হজ পরিপূর্ণ জীবনপ্রণালী ইসলামের পাঁচটি খুঁটির অন্যতম। এ ফরজ ইবাদত সামর্থ্যবান মুমিনদের (পুরুষ ও মহিলা) দ্রুত আদায় করা উচিত। হজ পালনের মাধ্যমে এক দিকে যেমন আল্লাহর আদেশ পালিত হয়, তেমনিভাবে অন্য দিকে ব্যক্তির (বিভিন্ন দিক থেকে) উন্নয়নও হয়। হজ মুসলিম বিশ্বকে সব ভেদাভেদ ভুলে (ওয়াতাসিমু বি হাবলিল্লা-হি জামিআ) ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী মহাজাতিতে পরিণত হতে খুবই সাহায্য করে। সামর্থ্যবান মুমিনদের জীবনে একবার হজ করা ফরজ। হজ একমাত্র ইবাদত যা সব মুসলিম একই সময়ে, একত্রে আদায় করে। হজসহ অন্য সব ইবাদত গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য বিরুদ্ধে বিশ্বাস, খালেস নিয়ত ও বিরুদ্ধ পদ্ধতি জরুরি। অতএব এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। হজ আরবি শব্দ। এর অর্থ সঙ্কল্প করা, ইচ্ছা করা ইত্যাদি। পরিভাষায়, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট (রাসূল সা: দেখানো) পদ্ধতিতে কাবা ও এর সংশ্লিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট ইবাদত সম্পাদন করা। (মুখতাসার আল ফিকহ আল ইসলামী) ওমরাহও একটি আরবি পরিভাষা। এর অর্থ পরিদর্শন করা। ইবাদতের উদ্দেশ্যে কাবা পরিদর্শন করা। পরিভাষায়, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিশেষ (রাসূল সা: দেখানো) পদ্ধতিতে কাবা তওয়াফ, সাফা-মারওয়া সাঈ ও মাথা মুণ্ডন করা বা মাথার চুল ছোট করার মাধ্যমে ইবাদত সম্পাদন করা (মুখতাসার আল ফিকহ আল ইসলামী)। হজের অপরিহার্যতা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যার সেখানে (কাবা) যাওয়ার সামর্থ্য রয়েছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সে ঘরের হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৭)। ‘তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ ও ওমরাহ করো। ‘(সূরা বাকারাহ : ১৯৩)। ‘এবং জনগণের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে ও সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে’ (আল হজ : ২৭)। ‘হজের সময় নির্দিষ্ট কয়েক মাস (শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের প্রথম ১০ দিন)। অতএব যে এ মাসগুলোতে হজের সিদ্ধান্ত নেয় সে যেন অশ্লীলতা, পাপাচার ও কলহ হতে দূরে থাকে। (সূরা বাকারাহ : ১৯৭)। রাসূল সা: বলেন, ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ১. এ স্যা দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আরো স্যা দেয়া মুহাম্মদ সা: তাঁর রাসূল ২. নামাজ প্রতিষ্ঠা করা ৩. জাকাত প্রদান করা ৪. রমাজানের রোজা রাখা এবং ৫. আল্লাহর ঘরের হজ করা’ (বুখারি, মুসলিম)। আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূল সা: আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, ‘হে লোকজন! নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন। অতএব তোমরা হজ করো। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এটি প্রতি বছর? তিনি নীরব থাকলেন। সে তিনবার এ কথা জিজ্ঞেস করার পর নবীজি বললেন, হ্যাঁ বললে তা (প্রতি বছরের জন্য) বাধ্যতামূলক হয়ে যেত। তোমরা তা পালন করতে পারতে না’ (মুসলিম)। রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করে এবং (তখন) স্ত্রী সম্ভোগ ও অন্যায় আচরণ করে না সে তার জন্মদিনের মতো (নিষ্পাপ) হয়ে ফিরে আসে’ (বুখারি)। ‘আল্লাহর দরবারে (ত্র“টিহীন) হজের প্রতিদান অবশ্যই জান্নাত’ (বুখারি)। ‘তোমরা একত্রে পরপর হজ ও ওমরাহ করো। কারণ হজ ও ওমরাহ দারিদ্র্য ও পাপ দূর করে যেমন হাঁপরের আগুন লোহা ও সোনা-রুপার ময়লা দূর করে’ (তিরমিজি)। ‘যে ব্যক্তি হজ ও ওমরাহর নিয়ত করেছে সে যেন তা অবিলম্বে করে। কারণ মানুষ কখনো অসুস্থ হয়, কখনো প্রয়োজনীয় জিনিস বিলুপ্ত হয় এবং কখনো অপরিহার্য প্রয়োজন এসে যায়’ (আবু দাউদ)। ‘হজ ও ওমরাহ পালনকারীরা দাওয়াতি যাত্রী দল (আল্লাহর মেহমান)। তারা যদি আল্লাহর কাছে দোয়া করে তা আল্লাহ কবুল করেন এবং যদি মা চায় তা হলে তিনি তাদের মা করেন’ (ইবন মাজাহ)। ‘নিশ্চয় রমাজানের ওমরাহ একটি হজের সমান’ (বুখারি)। ‘আয়িশা রা: একদা রাসূল সা:-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! মহিলাদের ওপরে কি জিহাদ রয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। সেখানে যুদ্ধ নেই। সেটি হলো হজ ও ওমরাহ’ (আহমাদ)। ‘রাসূল সা: বলেন, শ্রেষ্ঠ আমল হলো, আল্লাহ ও রাসূলের ওপর ঈমান আনা, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা এরপর কবুল হজ’ (বুখারি)। হজ অস্বীকার করলে অমুসলিম হয়ে যাবে। আর সামর্থ্য থাকার পরও হজ না করার পরিণাম অতি ভয়াবহ। রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তিকে কোনো অনিবার্য কারণ বা স্বৈরাচারী শাসক বা মারাত্মক রোগব্যাধি হজ করতে বাধা দেয়নি সে হজ না করে মারা গেলে চাই ইহুদি হয়ে মরুক বা খ্রিষ্টান হয়ে মরুক’ (দারিমি)। ‘কোনো ব্যক্তি আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার মতো পাথেয় ও বাহনের মালিক হওয়া সত্ত্বেও যদি হজ না করে তা হলে সে ইহুদি হয়ে মরুক বা খ্রিষ্টান হয়ে মরুক তাতে আল্লাহর কিছু যায় আসে না। কারণ মহান আল্লাহ কুরআনে বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যার সেখানে (কাবা) যাওয়ার সামর্থ্য রয়েছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সে ঘরের হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৭)।’ উমর বিন খাত্তাব রা: বলেন, ‘আমার ইচ্ছা হয় কিছু লোক রাজ্যের শহরগুলোতে প্রেরণ করি এবং তারা (খুঁজে খুঁজে) দেখুক ওই সব মানুষকে যারা হজ করার সামর্থ্য থাকার পরও হজ করে না তাদের ওপর তারা জিজিয়া কর চাপিয়ে দিক। কেননা সামর্থ্য থাকার পরও যারা হজ করে না তারা মুসলিম নয়, মুসলিম নয়’ (সুনানে সাঈদ ইবন মানসুর)। নবীজি সা: বলেন, মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘যে বান্দার শরীর আমি সুস্থ রেখেছি এবং তার জীবনযাত্রায় সচ্ছলতা দিয়েছি এভাবে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সে আমার ঘরে আগমন করল না, সে সুনিশ্চিত বঞ্চিত ও হতভাগা’ (ইবন হিব্বান)। ‘আল্লাহর মেহমান হলো, তিনটি দল ১. আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধকারী, হজকারী ও ওমরাহকারী’ (নাসায়ি, মিশকাত)। রাসূল সা: বলেন, ‘শ্রেষ্ঠ দোয়া হলো, আরাফার দোয়া…।’ (তিরমিজি) ‘আরাফার দিন ব্যতীত অন্য কোনো দিন আল্লাহ এত অধিক পরিমাণ লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন না। ওই দিন আল্লাহ নিকটবর্তী হন। এরপর আরাফার ময়দানের হাজীদের নিয়ে ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করেন ও বলেন, দেখ ওই লোকেরা কী চায়?’ (মুসলিম)। অন্য বর্ণনায় আছে, ‘ওরা আল্লাহর মেহমান। আল্লাহ ওদের ডেকেছেন তাই ওরা এসেছে। এখন ওরা যা চাইবে আর আল্লাহ তা দিয়ে দেবেন।’ (ইবন মাজাহ) ‘যে ব্যক্তি হজ ও ওমরাহ বা জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হলো এবং রাস্তায় মৃত্যুবরণ করল, আল্লাহ তার জন্য পূর্ণ নেকি লিখে দেবেন।’ (বায়হাকি) ‘যে ব্যক্তি রুকনে ইয়েমেনি ও হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) স্পর্শ করবে তার সব গোনাহ ঝরে পড়বে’ (নাসায়ি, ইবন খুজাইমা)। রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ কিয়ামতের দিন হাজরে আসওয়াদকে ওঠাবেন এমন অবস্থায় যে, তার দুইটি চোখ থাকবে যা দিয়ে সে দেখবে ও একটি জবান থাকবে যা দিয়ে সে কথা বলবে এবং ওই ব্যক্তির জন্য স্যা দেবে যে ব্যক্তি খালেস অন্তরে তাকে স্পর্শ করেছে’ (তিরমিজি, ইবন মাজাহ)। উল্লেখ্য, পাথরের কোনো মতা নেই, নবীজি সা: চুমু দিয়েছেন এ জন্য আমরা চুমু দেবো। ‘জমজমের পানি হলো, ভূপৃষ্ঠের সেরা পানি। এর মধ্যে রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য ও রোগ হতে আরোগ্য’ (তাবারানি)। রাসূল সা: বলেন, ‘অন্যত্র নামাজ আদায়ের চেয়ে আমার মসজিদে নামাজ আদায় করা এক হাজার গুণ উত্তম এবং মসজিদে হারামে নামাজ আদায় করা এক লাখ গুণ উত্তম’ (আহমাদ)। ‘যে ব্যক্তি হজের সঙ্কল্প করে সে যেন দ্রুত সেটি সম্পন্ন করে’ (আবু দাউদ)। ‘কেউ অন্যের প হতে বদলি হজ করতে চাইলে তাকে প্রথমে নিজের হজ করতে হবে’ (আবু দাউদ)। শিশু হজ করলে তার হজ হবে এবং তার বাবা নেকি পাবেন। তবে ওই শিশু বড় হয়ে সামর্থ্যবান হলে তাকে নিজের হজ করতে হবে। অন্যের খরচে হজ করলে হজ হবে। যে হজ করাবে সে এর নেকি পাবে এবং হজকারী তার হজের নেকি পাবে। নিরাপদ ও সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ দৈহিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুমিনদের জীবনে একবার হজ ফরজ (আলে ইমরান : ৯৭, আবু দাউদ)। যার হজ ফরজ তার ওপর ওমরাহ ওয়াজিব (বায়হাকি, বুখারি)। অধিকবার হজ বা ওমরাহ করা নফল বা অতিরিক্ত (আবু দাউদ, নাসায়ি)। নবম বা দশম হিজরিতে হজ ফরজ হয়। ইবন কাইয়িম রহ. এ মতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তবে জমহুর বিদ্বানগণের মতে, ষষ্ঠ হিজরিতে হজের হুকুম নাজিল হয়। রাসূল সা: দশম হিজরিতে জীবনে একবার সাহাবিদের নিয়ে হজ করেন (ফিকহুস সুন্নাহ)। তিনি (রাসূল সা.) জীবনে চারবার ওমরাহ করেন (বুখারি ও মুসলিম)। হজে সামাজিক লাভও প্রচুর। বিশ্বের সব মুসলিম একই সময়ে এক জায়গায় উপস্থিত হয় অন্য সময়ে এটি অসম্ভব। এখানে যেমন মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ প্রমাণিত হয় তেমনি বিশ্ব মুসলিমের যেকোনো সমস্যার কার্যকর সমাধানও নেয়া সম্ভব।