আল্লাহকে একমাত্র প্রভু বলে যে মানুষ স্বীকার করবেন, আল্লাহতায়ালার দিকে মানুষকে আহ্বান করা বা দাওয়াত দেয়া তারই কাজ, এটা তার ওপর ফরজ দায়িত্ব। দ্বীন শুধু আমার বা আমাদের নিজের নয়, সবার জন্য। সব মানুষের কাছে আল্লাহতায়ালার প্রিয় দ্বীন পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব সার্বজনীন। দাওয়াতকারী প্রতিটি মানুষ যদি হয় খোদাভীরু, কর্মঠ ও সত্ স্বভাবের অধিকারী, তবেই দাওয়াতের বাণী হৃদয় থেকে উত্সারিত হবে, ধর্মের মুখ্য বাণী মানুষের মর্মে পৌঁছবে। ভালো দিয়ে মন্দকে, ন্যায় দিয়ে অন্যায়কে, নীতি দিয়ে দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। তখনই বিবেকবোধ বলে দেবে, ঈমানের আন্দোলন হলো নিজের সংশোধনের পাশাপাশি সমগ্র মানবজাতির মুক্তির আন্দোলন, মূর্খতা, স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণতাকে বিতাড়িত করে দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্নত ও প্রসারিত করার, নিজে সত্ ও মহত্ কর্ম করে উপমা সৃষ্টি করার, সাধ্যমত অন্যায়ের প্রতিবাদ করার আন্দোলন, বিপদগ্রস্ত, দুস্থ, অভাবগ্রস্ত, লাঞ্ছিত-বঞ্চিতদের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে শির উঁচু করে দাঁড়ানোর আন্দোলন। দীর্ঘ ঊনসত্তর বছর আমরা নীরবে তাবলিগের কার্যক্রম চালিয়ে বিশ্ব ইজতেমায় ত্রিশ-চল্লিশ লাখ লোক একত্রে জড়ো হয়ে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও যে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের দুর্দিনে রেড ক্রিসেন্টের মতো ত্রিশ-চল্লিশজনের একটি সেবক টিম পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছি। দিন দিন মুসলমানদের ওপর জুলুম ও নির্যাতন বাড়ছে। যে অনুপাতে মসজিদ বাড়ছে, মুসল্লি ও বকধার্মিক বাড়ছে, সে অনুপাতে বাড়ছে না সবল ঈমানদার ও জ্ঞানীর সংখ্যা। আমরা সর্বাধুনিক ধর্ম ইসলামের ঝান্ডা হাতে নিয়েও আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারি না। মুসলমানদের অবনতির জন্য ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের দায়ী করি কিন্তু নিজেদের দোষ স্বীকার করি না। নিজেদের অযোগ্যতা ও মূর্খতার জন্যই আমরা বিশ্ব নেতৃত্বের আসন থেকে অপসারিত হয়েছি।
পৃথিবীতে ইহুদী ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ১৪ লাখ মাত্র আর মুসলমানের সংখ্যা ১৫০ কোটি। ইহুদীরা সবাই শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী। কিন্তু মুসলমানের অধিকাংশই পরনির্ভর, গরিব, সাক্ষরতার হার শতকরা ৪০ ভাগ মাত্র। ১৪ লাখ ইহুদীর মধ্যে গত ১০০ বছরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদানের জন্য ১৮০ জন ইহুদী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অথচ ১৫০ কোটি মুসলিমানের মধ্যে নোবেল পেয়েছেন মাত্র তিনজন। পৃথিবীর ৫০০টি প্রথম শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকটিই খ্রিস্টানদের দেশে, মুসলমান দেশে একটিও নেই। পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাসের হেফাজত করা প্রতিটি মুসলমানের একান্ত দায়িত্ব কিন্তু দুঃখের কথা হলো, বায়তুল মোকাদ্দাসসহ গোটা জেরুজালেম নগরীই আজ ইহুদীদের কবলে জিম্মি। ইসরাইলী সেনাবাহিনীর বুলেটের আঘাতে প্রতিদিনই ঝরছে ফিলিস্তিনিদের রক্ত, ধ্বংস হচ্ছে মাল-সম্পদ, ঘরবাড়ি, কাঁদছে নিষ্পাপ শিশু, অসহায় মা, নিরীহ মুসলমান। বিধর্মীদের বর্বরতায় কাঁদছে আফগানিস্তান, ইরাকসহ কত দেশের অসহায় মুসলমান। আমরা বিশ্ব ইজতেমার মাঠ থেকে কখনও কি এর জন্য সামান্যতম দুঃখ প্রকাশ করেছি?
আমরা হজে যেতে ছবি তুলি, বিশ্বের বৃহত্ সমাবেশ পবিত্র হজের ছবি আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসে দেখার সুযোগ পাই, বিশ্ব ইজতেমার কার্যক্রম ক্যামেরায় ধারণ করার সুযোগ সাংবাদিকদের দিতে চাই না। মসজিদে মসজিদে মাইক ব্যবহার করি অথচ বিশ্ব ইজতেমার মাঠে তা ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করি। লক্ষ্য কোটি টাকা খরচ করে প্রতিবছর নতুনভাবে মাঠ প্রস্তুত করছি, হাজার হাজার শ্রমিক স্বেচ্ছায় মাঠে শ্রম দিচ্ছি, আল্লাহকে রাজি-খুশি করার মানসেই হাজার হাজার জামাত-চিল্লায় যাচ্ছি, মসজিদে বসবাস করছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি, মানুষকে সত্য ও সঠিক পথে আনার ব্যাপারে সময়ক্ষেপণ করছি। কিন্তু কোনো দীন-দুঃখীর গৃহ মেরামত করে দিচ্ছি না, ক্ষুধার্তদের ক্ষুধা নিবারণ করছি না, মানুষকে কর্মঠ হওয়ার কথা বা দারিদ্র্য মুক্তির কথা বলছি না, ভিক্ষার হাতকে কর্মীর হাতিয়ারে পরিণত করছি না, নবীর প্রেমিক বলে দাবি করছি, নবীর অপমান, কুরআনের অপমান নীরবে বুকে ধারণ করছি, টুঁ শব্দটিও করার প্রয়োজন মনে করছি না। টিভির সংবাদ দেখা, পত্রিকার খবর পড়াকে অনেকেই দেখছি না ভালো চোখে। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে দেখছি খাটো করে। অথচ আমাদের সব তাবলিগী ভাইদের জানা উচিত আধুনিক যুগ তথ্য-প্রযুক্তি ও মিডিয়ার যুগ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উত্স আল কোরআন। চির সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আল কোরআনের অফুরন্ত আলো আজ বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া প্রতিটি মুসলমানের একান্ত দায়িত্ব। গণমাধ্যমের সঙ্গে ইসলামের মেলবন্ধন এখন সময়ের দাবি।
আজ বিশ্বজুড়ে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়ানো হাজারও অপকর্ম ও অশ্লীল বিনোদনকে রোধ করতে মুসলমানদের ধর্মীয় কাজে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটকেই সবচেয়ে বেশি কাজে লাগানো জরুরি। পশ্চিমা গণমাধ্যমে জঙ্গিবাদী ধর্ম হিসেবে ইসলাম চিহ্নিত হচ্ছে। তারা মিডিয়ার মাধ্যমে তুলে ধরছেন ইসলাম ধর্ম হচ্ছে নৃশংসতা, পশ্চাত্পদতা ও কুপমণ্ডুকতার দোষে দুষ্ট একটি মতাদর্শ মাত্র। আমরা মুসলমানরা যে কোনো বিষয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করি, কিন্তু চেষ্টা, পরিশ্রম ও গবেষণা করতে চাই না। মসজিদ, মাদরাসায় দারিদ্র্য, অলসতা, কর্মবিমুখতা দূরীকরণের কোনো ভূমিকা নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায় আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না। অথচ ইসলামের শিক্ষা কর্ম-চিন্তা ও গবেষণার শিক্ষা। যখন নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়। আর আল্লাহর অনুগ্রহ তথা জীবিকা অন্বেষণ করো। (সূরা জুমআ আয়াত-১১)।
ঈমানের প্রায় সত্তরটির ওপরে শাখা রয়েছে। এ সম্পর্কে যারা অবগত এবং সে অনুযায়ী আমলে সালেহ (সত্কর্ম বা মানব কল্যাণ) করছে তারাই জান্নাতি। যে মুসলমানের মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমান বিদ্যমান সে জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে দূরে থাকতে পারে না, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও মূর্খতাকে প্রশ্রয় দিতে পারে না। আমরা তথ্য-প্রযুক্তি ও মিডিয়া থেকে যতই দূরে থাকব, ততই দাওয়াতি কাজে পিছিয়ে পড়ব। কারণ পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে খোদার জ্ঞানকে ধরতে ব্যর্থ হলে মুসলমানদের অগ্রগতি আসবে না। আজ দেখা যাচ্ছে আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে হাজার হাজার অমুসলিম মুসলমান হচ্ছে এই ইন্টারনেটের বদৌলতেই। ঘরে বসে কম্পিউটারের বিভিন্ন ওয়েবসাইট সার্চ করে ইসলামের মহান আদর্শ ও সভ্যতাকে উপলব্ধি করছে, ইসলামের শীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে ধন্য করছে। কোরআনের বিভিন্ন সফটওয়্যার ও সিডির মাধ্যমে সহি উচ্চারণের সঙ্গে কোরআন শিখছে, মাসআলা জেনে নিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য কোন ভাষায় তার অর্থও জানতে পারছে! দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ অনেকটা কম্পিউটার ও ইন্টারনেট এবং প্রিন্ট মিডিয়া সহজ করে দিচ্ছে। মোবাইল ফোনেও কিভাবে তাবলিগের সংবাদ দেয়া যায় বিষয়টি নিয়ে আমাদের কাজ করা উচিত। আজ বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার জন্য ডা. জাকির নায়েকের দাওয়াত ও তাবলিগের কথা কি মুসলমান অস্বীকার করতে পারবে। বিশ্বের একশরও বেশি দেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক, টিভি ও স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে ডা. জাকির নায়েককে প্রতিনিয়ত দেখা যায়। তিনি তার বক্তব্যে কুরআন ও সহি হাদিসের বাণীগুলোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশ্লেষণ করেন। কারণ বিজ্ঞানের এ যুগে কথায় কথায় মানুষ যুক্তি-প্রমাণ খোঁজে। বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তির ফলে দর্শক ও স্রোতারা সহজেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন। ডা. জাকির নায়েক লক্ষ-কোটি তারকা নয়, বরং সূর্যের মতো পুরো পৃথিবীকে মিডিয়ার মাধ্যমে আলোকিত করছেন।
আমরা যারা তাবলিগ করি তাদের সবার জানা উচিত, বর্তমান যুগে মানুষ আবেগ ও বদ্ধ ধারণার কোনো কদর করতে চায় না, ইসলামের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যাই বেশি গ্রহণ করে। বিশ্বায়নের এ যুগে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় রোধে বিশ্বময় শান্তির জন্য, প্রগতির নামে দুর্গতির আঁধারে কোরআন ও সুন্নাহর জ্যোতির্ময় আলো জ্বালাতে, মিডিয়ার কোনো বিকল্প নেই। আসুন, দাওয়াত ও তাবলিগকে আরও গতিশীল করতে প্রিন্ট মিডিয়া, স্যাটেলাইট, কম্পিউটার, অডিও ভিজ্যুয়াল, ইন্টারনেট প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়াকে আঁকড়ে ধরি। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, গোঁড়ামি এবং অজ্ঞতাকে ঝেড়ে ফেলে সব বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই। হে আল্লাহ, আমাদের দুষ্ট মিডিয়ার মন্দ প্রভাব থেকে দূরে থাকার এবং সত্ মিডিয়া প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় অগ্রণী ভূমিকা রাখার তৌফিক দান করুন।