Originally posted 2013-08-24 16:48:54.
সংকলনে: মোঃ হাবিব উল্লাহ (আবু শাকের)
‘ইসলাম একটি পূণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা’ বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক ও বিরাট। সেই অসংখ্য বিষয় থেকে নিম্নোক্ত প্রবন্ধে সংক্ষিপ্ত পরিসরে মৌলিক কয়েকটি বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
১. শ্রমজীবি মানুষের অধিকার
বিশ্বের ইতিহাসে মানবতার বন্ধু রাহমাতুল্লিল আলামিনই সর্ব প্রথম মানবিক শ্রমনীতির প্রবর্তন করেন। তাঁর পূর্বে কোন দেশ বা অর্থনীতিতেই শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রয়াস গৃহীত হয়নি। এমনকি পরেও কোন দেশ বা মতবাদে সমতুল্য কোন নীতি গৃহীত হয়নি। আজ হতে চৌদ্দশত বছর পূর্বে রাসূল (সঃ) প্রবর্তিত শ্রমনীতি আজও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শ্রমনীতি। পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় অনুসৃত শ্রমনীতি মানবিক নয়, ইনসাফভিত্তিক তো নয়ই। শ্রমিক-মালিক সর্ম্পক, শ্রমিকদের সঙ্গে ব্যবহার, তাদের বেতন ও মৌলিক প্রয়োজন পূরণ ইত্যাদি প্রসঙ্গে রাসূলে করীমের (সঃ) প্রদর্শিত পথ ও হাদীসসমূহ থেকেই ইসলামের বৈপ্লবিক ও মানবিক শ্রমনীতির সম্যক পরিচয় পাওয়া যাবে। মজুরদের অধিকার সম্বন্ধে তিনি বলেন- শ্রমিকদের এমন কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না, যা তাদের কে অক্ষম ও অকর্মণ্য বানিয়ে দেবে। (তিরমিযী) মজুরের মজুরী তার গায়ের ঘাম শুকোবার পূর্বে পরিশোধ কর। ইবনে মাযাহ ও বাইহাকী, আরো বিস্তারিত জানার জন্য সূরা শোয়ারা-২১৫ আয়াত দ্রষ্টব্য।
০২. ব্যবসা-বাণিজ্য –
ব্যবসার সব অবৈধ ও অন্যায় পথ এবং প্রতারণামূলক কাজ নিষিদ্ধ করাই শুধু ইসলামী সরকারের দায়িত্ব নয় বরং তা যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তাও দেখা কর্তব্য। ‘‘ইহ্তিকার’’ অর্থাৎ অধিক লাভের আশায় পণ্য মজুদ রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। ধোঁকাবাজি করা অন্যায়। ভেজাল দেওয়া যে কোন বিচারেই মারাত্মক অপরাধ। ওজনে কারচুপিও তাই। এ সমস্তই প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। তা না হলে জন সাধারণ ক্রমাগত ঠকতে থাকবে। এর প্রতি বিধানের জন্য ‘‘হিস্বাহ’’ নামে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান কায়েম হয়েছিল। এ থেকেই উপলদ্ধি করা যায় সমাজকে তথা মানব চরিত্র কে কত গভীরভাবে রাসূলে করীম (সঃ) পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। রাসূলে করিম (সঃ) মাঝে মাঝেই বাজার পরিদর্শনে যেতেন। রাস্তা দিয়ে হাটার সময়ে দোকানদারদের কার্যক্রম লক্ষ্য করতেন। এ থেকেই বোঝা যায় বাজার ব্যবস্থার উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য বটে। পরবর্তীকালে আমিরুল মুমিনীন হযরত উমর ফারুক (রাঃ) একাজ করতেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজার যেন স্বাভাবিক নিয়মে চলে। মজুতদারী, মুনাফাখোরী, ওজনে কারচুপি, ভেজাল দেওয়া, নকল করা প্রভৃতি বাজারে অনুপ্রবেশের সুযোগ না পায়। পণ্যসামগ্রীর অবাধ চলাচলের উপর বিধি-নিষেধ থাকবে না। কারণ, খাদ্যদ্রব্য ও প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর অবাধ চলাচলের উপর বাধা-নিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলেই কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হয় ও দুর্নীতির পথ প্রশস্ত হয়। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণ ও দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক করার জন্য সরকারকে সুষ্ঠু ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে এরশাদ হচ্ছে- আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। (সূরা বাকারা-২৭৫)
রাসূলে করীম (সঃ) বলেন- তোমাদের মধ্যে যারা সুদ খায়, সুদ দেয়, সুদের হিসাব লিখে এবং সুদের সাক্ষ্য দেয় তারা সবাই সমান পাপী। (তিরমিযী, মুসলিম) তিনি আরও বলেন-সত্যবাদী, ন্যায়পন্থী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী আম্বিয়া, সিদ্দিক ও শহীদদের সাথী হবে। (তিরমিযী)
৩. পারিবারিক জীবন-
হযরত খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদসহ রাসূল (সঃ) এর মতান্তরে বারজন সহধর্মীনী ছিলেন, যাদের কে বলা হয় উম্মাহাতুল মো’মিনিন, তাদের সাথে রাসূল (সঃ) অত্যন্ত মধুর জীবন অতিবাহিত করেছেন। যা ইতিহাসের মাঝে বিরল, হযরত আয়েশা (রাঃ) এর কবিতার অংশ থেকে বুঝা যায় তাদের ভালবাসা কেমন? তিনি বলেছিলেন, আকাশের জন্য একটি সূর্য আছে, আমার জন্যও একটি সূর্য আছে, আকাশের সূর্যটি উদিত হয় ফজরের পরে, আর আমার সূর্যটি উদিত হয় এশার পরে। সত্যিই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার প্রেমপ্রীতি ও ভালবাসা ছাড়া কিছুতেই মানব জীবন সৌন্দর্য মণ্ডিত হতে পারেনা, বরঞ্চ সেক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর সর্ম্পক হবে নিরেট একটি পারিবারিক সর্ম্পক। বস্তুত কালামে পাকের ভাষ্য অনুযায়ী মানুষের দাম্পত্য জীবনটাই হচ্ছে প্রেমপ্রীতি ও ভালবাসার জীবন। সূরা রূম-২১, আরাফ-১৮৯, বাকারা-১৮৭, আল-ইমরান-১৪।
তোমরা কি নারীদের কে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ করছ? যে এই সুন্নাত থেকে দূরে থাকল, সে আমার দলভূক্ত নয়। (বুখারী)
৪. বিচার ব্যবস্থা-
বিচার কার্য পরিচালনার জন্য যে নিয়ম-নীতি নির্ধারন করা হয় তাহাকে আইন বলা হয়। আইনের প্রকৃত উৎস দু’টি যথা ঃ- (১) কুরআন ও (২) সুন্নাহ। এ দু’টির মধ্যে যে সব সুস্পষ্ট আকারে বিদ্ধমান আছে তা অকাট্য ও অপরিবর্তনীয়, তা সকল সময়ের জন্যে শিরধার্য এবং তার আনুগত্য অপরিহার্য। তার মধ্যে কখনো সামান্য রকমের কোন রদ-বদলও করা যাবে না। আল্লাহ যে আইন নাযিল করেছেন তার ভিত্তিতে যারা বিচার ফয়সালা করে না, তারা দ্বীন অস্বিকারকারী। (সূরা-মায়েদা-৪৪)
আইনের শক্তি অপরাজয়, আইনের উর্ধ্বে কেউ হতে পারে না, ধনী-গরীব, সাধারন-অসাধারনের এখানে কোনই স্বাতন্ত্র নেই। অতি সম্মানিত ব্যক্তিও এমন কি ক্ষমতাশীল খলিফা পর্যন্ত আইনের অধীনে, যেমন একজন অসহায় দরিদ্র আইনের অধীন। নবী করিম (সঃ) আইনের উচ্চ ক্ষমতার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত : যদি মোহাম্মদের কন্যা ফাতেমা ও চুরি করত, তাহলে খোদার কসম আমি তারও হাত কেটে দিতাম। (বুখারী)
আইন পরিষদ শাসন বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকবে, আইন প্রনয়নের উপরে শাসন বিভাগের প্রভাব প্রতিপত্তির কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। এ ভাবে ইসলামী আইনের উৎস হয়ে এসেছে কুরআন, সুন্নাহ, কিয়াছ ও ইজমা।
৫. রাষ্ট্রপ্রধান-
মোহাম্মদ (সঃ) রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে সকল মানুষের ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অধিকার নিশ্চিত করেছেন, শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রন, চুরি, সামাজিক ও বিশৃঙ্খলা, যেনা-বেবিচার, সুদ, ঘুষ, চোরাকারবারী, মারামারী, কাটাকাটি ইত্যাদি দুর করে সবাইকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে একটি সোনালী যুগ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আজও যদি সে রকম সৎ ও আল্লাহ ভীরু লোক তৈরী করা যায় সে সোনালী যুগ ফিরে আসবে ইনশাল্লাহ।
৬. সামরিক অভিযান-
রসুল (সঃ) নবুয়ত লাভের পূর্বে (১৫ বৎসর বয়সে) যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলেন। এ যুদ্ধকে ‘ফিজারের’ যুদ্ধ বলা হয়। নবুয়ত লাভের পর ২৮টি গাযওয়া ও ৫৭টি শারিয়ার কথা লিখা হয়েছে এর মধ্যে ৯টি গাযওয়ায় রসুল (সঃ) নিজেই জিহাদ করেছেন, তাহলো বদর, উহুদ, মোরাইসী, খন্দক, কুরাইযা, খায়বর, ফতেহমক্কা, হুনাইন ও তায়েফ। অন্যদিকে বুখারী ও মুসলিম শরীফে উল্লেখ আছে য়ে রসুল (সঃ) ১৯টি গাযওয়ায় সশরীরে জিহাদ করেছেন। (সিরাতকোষ-৬০ পৃষ্টা) এছাড়া ও অসংখ্য যুদ্ধে বিরত্ব ও রনকৌশলীর সাথে যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেন।
৭. চুক্তি সম্পাদন-
ষষ্ট হিজরীতে হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পাদন করা হয়, উক্ত চুক্তি নামা ৭টি দফা ছিল, দৃশাতঃ চুক্তির শর্তগুলি মুসলিমদের স্বার্থ বিরোধী। মুসলিমরা এ চুক্তিকে গ্রহন করতে পারছিলেন না, আল্লাহর রাসূল (সঃ) এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ছিলেন, আর প্রজ্ঞাময় আল্লাহ ‘ফাতহুন মুবীন’ বা সুস্পষ্ট বিজয় বলেছেন। ইহুদী ও মুসলিমদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়, ‘মদিনা সনদ’ নামে খ্যাত এ চুক্তিটিতেও সাতটি ধারা ছিল, এ সনদ ছিল মদীনা রাষ্ট্রের ও পৃথিবীর প্রথম সংবিধান। চুক্তি সন্ধির ব্যাপারে আরো বিস্তারিত জানার জন্য সূরা আনফালের ৬১ নং আয়াত-এর তাফসীর দ্রষ্টব্য।
৮. অমুসলিমদের সাথে ব্যবহার ও অধিকার-
প্রতিটি মানুষ, মানুষ হিসাবে সুবিচার, দয়া এবং উত্তম ব্যবহার লাভের অধিকার রয়েছে, আমাদের উপর আমাদের প্রত্যেক প্রতিবেশীর অধিকার বর্তায়, চাই সে মুসলিম হউক বা অমুসলিম হউক। অমুসলিমদের সাথে ইসলাম সদাচারন ও সুবিচার করতে নিষেধ করে না, কেবল বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করছে। আল্লাহ তায়ালা যুলুম এবং বাড়াবাড়ি প্রছন্দ করেন না, তা কোন মুসলিম করুক কিংবা অমুসলিম। সূরা আশশুরা-৩৯, ৪৩, মায়েদা-৮।
৯. আত্মীয়তার সর্ম্পক-
আত্মীয়দের অধিকার বলতে বুঝায় তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা, ভাল ব্যবহার করা, খোজ-খবর নেয়া, যারা দরিদ্র তাদের পাশে দাড়ানো তাদের মেহমানদারী করা, পরিচর্যা করা, তাদের কোন প্রকার হক নষ্ট না করা, সর্ম্পক ছিন্ন না করা, আত্মীয়দের অধিকার সর্ম্পকে কুরআন ও হাদীসের কতিপয় উদ্ধৃতি বিষয়টি গুরুত্ব বুঝানোর জন্য যথেষ্ট। সূরা বাকারা-৮৩, ১১৭, সূরা নিসা-১, ৩৬, সূরা নহল-৯০, لايدخل الجنة قاطع – রক্তের সর্ম্পক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (বুখারী)
১০. সমাজ সংস্কার ও দু:স্থ মানবতার সেবা-
রাসূল (সঃ) নবুয়ত লাভের পুর্বেও সমাজ সংস্কার ও দু:স্থ মানবতার জন্য ৫ দফার ভিত্তিতে “হিলফুল ফুজুল” এ অংশ গ্রহন করেন। সব সময় মানুষের সুখ-দূ:খ অসহায় সম্বলহীনদের পাশেই ছিলেন, এবং অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ মৌলিক প্রয়োজনের জন্য উৎসাহিত করেছেন। ইয়াতিম ও কাংগালের লালন পালন কারীর বেহেস্তে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। (বোখারী-মুসলিম) যে ব্যক্তি তৃপ্তিসহকারে পেট পুরে ভক্ষন করে, আর তারই পাশে তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে ঈমানদার নয়। (মেশকাত) অসহায়, অভাবগ্রস্থ, গরীব, ইয়াতিম, বিধবা ইত্যাদি অভাবী লোকদের খোজ-খবর নিতেন। তাদের অভাব মোচন এবং খাদ্য দানে আদেশ করেছেন। (বোখারী-মুসলিম)
১১. শিশুদের প্রতি ভালবাসা-
রসুল (সঃ) শিশুদের কে ভালবাসতেন। একদিন ঈদের মাঠে দেখলেন একটি শিশু কাঁদছে, প্রিয় নবী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কাঁদছ কেন? ছেলেটি বলল আমার আব্বা আম্মা কেউ নেই, আমার জামা কাপড় ও নেই। তাই রসুল (সঃ) বললেন আমি যদি তোমার আব্বা হই আয়েশা যদি তোমার আম্মা হয় তাহলে তোমার কি কোন আপত্তি আছে? রসুল (সঃ) ছেলেটিকে আয়েশা (রাঃ) এর নিকট নিয়ে বললেন তোমার জন্য একটি উপহার এনেছি আজ থেকে এ আমাদের ছেলে। যায়েদ বীন হারেছা কে কৃতদাস থেকে মুক্ত করে পুত্রের মর্যাদা দিলেন। রসুল (সঃ) এর এই কাজ দেখে যায়িদের আব্বা ও চাচা অবাক হলেন। আনাস বিন মালেক পাঁচ বছর থেকে রাসূলের (সঃ) মৃত্যু পর্যন্ত খেদমত করেছেন, কিন্তু কোনদিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) একথা বলেননি, একাজ কেন করেছ? বা কেন করনি?
১২. ইয়াতীমদের হক ও ভালবাসা-
ইয়াতীমকে গলা ধাক্কা দেয়া, ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষন ও আত্মসাৎ করার ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সঃ) কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন এবং এর পরিনতি ভয়াবহ। সূরা বনীইসরাইল-৩৪, সূরা মাউন-২, সূরা নিসা-২,৮,১০,১২৭।
১৩. কারাবরন-
আবু তালিব বানু হাশিমের লোকদেরকে নিয়ে শি’য়াবে আবু তালিব নামক গিরি সংকটে আশ্রয় নেন। বানু হাশিমের (আবু লাহাব ব্যতিত) মুসলিম-অমুসলিম সকল সদস্যই মুহাম্মদ (সঃ) এর সঙ্গী হন। আটক অবস্থায় তাঁদেরকে থাকতে হয় তিন বছর। এই তিন বছর তাঁদেরকে দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। খাদ্যাভাবে অনেক সময় গাছের পাতা ও ছাল খেতে হয়েছে। শুকনো চামড়া চিবিয়ে চিবিয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণের চেষ্টা করতে হয়েছে। পানির অভাবে অবর্ণনীয় কষ্ট পেতে হয়েছে। তিন বছর পর আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন এই বন্দীদশা থেকে তাদের মুক্তির পথ করে দেন।
১৪. সম্পদ বণ্টন ও উত্তরাধিকার আইন-
রাসূলে করীম (সঃ) আবির্ভাবের পূর্বে সারা বিশ্বে ভুমির উত্তরাধিকার আইন ছিল অস্বাভাবিক। তখন পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রসন্তানই সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির উত্তরাধিকারত্ব লাভ করত। বঞ্চিত হতো পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। এছাড়া সমাজে যৌথ পরিবার প্রথা চালু ছিল। এ প্রথার মুল বক্তব্য হচ্ছে সম্পত্তি গোটা পরিবারের হাতেই থাকবে। পরিবারের বাইরে তা যাবে না। ফলে মেয়েরা বিয়ের পর পিতার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হতো। উপরন্ত সম্পত্তির কর্তৃত্ব বা ব্যবস্থাপনার ভার জ্যেষ্ঠ পুত্রসন্তানের হাতেই ন্যস্ত থাকত। এই দু’টি নীতিই হিন্দু, খ্রীষ্টান ও ইহুদী ধর্মে অনুসৃত হয়ে আসছিল যুগ যুগ ধরে। সম্পত্তি যেন বিভক্ত না হয় তার প্রতি সব ধর্মের ছিল তীক্ষ্ণ নজর, । কারণ সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গেলে পুজির পাহাড় গড়ে উঠবে না, গড়ে উঠবে না বিশেষ একটি ধনিক শ্রেণী যারা অর্থবলেই সমাজের প্রভূত্ব লাভ করে। এরাই নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে অত্যাচার, অবিচার, অনাচার ও নানা ধরনের সমাজবিধ্বংসী কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে।
উত্তরাধিকারিত্বের ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান ও প্রতিষ্ঠা ছিল রাসূলের (সঃ) অনন্য অবদান। ইসলাম পূর্ব যুগে সাধারন ভাবে সম্পত্তিতে নারীদের কোন অধিকার ছিল না। ক্ষেত্রবিশেষে অনুকম্পাবশতঃ কাউকে কিছু দিলেও তা ছিল নিতান্তই দয়ার দান, অধিকার নয়। কিন্ত কখনোই কন্যারা পিতার বা স্ত্রীরা স্বামীর সম্পত্তির মালিকানা বা উত্তরাধিকারত্ব লাভ করতো না। বরং নারীরা নিজেরাই ছিল পণ্যসামগ্রীর মতো।
উহুদ যুদ্ধে ৭০ জন মুসলিম শহীদ হন। ফলে তাদের পরিত্যক্ত জমিজমা ও অন্যান্য সম্পদ বন্টন সম্পর্কে ইসলামের পথ নির্দেশ জানার প্রয়োজন দেখা দেয়। সে সময়টিতে আল্লাহ উত্তরাধিকার আইন নাযিল করেন-
আল্লাহর রাসূল (সঃ) মদীনা রাষ্ট্রে এই উত্তরাধিকার আইন প্রবর্তন করেন। এই সর্ম্পকে বিস্তারিত জানার জন্য সূরা নিসা-৭,১১,১২,১৩,১৪, ১৭৬ আয়াত সুমুহ দেখা যেতে পারে।
১৫. যাকাত ব্যবস্থা –
যাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। আল-কুরআনে বার বার নামাজ কায়েমের পরই যাকাত আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশেই যাকাত আদায়ের ব্যাপারে রাসূলে করীম (সঃ) সাহাবীগনকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং এজন্য একটা প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলেন। কেন যাকাতের এই গুরুত্ব? ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদ বন্টন তথা সামাজিক সাম্য অর্জনের অন্যতম মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসাবেই যাকাত গণ্য হয়ে থাকে। সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে বিরাজমান ব্যাপক পার্থক্য হ্রাসের জন্য যাকাত একটি অত্যান্ত উপযোগী হাতিয়ার। যাকাতের সঙ্গে প্রচলিত অন্যান্য সব ধরনের করের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কারন ইসলামের এই মৌলিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একাধারে নৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মূল্যবোধ অন্তর্নিহিত রয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন যাকাত কাদের প্রাপ্য অর্থাৎ কাদের মধ্যে যাকাতের অর্থ বন্টন করে দিতে হবে সে সম্পর্কে সূরা তাওবা ৬০ নং আয়াতে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন।
১৬. অর্থনৈতিক ব্যবস্থা –
রাসূলে করীম (সঃ) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে বায়তুল মালেরও প্রতিষ্ঠা করেন। বায়তুলমাল বলতে সরকারের অর্থসম্বন্ধীয় কর্মকান্ড বুঝায় না। বরং বিভিন্ন উৎস হতে অর্জিত ও রাষ্ট্রের কোষাগারে জমাকৃত ধন-সম্পদকেই বায়তুল মাল বলা হয়। ইসলামী রাষ্ট্রের সকল নাগরিকেরই এতে সম্মিলিত মালিকানা রয়েছে। প্রচলিত রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা রাজকীয় ধনাগারের সঙ্গে এর মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুল মালে সঞ্চিত ধন সম্পদের উপর জাতি-ধর্ম বর্ণ-গোত্র-ভাষা নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণের সাধারন অধিকার স্বীকৃত । রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে একজন লোকও যেন মৌলিক মানবিক প্রয়োজন হতে বঞ্চিত না হয় তার ব্যবস্থা করা বায়তুল মালের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব।
১৭. শিক্ষা ব্যবস্থা-
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে প্রথম ওহি নাযিল করেছেন সূরা আলাকের ১-৫ আয়াত পর্যন্ত জ্ঞান অর্জনের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। জ্ঞান ছাড়া দ্বীনের উপর অবিচল থাকা সম্ভব নয়, আল্লাহ যার কল্যাণ কামনা করেন তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করে থাকেন। (বুখারী -মুসলিম) প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর উপর ইলম শিক্ষা করা ফরজ। (ইবনে মাজা)
সন্তানদের কুরআন, ঈমান, আকিদা ইত্যাদি বিষয়ে প্রথমে শিক্ষা দিতে হবে। তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাত সর্ম্পকে পরিস্কার নির্ভুল ধারনা দিতে হবে, ইবাদতের নিয়ম-কানুন শিখাতে হবে, যেমন-নামাজ, রোজা ইত্যাদি ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত ও নফল ইবাদত সমুহের তা’লিম দিতে হবে। সুন্দর নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার চাইতে উত্তম কিছুই মা বাবা সন্তানদের দান করতে পারে না। (তিরমিজি) সূরা আররাহমান-১-৪, সূরা রা‘দ-১৬, মুজাদালা-১১, নিসা-২, ৮, ১০।
১৮. আদম শুমারী-
হিজরী দ্বিতীয় সনে রোজা ফরজ হয়। সেই বছরই রমজান মাসে নবীজী (সঃ) নাগরিকগনের আদম শুমারী করার ব্যবস্থা করেন। এক নির্দেশে তিনি বলেছিলেন, মুসলিম নর-নারী ও শিশুদের প্রত্যেকের নাম একটি দফতরে (বড় খাতায়) লিপিবদ্ধ কর-যাতে প্রত্যেকেরই হাল অবস্থা জানা যায়। এই নির্দেশ সংগে সংগে পালিত হয়েছিল। অনেক সমাজবিজ্ঞানীই অনুমান করেন যে, হিজরী দ্বিতীয় সনের রমজানে অনুষ্ঠিত এ আদম শুমারীই সম্ভবত সর্বপ্রথম লিখিত আদম শুমারী। কেন এ অভিনব ব্যবস্থা গ্রহন করা হল এর জবাব একটিই-সকল শ্রেণীর নাগরীক সর্ম্পকে আমীর বা ইসলামী হুকুমতের রাষ্ট্রপ্রধান যাতে সরাসরি অবহিত হতে পারেন, সেজন্যই এই ব্যবস্থা। খেলাফত আমলে নাগরিকগনের, বিশেষত শহর-গ্রাম নির্বিশেষে প্রত্যেক জনপদের মুসলমানদের নাম খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখাকে শাসক কর্তৃপক্ষ একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত মনে করতেন। (সিরাতকোষ-৬২ পৃষ্টা)
১৯. দাওয়াত ও তাবলীগ-
রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভের পূর্বে রাসূল (সঃ) মক্কায় ১৩ বৎসর দাওয়াত দিয়েছেন ও লোক গঠন করেছেন। তাছাড়া রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভের পর রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রধানদের নিকট দাওয়াতী বার্তা প্রেরন করেছেন। যেমন রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে চিঠি লিখেন, ইরানের সম্রাট খসরু পারভেজকে চিঠি লিখেন এই ভাবে মিশর, বসরা, দামেস্ক, বাহারাইন, ওমান প্রভৃতি অঞ্চলের শাসকদের নিকট চিঠির মাধ্যেমে ইসলাম গ্রহন ও দ্বীনের প্রতি আহবান জানান। চিঠির ভাষা ছিল ‘আমি তোমাকে ইসলামের আহবান জানাচ্ছি আল্লাহর আনুগত্য কবুল কর, তুমি শান্তিতে থাকবে। আল্লাহ তোমাকে দ্বিগুন প্রতিফল দিবেন। তা না হলে আগুন পুজারীদের গুনাহের জন্য তুমি দায়ী থাকবে।’
সম্মানীত আলেম সমাজ অতএব বর্তমানে আমরা যে যেখানে যেভাবে আছি সেখানে জনগনকে আল্লাহর দ্বীনের আহবান জানাতে হবে। ইসলামের সঠিকরূপ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হবে। কেননা إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ আল্লাহর নিকট শুধুমাত্র একমাত্র পছন্দনীয় দ্বীন হচ্ছে ইসলাম।
(وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ)
আর যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন অনুসরন করবে তার সে দ্বীন আল্লাহর পক্ষ থেকে কিছুই কবুল করা হবে না। (আল ইমরান-৮৫)
সম্মানিত উপস্থিতি আমাদেরকে ঈমান ও আকিদার উপর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতে হবে। ইসলামের মূলরূপকে প্রজ্জলিত ও উ™ভাসিত করতে হবে। ঝিমিয়ে পড়া সমাজের লোকদেরকে জাগাতে হবে। তাই আসুন আমরা সর্বস্তরের জনগনের নিকট ইসলামের পূর্নাঙ্গরূপ পৌছে দেয়ার চেষ্টা করি, আল্লাহ আমাদের সহায় হোন “আমীন”।