Originally posted 2013-02-28 16:48:26.
ইসলাম অসৎবৃত্তির উৎপত্তি ও অসত প্রবণতা রোধে অশ্লীলতা দমন এবং সতীত্ব সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন বিধান জারি করেছে, তন্মধ্যে অন্যতম বিধান হলো ঘরে প্রবেশ করার বিধান। জাহেলী যুগে আরববাসীদের নিয়ম ছিল, তারা (সুপ্রভাত, শুভসন্ধা) বলতে বলতে নিঃসঙ্কোচে সরাসরি একজন অন্যজনের গৃহে প্রবেশ করে যেত, অনেক সময় বহিরাগত ব্যক্তি গৃহমালিক ও তার বাড়ির মহিলাদের বেসামাল অবস্থায় দেখে ফেলত, আল্লাহ তা’আলা এই প্রথা সংশোধনের জন্য এ নীতিনির্ধারণ করেন, প্রত্যেক ব্যক্তির, যেখানে সে অবস্থান করে, সেখানে তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার অধিকার আছে এবং তার সম্মতি ও অনুমতি ছাড়া গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করার অন্য কারো অধিকার নেই। তাই কারো গৃহে প্রবেশ করার আগে অনুমতি নেয়া ও সালাম দেয়ার বিধান ইসলাম জারি করেছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদের গৃহ ছাড়া অন্যের গৃহে প্রবেশ কোরো না যতক্ষণ না গৃহবাসীদের সম্মতি লাভ করো এবং তাদের সালাম করো। এটিই তোমাদের জন্য ভালো পদ্ধতি, আশা করা যায় তোমরা এটাকে স্মরণ রাখবে। (সূরা আন-নূর-২৭)
অনুমতি চাওয়ার রহস্য ও উপকারিতা : আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক মানুষকে বসবাসের জায়গা দিয়েছেন। তা মালিকানাধীন হোক কিংবা ভাড়া করা হোক, সর্বাবস্থায় তার গৃহই তার আবাসস্থল। আবাসস্থলের আসল উদ্দেশ্য শান্তি ও আরাম। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে অমূল্য নেয়ামতরাজির উল্লেখ প্রসঙ্গে এ দিকে ইঙ্গিত করে ইরশাদ হয়েছে : আল্লাহ তা’আলা তোমাদের গৃহে তোমাদের জন্য শান্তি ও আরামের ব্যবস্থা করেছেন। (সূরা নাহাল-৮০) এই শান্তি ও আরাম তখনই অক্ষুণ্ণ থাকতে পারে, যখন মানুষ অন্য কারো হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজ গৃহে নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজ ও বিশ্রাম করতে পারে। তার স্বাধীনতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা গৃহের আসল উদ্দেশ্যকে পণ্ড করে দেয়ার নামান্তর। এটা খুবই কষ্টের কথা। ইসলাম কাউকে অহেতুক কষ্ট দেয়াকে হারাম করেছে। অনুমতি চাওয়া সম্পর্কিত বিধানাবলীর বড় উপকারিতা হচ্ছে :
প্রথম : মানুষের স্বাধীনতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা ও কষ্টদান করা থেকে আত্মরক্ষা করা, যা প্রত্যেকটি সম্ভ্রান্ত মানুষের যুক্তিসঙ্গত কর্তব্যও।
দ্বিতীয় : স্বয়ং সাক্ষাৎপ্রার্থীর। সে যখন অনুমতি নিয়ে ভদ্রজনোচিতভাবে সাক্ষাত করবে, তখন প্রতিপক্ষও তার বক্তব্য যত্নসহকারে শুনবে। তার কোনো অভাব থাকলে তা পূরণ করার প্রেরণা তার অন্তরে সৃষ্টি হবে। এর বিপরীতে অভদ্রজনোচিত পন্থায় কোনো ব্যক্তির ওপর বিনানুমতিতে চড়াও হয়ে গেলে সে তাকে অকস্মাত বিপদ মনে করে যত শিগগির সম্ভব বিদায় করে দিতে চেষ্টা করবে এবং হিতাকাড়ক্ষার প্রেরণা থাকলেও তা নিস্তেজ হয়ে যাবে। অপর দিকে আগন্তুক ব্যক্তি মুসলমানকে কষ্ট দেয়ার পাপে পাপী হবে।
তৃতীয় : নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতা দমন। কারণ বিনানুমতিতে কারো গৃহে প্রবেশ করলে মাহরাম নয়, এমন নারীর ওপর দৃষ্টি পড়া এবং অন্তরে কোনো রোগ সৃষ্টি হওয়া আশ্চর্য নয়। এ দিকে লক্ষ করেই অনুমতি গ্রহণের বিধানাবলীকে আল-কুরআন ব্যভিচার, অপবাদ ইত্যাদি শাস্তির বিধিবিধান সংলগ্ন বর্ণনা করেছেন।
চতুর্থ : মানুষ মাঝে মাঝে নিজ গৃহের নির্জনতায় এমন কাজ করে, যে সম্পর্কে অপরকে অবহিত করা সমীচীন মনে করে না। যদি কেউ অনুমতি ব্যতিরেকে গৃহে ঢুকে পড়ে, তবে ভিন্ন লোক তার গোপন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে যায়। কারো গোপন কথা জবরদস্তি জানার চেষ্টা করাও গোনাহ এবং অপরের জন্য কষ্টের কারণ।
অনুমতি নেয়ার ইসলামী নীতি : দুটি কাজ না করা পর্যন্ত কারো গৃহে প্রবেশ করা যাবে না
প্রথমত : সম্মতি নেয়া। প্রবেশের পূর্বানুমতি লাভ দ্বারা প্রতিপক্ষ পরিচিত ও আপন হয়, সে আতঙ্কিত না হয়।
দ্বিতীয়ত : গৃহের লোকদের সালাম করা, কোন কোন তফসিরকারক এর অর্থ এরূপ দিয়েছেন, প্রথমে অনুমতি নেবে, পরে গৃহে প্রবেশ করার সময় সালাম দিয়ে প্রবেশ করবে। প্রখ্যাত মুফাসসির কুরতুবী এ মতকে পছন্দ করেছেন। মাওয়ারিদ বলেন, যদি অনুমতি নেয়ার আগে গৃহের কোনো ব্যক্তির ওপর দৃষ্টি পড়ে, তবে প্রথমে সালাম করবে, এরপর অনুমতি নিয়ে গৃহে প্রবেশ করবে। নতুবা প্রথমে অনুমতি নেবে, পরে সালাম দিয়ে প্রবেশ করবে। অতএব সুন্নত নিয়ম হলো প্রথমে সালাম করবে অনুমতি নেয়ার জন্য, এ সালামের মাধ্যমে ঘরের লোকদের মনোযোগ আকর্ষণ করবে। এরপর অনুমতি নিয়ে সালাম দিয়ে প্রবেশ করবে।
প্রথম প্রথম যখন অনুমতি নেয়ার বিধান জারি হয়, তখন লোকরা তার নিয়মকানুন জানত না, একবার এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে দরজা থেকে চিতকার করে বলতে থাকে (আমি কি ভেতরে ঢুকে যাবো?) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন : এ ব্যক্তি অনুমতি চাওয়ার নিয়ম জানে না, বাইরে গিয়ে তাকে ঘরে প্রবেশ করার নিয়ম শিখিয়ে দাও, তাকে বলো সে যেন বলে আসসালামু আলাইকুম (আমি কি প্রবেশ করব?) খাদেম বের হওয়ার আগেই লোকটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনে আসসালামু আলাইকুম (আমি কি প্রবেশ করব?) বলল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিলেন, লোকটি প্রবেশ করল। (আবু দাউদ)
অনুমতি চাওয়ার সঠিক পদ্ধতি হলো : নিজের নাম উল্লেখ করে অনুমতি চাইবে। হযরত ওমর (রাঃ)-এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে হাজির হয়ে তিনি বলতেন, আস্সলামু আলাইকুম। সালামের পর বলতেন, ওমর প্রবেশ করতে পারে কি? (আবু দাউদ) সহিহ মুসলিমে আছে হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ)-এর কাছে এলেন এবং অনুমতি চাওয়ার জন্য বললেন, আস্সালামু আলাইকুম। সালাম দিয়ে প্রথমে নিজের নাম আবু মূসা বলেছেন এরপর আরো নির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করার জন্য আশআরী বলেছেন। এর কারণ এই যে, অনুমতি প্রার্থীকে না চেনা পর্যন্ত জবাব দেয়া যায় না।
অনুমতি চাওয়ার পর যখন ভেতর থেকে জিজ্ঞাসা করে কে? উত্তরে শুধু আমি বলা যাবে না, বরং এমন নাম বলতে হবে, যে নাম পরিচিত। শুধু আমি জিজ্ঞাসার জবাব নয়। খতীব বাগদাদী বর্ণনা করেন, আলী ইবনে আসেম বসরায় হযরত মুগীরা ইবনে শুবার সাক্ষাতপ্রার্থী হন। দরজার কড়া নাড়লেন। হযরত মুগীরাহ ভেতর থেকে প্রশ্ন করলেন কে? উত্তর হলো, আনা অর্থাৎ আমি। হযরত মুগীরা বললেন, আমার বন্ধুদের মধ্যে তো কারো নাম আনা নেই। এরপর তিনি বাইরে এসে তাকে হাদীস শুনালেন, একদিন জাবের ইবনে আবদুল্লাহ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে অনুমতির জন্য দরজার কড়া নাড়লেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভেতর থেকে প্রশ্ন করলেন কে? উত্তরে জাবের বললেন, আনা অর্থাত, আমি, এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শাসিয়ে বললেন, আনা আনা (আমি, আমি) বললে কাউকে চেনা যায় কি? (বোখারী, মুসলিম) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মিরাজে গেলেন, প্রতি আকাশেই জিবরাঈল আলাইহিস্সালাম দরওয়াজা খুলে দেয়ার অনুমতি চাইলে ভেতর থেকে জিজ্ঞসা করা হলো, কে? উত্তরে জিবরাঈল নিজের নাম বলে দিলেন জিবরাঈল। (বুখারী, মুসলিম)
অনুমতি নেয়ার জন্য তিনবার ডাক দেয়ার বিধান রয়েছে। আবার তিনবার ডাকা একের পর এক হওয়া উচিত নয় বরং একটু থেমে থেমে হতে হবে। এর ফলে ঘরের লোকরা যদি কাজে ব্যস্ত থাকে এবং সে জন্য তারা যদি জবাব দিতে না পারে তাহলে সে কাজ শেষ করে জবাব দেয়ার সুযোগ পাবে। আবু মূসা আশআরী (রাঃ) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বলেছেন, অনুমতি চাইতে হবে তিনবার, যদি অনুমতি দেয় প্রবেশ করবে নতুবা ফিরে যাবে। (বোখারী, মুসলিম)। একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হযরত সাদ বিন উবাদার বাড়িতে গেলেন এবং আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ বলে দুবার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু ভেতর থেকে জবাব এলো না। তৃতীয়বার জবাব না পেয়ে তিনি ফিরে যেতে লাগলেন। হযরত সাদ ভেতর থেকে দৌড়ে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার আওয়াজ শুনছিলাম, কিন্তু আমার মন চাচ্ছিল আপনার মুবারক কণ্ঠ থেকে আমার জন্য যতবার সালাম ও রহমতের দু’আ বের হয় ততই ভালো, তাই আমি খুব নিচুস্বরে জবাব দিচ্ছিলাম। (আবু দাউদ, আহমাদ) এমনি হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) হযরত ওমর (রাঃ)-এর কাছে প্রবেশ করার জন্য তিনবার অনুমতি চেয়ে অনুমতি না পেয়ে ফিরে গেলেন।
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে ইসলামের বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার তাওফীক দান করুন। আমীন…