New Muslims APP

ভালোবাসা পেতে হলে

ভালোবাসা

ভালোবাসা পেতে হলে

পূর্বে প্রকাশিতের পর

৪র্থ পর্ব
আমার জীবনেরই আর একটি ঘটনা যা বলতে না পারলে মনে হয় কথাটা ঠিকমত বোঝাতে পারব না।

যশোর শহরে আমি একটা বাড়ি কিনেছিলাম। যা এক ব্যক্তি ‘হাউস বিল্ডিং করপোরেশন’ থেকে লোন নিয়ে তৈরী করেছিল। আমি তার কাছ থেকে সল্প মূল্যে কিনলাম তবে ধীরে ধীরে লোন পরিশোধ করতে হবে আমাকে। ঐ বাড়ির পাশেই আমার ছোট খালার তিন শতক জমি ছিল। এমনিই মাঠের মতো পড়েছিল। কোনো গাছ-টাছ ও লাগানো ছিলনা। বর্ষাকাল। একটু বৃষ্টি হলেই আমার উঠোনে পানি জমা হয়ে যায়। তাই একদিন দুইজন পাইট নিয়ে ছোট খালার জমি থেকে কিছু মাটি কেটে এনে আমার উঠোনে দিলাম। ভাবলাম বর্ষা পার হলে পুকুর থেকে মাটি এনে ছোট খালার জমিটা ভরে দেব। কিন্তু ছোট খালা একদিন দেখে খুবই চিল্লাপাল্লা করতে লাগলো। আমার মায়ের কাছে নালিশ করল। আমি তাড়াতাড়ি ছোট খালার হাত চেপে ধরে বললাম “খালা রাগ করিস না, এই বর্ষাটা পার হলেই তোর জমি ভরাট করে দেবো।” ছোট খালা আমার বয়সে ছোট। আমাকেও খালা বলে ডাকে। বললো “না খালা কাজটা তুমি ভালো করোনি।”
আমি বললাম “খালা ঠেকায় পড়ে করেছি। তুই কিছু ভাবিস নে, তোর জমি আমি ঠিকই ভরে দেব।” যা হোক অসন্তুষ্টি মন নিয়েই খালা চুপ করে গেলো। এদিকে ‘নূর’ শুধু বারবার বলতে লাগলো “এই লোন পরিশোধ করার সামর্থ আমার নেই। এর চেয়ে দু’কাঠা জমি কিনতে পারলেও ভালো হতো। যেদিন পারতাম সেদিন বাড়ি করতাম। পছন্দ মতো বাড়ি করতাম।” তাই বাড়ি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ছোট খালা জানতে পেরে বললো “তাহলে বাড়ি আমাকেই দাও আমি লোন পরিশোধ করি। আর আমার জমি তুমি নাও।” তাই করলাম। এখন যে জমি থেকে মাটি কেটে বাড়ির উঠোন উঁচু করেছিলাম সেই বাড়িটা ছোট খালার আর ছোট খালার যে জমি আমি গর্ত করেছিলাম সেই জমি আমার। দুনিয়াতে যার এভাবে মালিকানা পরিবর্তন হয় সেই সম্পদ নিয়ে মানুষের সাথে ঝামেলা করা, ঝগড়া ঝাটি করার কোনো মানে আছে? আর বিশ বছর পরে আমার এই বাড়িতে এই ঘরে যারা বাস করবে তাদের আমি চিনি না। বিশ বছরতো অনেক দূরের কথা বললাম। আমার মৃত্যুর কোনো তারিখ তো আমার জানা নেই। আমি এই মুহূর্তে মারা গেলে আমার বাড়ি ঘর, পোশাক, গহনা, তৈজসপত্র সব-সব কিছুর যে মালিক হবে সে হচ্ছে আমার এই ‘বাঙ্গালী নারী জনমের সবচেয়ে বড় দুশমন আমার সতীন।
তাহলে আমি কেন হক নাহক সম্পদের পাহাড় গড়ব? কেনো Hasband এর সাথে কিংবা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সাথে অযথা মনোমালিন্য কিংবা ঝগড়া ঝাটি করব?
এই সম্পদের জন্য আর একটা চরম অন্যায় কঠিন গুনাহের কাজ আমাদের দেশের ৯৯% লোকেই করে বলে আমার ধারনা। তা হলো বোন কিংবা কন্যা সন্তানকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা। এইসব ক্ষেত্রে সবটুকু Sacrifice করতে হয় বেচারী বোন কিংবা হতভাগী মেয়েটিকে। সম্পত্তির দাবী ছেড়ে দিয়ে তাকে Compromise এ আসতে হয়। এতো জুলুম চরম জুলুম। অধিকাংশ বাবা ও ভাইয়েরা এই জুলুম করে কন্যা ও ভগ্নীদের সাথে। অনেক সময় মা ও এই জুলুমে অংশ নেয়। মা মেয়েকে আদর করে বলে “তোমাকে তো ভাল জায়গায় বিয়ে দিয়েছি তোমার তো তেমন অভাব নেই। আমরা আর কয়দিন আছি? আমরা মরে যাওয়ার পর এই ভাইয়ের বাড়ি তোমাকে আসতে হবে। এই সম্পত্তি তুমি ভাইকে লিখে দাও।” এরপর মেয়ে চুপ করে থাকতে বাধ্য।
তা বাবা ছেলেকে বলুক তো ‘তোমার বোনের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। তোমার তো অভাব নেই। তোমার অংশটা বোনকে দিয়ে দাও। কিংবা কিছুটা বেশি দিয়ে দাও। দেখুক তো তার আদরের দুলাল মানে কিনা কথাটা? একটু Sacrifice করে কিনা? কিন্তু Sacrifice মেয়েরা করে আসছে যুগযুগ ধরে। অবশ্য একে Sacrifice বললে ভুল হবে। বলতে হবে মেয়েরা মুখবন্ধ করে এই জুলুম সহ্য করে আসছে যুগযুগ ধরে।
আবার অনেক ক্ষেত্রে বাবারা জীবদ্দশাতেই জমিজমা লিখে দেয় ছেলেদের নামে যাতে পরবর্তীতে মেয়েরা নিতে না পারে। আমার পরিচিত এক ভদ্র লোক একদিন ছেলেদের বললো “তোমাদের তিন ভাইকে দশ বিঘা করে ত্রিশ বিঘা জমি আমি গতকাল রেজিস্ট্রি অফিসে যেয়ে দলিল করে দিলাম। বড় ছেলে বাহার বললো “কেন বাবা?”
বাবা হাসি মুখে বললো “এমনি দশ বিঘা আলাদা করে দিলাম।”
ছেলে আবার বললো “তোমার চার মেয়েকে কি দিলে?” “আমার তো আরো জমি আছে সেখান থেকে তারা নেবে।”
ছেলে বললো “বাবা তুমি গত বছর হজ্জ করে এসেছ। পেছনের গুনাহ হয়ত আল্লাহ পাক সব মাফ করে দিয়েছেন। সেই নিষ্পাপ আমল নামাটা কেনো আবার ওয়ারিশ ঠকানো পাপে পূর্ণ করবে? হয় তুমি এই জমি ফেরৎ নাও, না হয় তোমার চার মেয়েকে পাঁচ বিঘা করে বিশ বিঘা লিখে দাও। তা না হলে আখেরাতে তুমি তো মহাবিপদে পড়ে যাবে বাবা।” বাবা আর কি করবেন চার মেয়েকে পাঁচ বিঘা করে জমি লিখে দিয়ে এলেন। এই ভদ্রলোকের ছেলে বাহারের মতো ছেলে আমাদের সমাজের কয়জনের আছে?
ছেলেরা বরং চাপ সৃষ্টি করে বোনদের ঠকিয়ে মা বাবার কাছ থেকে জমি লিখে নেয়। আর যে বাবারা কাউকে লিখে না দিয়ে মারা যান সে সম্পদও ভাইয়েরা বোনদের দেয়না দিতে চায় না। বোনেরা নিতে চাইলে বোনদের সাথে সম্পর্কই নষ্ট করে দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বোনেরা বঞ্চিত হয় বাবা মায়ের সম্পদ থেকে।
না এর ব্যতিক্রমও আছে। একদিন আব্বা আমাকে বললেন “তুমি নাকি বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দাও ইসলামের দৃষ্টিকোন থেকে। তা আমার সমস্যার একটা সমাধান দাও তো।” হাসিমুখে বললাম “কি আপনার সমস্যা?”
আব্বা বললেন, “আমার বোনের বিয়ের সময় আমার বাবা এক বিঘা জমি বিক্রি করেন। এই মর্মে একটা মৌখিক শর্ত রাখেন যে কোনোদিন যদি সেই ব্যক্তি এই জমি বিক্রয় করে তাহলে যেনো আগে আমাদের জানায়। তের বছর পর ঐ ব্যক্তি সেই জমি বিক্রি করবে বলে আমাদের জানায়। তখন আমি প্রায় তিনগুণ মূল্যে ঐ জমি খরিদ করি। যেহেতু বাবা আছেন তাই জমিটা আমার নামে দলিল না করে বাবার নামেই দলিল করি। বাবা অবশ্য বলেছিলেন ‘তোমার নামেই দলিল করো’ কিন্তু আমার বিবেক সায় দেয়নি। আমার রোজগারের টাকা দিয়েই আমি জমিটা খরিদ করেছিলাম। এমন কি ঐ সময় টাকা কিছু কম পড়াতে তোমার মা’র গহনা বিক্রি করে টাকা জোগার করেছিলাম।
এখন তো বাবা নেই, মা নেই। আমরা দুই ভাই বোন। সব সম্পত্তির তিনভাগের একভাগ তোমার ফুপু আম্মা পাবে। তা আমার ঐ জমির অংশ কি তোমার ফুপুকে দিতে হবে?
বললাম “বাহ্যিক আইনে তো দিতে হবেই যেহেতু তার বাবার নামে জমি। তা সে যেই খরিদ করুক।
আব্বা হাসি মুখে বললেন “আভ্যন্তরিন দৃষ্টিতে?”
আমি বললাম “আপনি ঐ হাদিসটা জানেন না? তুমি আর তোমার সম্পত্তি তোমার বাবার।”
আব্বা হাসলেন বললেন “রায়টা ফুপুর পক্ষে দিলে।”
বললাম “না আপনার পক্ষেই দিয়েছি। হাদীসটা তো ঠিক তাই না? আপনার মৃত্যুর পর এই সম্পত্তি আপনার বোনের ছেলে মেয়েরা ভোগ করল না সবটাই আপনার সন্তানেরা ভোগ করল তাতে আপনার কি এসে যায়? আমি চাই আখেরাতে কোনো প্রকার সমস্যায় যেনো আপনি না পড়েন।”
আমার আব্বা কি যে খুশী হলেন আমার কথায়।
আমার আব্বা তার সমুদয় পিতৃ সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগ তার বোনকে বুঝিয়ে দেন। আমার ফুপুআম্মা নিতে চাননি। বলেছেন “ ভাই তুমি কেনো এই ভাবে জোর করে দিচ্ছ? আমি কি তোমার কাছে চেয়েছি? মানুষে শুনলে কি বলবে?”
আব্বা বলতেন “চাওয়া চাওয়ির কি আছে? আর মানুষের ই বা বলার কি আছে? তোমার সম্পত্তি তুমি নেবে ব্যাস”।
আমার ফুপুআম্মার সাথে কথা বলতে গেলে-দেখা করতে গেলে তার ভাই এর প্রসংগ ছাড়া কথা শেষ হয় না।
বলেন, আমার ভাই এর মতো এমন ভাই আর কি কোথাও আছে রুমী? আগেতো আমি ভাই সোহাগী ছিলাম এখন হয়েছি ভাই শোকি। ভাই এর প্রসংগ আসলেই কাঁদতে থাকেন আমার ফুপু আম্মা।
আহা! এমন ভাই যদি ঘরে ঘরে জন্ম নিত।
অনেক জায়গায় আবার এই রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পিতার মৃত্যুর পরে বোনদের সব সম্পত্তি এমন কি মায়ের সম্পত্তিও আলাদা করে এক ভাইকে দিয়ে দেওয়া হয়। মা বোনের দায় দায়িত্ব তখন সেই ভাই-ই পালন করে। বিবাহিতা বোন এই ভাই এর বাড়িতেই বেড়াতে আসে অন্য ভাইয়েরা তখন প্রায় পর হয়ে যায়। কি আজিব কথা, ভাই এর বাড়ী বেড়াতে আসলে সম্পত্তি জমা রেখে বেড়াতে আসতে হবে। অথচ ভাই যখন বোনের বাড়িতে যায় বোন তাকে জান প্রান দিয়ে আদর করার চেষ্টা করে। কেনো? বোনের বাড়িতে ভাই কি সম্পদ জমা রেখে এসেছে?
না, কোনো অজুহাতেই বোনের কিংবা মেয়ের সম্পত্তি আটকে রাখা যাবেনা। তা বোন ধনী হোক আর যাই হোক। তার নির্দিষ্ট পাওনা তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। যারা আল্লাহ রচিত মিরাস আইন পরিবর্তন করে তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা চিরন্তন আযাবের ভয় দেখিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, “আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের নাফরমানী করবে এবং তার নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করে যাবে তাকে আল্লাহ আগুনে নিক্ষেপ করবেন। সেখানে সে থাকবে চিরকাল। আর তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণা ও অপমানজনক শাস্তি। (সূরা: নিসা-১৪)
উপরিউক্ত আয়াতটি সম্পত্তি বন্টন সংক্রান্ত আল্লাহর বিধান যারা লঙ্ঘন করবে তাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্য আর পরিতাপের বিষয় এই যে, এমন মারাত্মক ক্ষতি প্রদর্শন করার পরও মুসলমানরা নামায রোজা হজ্ব যাকাতের পাবন্দি হয়েও মীরাস আইনের ব্যাপারে যে নাফরমানি করছে তা আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল।
দু’একটি ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া প্রায় সবত্র এই নাফরমানি চলছে। ধনী, গরীব নির্বিশেষে এই কঠিন গুনাহে নিমজ্জিত। যারা কুরআন হাদীস জানে না তারা তো অনেকে মনে করে মেয়েরা বাপের সম্পত্তি নেওয়া মানে অতিবড় নিন্দার কাজ। আর যারা কুরআন হাদীসে অবুঝ নয় তারাও যেনো এই একটি ব্যাপারে চরম ভাবে অবুঝ।
বাপ ভাই এর এই নির্যাতন থেকে কবে মুক্তি পাবে নারী? কবে ইসলামের অনুসারী হবে এই সব পুরুষেরা? কবরে মান রব্বুকা-ওয়া মা দ্বীনুকার কি উত্তর দেবে তারা?
এই বাবাদের মন মানষিকতা আমি বুঝতে পারিনা। পুত্রটি তার সন্তান আর মেয়েটি কি তার সন্তান নয়? অথচ রাসূল (সা.) কতো দিক নির্দেশনা দিয়েছেন কন্যাটিকে তার ন্যায্য অধিকার দেওয়ার জন্য।
এই বাবা আর ভাইদের অন্তরেকি আল্লাহপাক ভালোবাসা নামক অনুভূতিটি দেন নি? এই চরম স্বার্থপর মানুষগুলোর অন্তর থেকে ভালোবাসার সাথে আল্লাহর ভয়ও উঠে গেছে। কারণ অনেক সময় এদের মুখ থেকে বলতে শোনা যায় আমার স্ত্রী কিংবা পুত্রবধূও তো বাপের বাড়ির সম্পত্তি আনতে পারেনি তো আমি আমার বোন কিংবা মেয়েকে দেব কেন? কথাটা কি হলো? আমার স্ত্রীর কিংবা পূত্রবধূর বাপ ভাই যদি জাহান্নামে জ্বলে তো আমি জ্বলব না কেন?

One thought on “ভালোবাসা পেতে হলে

Leave a Reply


This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.