মাহে রমযানের গুরুত্ব এবং ঠুকনো ওজর আপত্তিতে রোজা ছাড়া যাবে না।
বাংলাদেশের কয়েকজন উচ্চপদস্থ গবেষক-ডাক্তার রোজার উপর গবেষণা চালান তার বিবরণ ও গবেষণার ফলাফল বর্ণনা করা হলো। পাকস্থলির এসিড -১৯৫৯ সালের রমযান মাসে ৭ জন রোজাদার ও ৫ জন বেরোজাদার ভলাণ্টিয়ারের পাকস্থলির এসিড (Hcl) পরীক্ষা করা হয় (Gastric Juica Analysis) । রোজার আগে ও পরে বেরোজাদার কণ্ট্রোলদের এসিড প্রায়ই অপরিবর্তিত থাকে, কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। রোজাদারদের সংখ্যা কম বলে দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ১৮ জন ভলাণ্টিয়ারের উপর পরীক্ষা চালানো হয়। উভয় পর্যায়ে মোট ২৫ জন রোজাদারের এসিড ১৭ জনের স্বাভাবিক (Isochlorhydria) ,৭ জনের বেশি (Hypochrlorhydric) এবং ১ জনের কম (Hypochlorhydria) ছিল। রোজার মাসে চতুর্থ সপ্তাহে এদের এসিড দাঁড়ায় ২০ জনের স্বাভাবিক আর ৫ জনের বেশি। ৭ জনের বেশি এসিড রোজা শেষে ৭ জনের স্বাভাবিক হয়ে যায় ও ২ জনের বেশিই থাকে। তবে ১৭ জনের স্বাভাবিক এসিড রোজা শেষে ১৪ জনের এসিড স্বাভাবিক থাকে আর ৩ জনের এসিড বাড়ে। একজনের কম এসিড রোজা শেষে স্বাভাবিক হয়। সুতরাং রোজায় এসিড বৃদ্ধির তুলনায় হ্রাস পায় অনেক বেশি।
পাকস্থলির এসিড: কেউ কেউ মনে করেন যে, রোজায় পাকস্থলির এসিড (Gastric Hcl) বৃদ্ধি পায় এবং ফলে পাকস্থলির বা ক্ষুদ্র অন্ত্রের প্রথমাংশে (Doudenum) ঘা (Peptic Ulcer) হতে পারে। বর্তমান গবেষণায় একথা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তা ছাড়া এরূপ ধারণা শারীরবিদ্যারও বিপরীত। রোজায় পেপটিক আলসার হয় বলে কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণও নেই।
এবার ডাক্তার ক্লীভ সাহেবের গবেষণার দিকে দৃষ্টি দেই। তিনি Peptic Ulcer নামক একটি গবেষণামূলক পুস্তকে যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে বিশ্বের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এ রোগ অনেক কম অথচ দক্ষিণ ভারত, জাপান, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ নাইজেরিয়ায় এ রোগ অত্যন্ত বেশি। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় মুসলমান ও মালয়েশিয়ার মালয়ী মুসলমানদের তুলনায় ঐসব দেশের চীনাদের মধ্যে এ রোগ বেশ কয়েকগুণ বেশি। এ ছাড়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান ও জাপানী বন্দী শিবরের অনাহারক্লিষ্ট যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে কারো Peptic Ulcer বা Ulcer ছিদ্র হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। ডাক্তার ক্লীভ জোর দিয়ে বলেন, Fasting does not produce organic disease’ (দেখুন Cleave T. L. (1962) Peptic Ulcer, John Wright & Sons ltd. Bristol. p-93.)
পেপটিক আলসারে চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের কথা:
পাকস্থলি এবং ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথম অংশ ডুয়োডেনাম-এর মিউকোসাতে ‘ঘা’কে পেপটিক আলসার বলে। এ ছাড়াও ওসোফেগাস (Oesophegus) জেজুনাম (Jejunum) এবং মেকেলস ডাইভারটিকুলাম (Meckels Divertocuium) এ ‘ঘা’ হতে দেখা যায়। ডুয়োডেনাম আলসার সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। ডুয়োডেনামের আলসার মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের বেশি হয়। যারা অনুপাত ১ : ৪। বৃদ্ধ ব্যক্তিদের পাকস্থলিরও ডুয়োডেনাম আলসার উভয়ই হতে দেখা যায়।
পেপটিক আলসারের কারণ:
১। যখন এসিড ও পেপসিন (Acid snd pepsin) মিউকোসার প্রতিরোধের Mucosal defence মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় থাকে না তখন এ রোগের সৃষ্টি হয়।
২। হেলিকোব্যাকটোর পাইলেরি (H. Pylori) এর রোগের জন্য দায়ী।
৩। বংশগত যারা ব্লাড গ্রুপ ‘ও’ এন্টিজেন (Blood group ‘O’ antigen) ক্ষরণ গ্যাস্ট্রিক রসে ভরেন না।
৪। ধূমপায়ী
৫। ক্ষতিকর ওষুধ সেবন। বিশেষ করে এসপিরিনি জাতীয় ওষুধ।
৬। অন্যান্য কারণ।
পেপটিক আলসারের লক্ষণসমূহ
এ রোগে প্রায়ই হয়ে অজীর্ণ থাকে কিন্তু নাভীর উপরে (Epigastric region)- এ ব্যথাই এ রোগের প্রধান লক্ষণ। রোগী এক আঙুল দিয়েও ব্যথার এলাকা দেখাতে পারেন। এটা রোগ নির্ণয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডুয়োডেনাম আলসার রাতে বেশি হয়, অবশ্য দিনেও হয়ে থাকে। যখন রোগী ক্ষুর্ধাত হয় তখন ব্যথা ওঠে। বমি বমি ভাব অথবা বমি হয়। বমি হলে ব্যথা কমে যায়। অনেক সময় পাকস্থলি থেকে এসিড উঠে আসার ফলে জ্বালা-পোড়া অনুভূতি আসে। এটাকে হার্ডবার্ন (Heart burn) বলে। অরুচি এবং ওজন কমে যাওয়া গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণ।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
১। এনডোসকপি: (Endoscopy) এ পরীক্ষার সাহায্যে এ রোগ সহজেই নির্ণয় করা যায়। এ যন্ত্রের সাহায্যে বায়োপসি (Biopsy) নেওয়া যায়, যা রোগের কারণ নির্ণয় করতে সহায়ক হয়।
২। বেরিয়াম মিল X-ray: G X-ray- এর সাহায্যে পাকস্থলি ও ডুয়োডেনাম ঘা ধরা পড়ে।
চিকিৎসা:
এন্ডাসিট (antacid) জাতীয় ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। এসিড কমানোর জন্য ওমিপ্রাজল (Omeprazol) এবং রেনিটিডিন (Ranitidin) বহুল ব্যবহৃতি হয়। ক্ষত পূরণের জন্য সুক্রালফেট (Sucralfate) একটি ভাল ওষুধ।
আমরা পূর্বেই পেটের ব্যথার কারণ হিসেবে ধূমপান লক্ষ্য করেছি। বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, ধূমপান ক্ষত শুকাতে দেয় না এবং রোগ বার বার হওয়াকে ত্বরান্বিত করে। ধূমাপন এসিড ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয় এবং অগ্নাশয় (Pancreas)- এর বাইকার্বোনেট ক্ষরণ হতে বাধা দেয়ে, যারা ফলে পেটে ঘা হয়। (Robbin and kumar. Barsic Pathology. 4th Edition. p- 517)
বাংলাদেশের মানুষসহ পৃথিবীর সবদেশেই ধূমাপান করা যায়। সম্প্রতি দেখা গেছে, ধূমপানের ফলে বিভিন্ন রোগ হওয়ার জন্য উন্নত দেশে এটার হার কমে এসেছে অথচ অনাহারক্লিষ্ট অস্বাস্থ্যবান বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এ হার বেড়ে চলেছে। সুতরাং পেপটিক আলসার থেকে মুক্তি পেতে হলে ধূমপান অবশ্যই ছাড়তে হবে।
পেপটিক আলসারের আর এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ক্ষতিকারত ওষুধ সেবন। এসপিরিন এবং এ জাতীয় ওষুধ যা মাথা ধরা, বাত রোগে সচরাচর ব্যবহৃত হয়। এসপিরিন, ফিনাইলবুটাজোন (Phenylbutazone), ইনডোমিথাসিন (Indomefhacin), আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen), পাইরোক্সিকাম (Piroxicam))। এছাড়াও স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ (Steroid) সেবনে পেটের আলসার বেশি হয়। রক্তক্ষরণ (Hemorrhage) কালো পায়খানা (Malaene) এবং শেষে নাড়ী ছিদ্র হয়ে (Perforation) যায়।
পেটব্যথার রোগী ও রোজা:
যারা পেট ব্যথায় ভোগেন এবং রোজা রাখলে ব্যথা বৃদ্ধি হবে ভাবেন, তাদের জন্য ফয়সালা এই যে, তারা ধূমাপান বন্ধ করবেন। ক্ষতিকারক ওষুধ সেবন করবেন না। ডাক্তার সাহেবের পরামর্শ গ্রহণ করবেন। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলে দেবেন যে, আপনার পেটে ক্ষতিকারক আলসার (Active ulcer) আছে কি না। Endoscopy এর পরীক্ষার জন্য বেশ ভালো। যদি Active ulcer না থাকে তবে অতি সাধারণ ওষুধ খেলে ভালো হয়। তাদের রোজা রাখাতে কোন অসুবিধা নেই, যা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং রোজার জন্য গ্যাস্ট্রিক বেড়ে যাবে- এ অহেতুক ভয়ভীতি মন তেকে বের করে দিয়ে রোজা রাখবেন। আর যাদের পেটে Active ulcer আছে তাদের রোজা রাখা না রাখার ব্যাপারে কুরআনিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছি। পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারায় আল্লাহ পরিষ্কারভাবে বলছেন: যদি তোমাদের কেউ অসুস্থ হও বা ভ্রমণে থাকো তবে সে (রোজা না রেখে) পরে (সুস্থ হয়ে) সেই রোজাগুলির কাযা আদায় করবে। (সূরা বাকারা; ১৮৪) পরবর্তী আয়াতে আল্লাহপাক বলেন: – আল্লাহ তোমাদের কোনও কঠিন দায়িত্ব দিতে চান না বরং দায়িত্ব সহজ করে দিতে চান। (সূরা বাকার: ১৮৫)
যাদের পেট Peptic Ulcer তাজা এবং খালি পেটে খুব ব্যথা হয় তাদের রোজা রাখা উচিত নয়, কারণ তারা অসুস্থ। তাদের ঘন ঘন Alkali/Antacid বা অন্যান্য ওষুধ খেতে হয়। ওষুধ না খেলে Peptic Ulcer Perforation হয়ে যেতে পারে এ অবস্থায় রোজা না রেখে এর কাযা পরে আদায় করে নেবেন। যদি রোগ দুরারোগ্য হয় তবে ফিদইয়া দেবেন।
একজন দিনদার ডাক্তার যদি সার্টিফিকেট দেন যে আপনার পেটে মারাত্মক ‘ঘা’ (Active ulcer) আছে, তাহলে রোজা ছাড়া জায়েয হবে। যদি ডাক্তার কাফির (অমুসলিম) হন অথবা এমন মুসলমান হন যে, তিনি দ্বীন ইসলামের ঈমানের পরওয়া করেন না, তবে তার কথায় রোজা ছাড়া যাবে না।