১৪তম পর্ব
পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ :
রাজশাহীতে এসে কাজে যোগাদানের ইচ্ছাপত্র (জয়েনিং রিপোর্ট) দাখিল করলাম ‘লাষ্ট-পে সার্টিফিকেট’ চাওয়া হলো। ঘটনার কথা বললাম এবং বিনা লাষ্ট-পে সার্টিফিকেটে জয়েনিং রিপোর্ট গ্রহণ করার অনুরোধ জানালাম। কিন্তু কোন ফল হলো না। বৃটিশ আমল থেকে এই আইন চলে আসছে, কি করে তার বিরুদ্ধাচরণ করা যেতে পারে?
বেতন পাওয়া বন্ধ হলো। একরূপ রিক্তহস্তে রাজশাহীতে এসেছি। নতুন জায়গা ধার কর্জই বা কে দেবে? নোয়াখালীতে প্রবল বন্যা হয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে ধান, চাল, সংগ্রহ করে ওখানে পাঠানো দরকার। খাদ্যসংগ্রহ অভিযান (Food drive) চালানোর ব্যবস্থা করা হলো। দারুণ বর্ষা। আমাকে দুর্গম বাগমারা থানার দায়িত্ব দেয়া হলো। নিজের অবস্থা জানিয়ে কিছু অগ্রিম (Advance) টাকার জন্যে আবেদন করলাম। প্রশ্ন দেখা দিল- বেতন যে পায় না, তাকে অগ্রিম দেয়া হবে কোন আইনে? আবেদন মাঠে মারা গেল।
রাজশাহীর তদানীন্তনত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের বাড়ী ছিল মুর্শিদাবাদে অর্থাৎ হিন্দুস্তান মালদহের আচার্য মহাশয় তাঁর বিশেষ দূতকে রাজশাহীতে পাঠিয়ে মালগুলো ফেরৎ দেওয়ার জন্যে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তাই আমাদেরকে বলা হয়েছিলঃ ‘আমরা যেন অনর্থক ঝামেলা বাদ দিয়ে মালপত্রগুলোকে ওদের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে আসি এবং লাষ্ট-পে-সার্টিফিকেট নিয়ে এনে আরামে চাকুরী করি। ’ জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এবং বিভাগীয় কমিশনার এ উভয়ের কেউ যখন আমাদের কথার যৌক্তিকতা মেনে নিতে পারলেন না, তখন অগত্যা ছুটি নিয়ে আমি ঢাকা যাই। উল্লেখ্য যে, মালপত্র সরিয়ে দেয়ার পরেই আমি গোপনে মালদহ থেকে ঢাকা গিয়ে বিষয়টা কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত করে এসেছিলাম। আমরা ঠিক কাজ করেছি দেখে তাঁরা খুশীই হয়েছিলেন।
ঢাকা গিয়ে ডাইরেক্টর সাহেবকে বর্তমানে পরিস্থিতির কথা বুঝিয়ে বলতেই তিনি সিনেমা ইউনিটটিকে নওয়াবগঞ্জ থানা থেকে রাজশাহীতে এনে তার সাহায্যে অতি শীঘ্র কাজ শুরু করা এবং বিনা লাষ্ট পে-সার্টিফিকেটে আমাদের বেতন ভাড়া পরিশোধের ব্যবস্থা করার জন্যে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটকে অনুরোধ জানিয়ে পত্র লিখেন। অর্থাৎ ঢাকা থেকে ফিরে এসে সব বকেয়া বেতন পেয়ে যাই, ফলে নিশ্চিন্ত মনে কাজ শুরু করা সম্ভব হয়।
হিন্দু কর্মচারীরা প্রায় সকলেই হিন্দুস্তানে চলে গিয়েছিলেন। কোন কোন অফিসে কর্মচারী নেই, পিওন নেই, কালি-কলম নেই, এমনকি টেবিল-চেয়ার পর্যন্ত নেই। অথচ অবিরাম কাজ চলছে। কে কোন ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী তা নিয়ে কোন বাদ-বিবাদ নেই। কাজ পেলেই হলো। কোন কোন কর্মচারী দিনরাত খেটে দু’তিনটি ডিপার্টমেন্টের কাজ চালাচ্ছেন। এমনটাও দেখা গিয়েছে। সবাই দেশ গড়ার জন্যে পাগল। কোন কোন মাসে যথাসময়ে বেতন পাওয়া যেতো না। কিন্তু তা নিয়ে কোন অভিযোগ ছিল না।
সর্বজনাব, এ. মজিদ সি.এস.পি; আর.খান; এ. হাই; ফজলুল হক; আবদুল কুদ্দুছ; মোকাররম হোসেন; নুরুল আনোয়ার; আবদুল মালেক; আঃ জব্বার; অনারারী ম্যাজিষ্ট্রেট ও সুসাহিত্যিক এ. সামাদ প্রভৃতি অফিসারবৃন্দের উৎসাহ উদ্দীপনা এবং কর্মতৎপরতা দেখে আশায় ও আনন্দে আমার বুক ভরে যেতো, মনে হতো সব যেন কোন এক প্রসিদ্ধ ফুটবল টিমের নামকরা খেলোয়াড়।
দুঃখের বিষয়, অল্প দিনের মধ্যে নানা কারণে উর্ধ্বতন মহলের কার্যকলাপ সম্পর্কে একটা সন্দেহ ও অবিশ্বাস অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দিনে দিনে এই সন্দেহ ও অবিশ্বাস যত বাড়তে থাকে, স্বাভাবিক নিয়মে নিন্মতন মহলের উৎসাহ, কর্মতৎপরতা এবং ত্যাগের মানসিকতাও ততাই হ্রাস পেতে থাকে।
সেই মর্মান্তিক ঘটনা প্রবাহের কথা প্রায় সকলেরই জানা রয়েছে। নতুন করে লিখার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
সেই মর্মান্তিক ঘটনা-প্রবাহের একটি ঃ
মা খবর দিয়েছেন আমার নব-জাত প্রথম সন্তানটিকে দেখার জন্যে তিনি রাজশাহী আসছেন। তাঁর থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা কোথায় করা যায় তা নিয়ে সমস্যায় পড়লাম। বাঘার এককালীন জমিদার সুপরিচিত শৈলেন শাহ চৌধুরী অতি সহজেই সমস্যার সমাধান করে দিলেন। রাজশাহী শহরের কুমার পাড়াতে তিনি থাকতেন। পিতৃ-পিতামহের দেয়া দেবোত্তর সম্পত্তির তিনি ছিলেন সেবায়েত। কুমারপাড়ার বাড়ীতে চিবগ্রহ প্রতিষ্ঠিত ছিল। পুরোহিত ঠাকুর প্রত্যহ বেঁধে বিগ্রহের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতেন। শৈলেন বাবু বললেন যে, সেই বিগ্রহের প্রাসাদ হলেই মার’ চলে যাবে এবং রাত্রি যাপনের ব্যবস্থাও তিনি করবেন। শৈলেন বাবুর কথা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
তিন দিন পরে আমার ছোট ভাইটিকে সাথে নিয়ে মা রাজশাহীতে এলেন। সকাল বেলা আমার বাড়ীতে আসেন, দুপুরে চলে যান, আবার বিকেলে এসে কিছুক্ষণ রাত পর্যন্ত থাকেন। কাজের তাকিদে আমাকে প্রায় মফস্বল যেতে হয়। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন।
বলা আবশ্যক যে এর কিছুদিন পূর্বেই মরহুম লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন।
একদিন হঠাৎ মা আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন- কিরে খোকা। এখানে ইসলামী রাষ্ট্র হতে আর কত দেরী? পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠিতা এবং প্রথম প্রধান মন্ত্রীর রক্ত দিয়ে। তোর সেই ইসলামী রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হলো নাকি?
একান্ত অপ্রত্যাশিত রূপে মা’র এই প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণের জন্যে স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। পরে অনেক কষ্টে শক্তি সঞ্চয় করত মাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে, এখনও ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান রচিত হয়নি।
এখন যে-সব কাজ-কারবার চলছে, তার সব হলো ইংরেজী আইনের কুফল। পাকিস্তানের আইন যখন চলবে তখন এ সবের নাম গন্ধও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মা দৃঢ়কন্ঠে বললেন- ইসলামী আইন যারা তৈয়ার করবে- এই নৃশংস খুনও তো তারাই করেছে? এদের ইসলামী আইন যে কেমন হবে এখনো কি সেকথা তুই বুঝতে পারিসনি?
কথা বলার ভাষাই যেন আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। মাকে বড় গলা করে কি বলে এসেছিলাম, আর ঘটে চলেছে কি? তবু বুদ্ধি করে বললাম – না, না এরা আইন রচনা করবে কেন? সে জন্যে ভিন্ন লোক রয়েছেন।
মা বললেন-তুই দেখে নিস আইনের জায়গায় আইন পড়ে থাকবে, কাজের বেলায় ঠনঠন। হিন্দু শাস্ত্রেও অনেক ভাল ভাল কথা রয়েছে। কিন্তু কেউ তা মানে না। নরককে যারা ভয় করে জেলের ভয় তারা করবে কেন?
লজ্জায়, ক্ষোভে এবং দুঃখে প্রায় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। বুকে কত বড় আশা নিয়ে মার কাছে ইসলামী রাষ্ট্রে কথা বলেছিলাম। আর আজ আমার সেই আশার মুখে ছাই দিয়ে সম্পূর্ণ ইসলামী বিরোধী কাজ কারবার চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ সাহেবের উল্টা-পাল্টা কথা শুনেই তাঁদের ইসলামী রাষ্ট্র কেমন হবে সেটা আঁচ করে শিউরে উঠেছিলাম। একদিন তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হয়ে রয়েছে। পবিত্র কুরআন হলো পাকিস্তানের সেই সংবিধান। ’ অন্যদিকে বলেন, ‘এদেশের হিন্দু হিন্দু নয় মুসলমানও মুসলমান নয়; এখন আমরা সবাই পাকিস্তানী। ’
বলা বাহুল্য, এ কথা দ্বারা তিনি ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের কথাই বলে ছিলেন। অথচ ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ ইসলাম সমর্থন করে না করতে পারে না।
মহিমাগঞ্জ আলীয়া মাদ্রাসার আমার শ্রদ্ধেয় উস্তাদ আলহাজ্ব মাওলানা রহীম বক্স সাহেবের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কিন্তু একটি কাজের জন্যে তিনি আমার উপরে কিছুটা অসন্তুষ্ট ছিলেন; সেটা হলো পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার প্রতি আমার দৃঢ় সমর্থন। একদিন কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন- ‘দেখ আবুল হোসেন! যারা নিজেদের সাড়ে তিন হাত দেহের উপরে ইসলামকে কায়েম করতে পারেনি, তারা একটা বিরাট দেশের উপরে ইসলাম কায়েম করবে- একমাত্র পাগল ছাড়া আর কেউ একথা বিশ্বাস করতে পারে না ‘যে পাকিস্তানের জন্যে তোমরা এখন পাগল হয়ে উঠছো একদিন তোমরাই সেই পাকিস্তান থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্যে পথ খুঁজে বেড়াবে। কিন্তু পথের সন্ধান তোমরা পাবে না- আমার শ্রদ্ধেয় উস্তাদজী আজ নেই। কিন্তু তাঁর এই কথাগুলো ইথারের উপরে ভেসে চিরদিন থেকে যাবে। আর থেকে যাবে আমার মনের পাতার পরতে পরতে যতদিন আমার এই দেহটা কবরের মাটি হয়ে না যায়।
পাকিস্তান তথা আমার স্বজন-পরিজনদের কাছে সত্যিকারের ইসলামী চরিত্রকে সার্থকভাবে তুলে ধরার নেশায় সেদিন এমনভাবেই মেতে উঠেছিলাম যে আমর স্নেহশীল উস্তাদজী নারাজ হবেন সেকথা জেনেও নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারিনি। তাই আজ এই বৃদ্ধি বয়সে চোখের পানিতে আমাকে বুক ভাসাতে হচ্ছে। আর এমনিভাবে চোখের পানি নিয়েই একদিন আমাকে কবরে যেতে হবে।
এ ঘটনার পর আমার স্নেহশীলা জননী আরো দু’দিন রাজশাহীতে ছিলেন। সাধ্যপক্ষে আমি তাঁকে এড়িয়ে চলতাম। তিনি সেটা বুঝতে পরেছিলেন।
বিদায়ের সময়ে আমাকে কাছে ডেকে স্নেহভরা কন্ঠে তিনি বললেন-‘বোকা ছেলে। পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন? আমি যে তোর মা এবং তোকে যে আমি পেটে ধরেছি, সেকথা কেন ভুলে যাস? মা হয়ে ছেলের মনের কথা বুঝবো না সেটা কি করে সম্ভব?’
‘পাকিস্তানে ইসলামী আইন হলে ভালই হতো। আমিও সেই আশাই করেছিলাম কিন্তু দুষ্ট লোকেরা তা যেতে হতে দিবে না লিয়াকত আলী সাহেবকে খুন করার সাথে সাথেই সেকথা বুঝতে পারা গিয়েছে। ’
তারপর আমার মাথায় হাত রেখে তিনি বললেন- ‘তোকে ফিরানোর বহু চেষ্টাই আমরা করেছি। কিন্তু সবই বৃথা হয়েছে। আর দেখা হবে কিনা জানি না। আশা-যাওয়ার ভীষণ ঝামেলা। তুই যাসনা বলেই কষ্ট করে আমাকে আসতে হয়। যাওয়ার সময়ে বলে যাচ্ছি- ইসলামী আইন হোক আর না হোক নিজেরা সর্বদা সৎপথে থাকবি। ভগবানকে কখনো ভুলবি না। আর কখন কেমন থাকিস তোর এই চির দুঃখিনী মাকে সে কথা জানাবি। দাদু ভাই এবং বৌমার প্রতি লক্ষ্য রাখবি। ’
এ বলে তিনি তাঁর দাদু ভাইকে কোলে তুলে নিযে চুমু খেলেন, তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। তারপর দ্রুতপদে বের হয়ে গেলেন। মনে হলো তিনি কান্না চেপে রাখতে পাচ্ছিলেন না এবং এটাই তাঁর দ্রুতপদে বের হয়ে যাওয়ার কারণ।
১ম পর্ব ২য় পর্ব ৩য় পর্ব ৪র্থ পর্ব ৫ম পর্ব ৬ষ্ঠ পর্ব ৭ম পর্ব ৮ম পর্ব ৯ম পর্ব ১০ম পর্ব ১১ পর্ব ১২তম পর্ব ১৩তম পর্ব