New Muslims APP

পত্র-পত্রিকায় ও ইন্টারনেটে লেখা-লেখি

পত্র-পত্রিকায় ও ইন্টারনেটে লেখা-লেখি

পত্র-পত্রিকায় ও ইন্টারনেটে লেখা-লেখি

ভূমিকাঃ আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষার ঐতিহ্য রক্ষা তথা তার প্রচার প্রসারের জন্য দেশ-বিদেশে অনেকেই অনেক শ্রম, শক্তি ব্যয় করে মেধার বিকাশ সাধনের মাধ্যমে বাংলাভাষায় সাহিত্যচর্চা করছি। কিন্তু আমাদের মধ্যে সম্ভবত অনেকেরই প্রকৃত সাহিত্যজ্ঞান সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। ফলে সাহিত্যের মাধ্যমে যেখানে মানবকল্যাণ সাধিত হওয়ার কথা, সেখানে তা না হয়ে, মানুষ আজ কিছু সাহিত্যের মাধ্যমে পথভ্রান্ত হয়ে নর-পশুতে পরিণত হচ্ছে। আমরা যারা পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে বা বই পুস্তক প্রকাশ করে সাহিত্যচর্চা করছি, আমাদের কেমন ধরনের সাহিত্যচর্চা করা উচিত? ইসলামের আলোকে সে সম্পর্কে আমরা কিছু আলোকপাত করারা চেষ্টা করছি। আশা করি এ সামান্য পথপরিক্রমাটি আমাদের সাহিত্যকর্মীগণের জন্যে অনেকটাই দিশারী হিসেবে কাজ করতে পারে। উদ্দেশ্য, যাতে আমরা অশ্লীল ও অশালীন সাহিত্যের চর্চা করে মানুষকে তাদের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত না করে, সুন্দর ও সৃজনশীল সাহিত্যের মাধ্যমে মানবকল্যাণ সাধন করতে পারি এবং সেই সাথে সুস্থ ধারার সাহিত্যচর্চা করে প্রকৃত অর্থে মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের মহাকল্যাণ সাধন করতে পারি। পথপরিক্রমটির কথা যদি আমরা স্মরণে রেখে সাহিত্যচর্চা করি, তবে আশা করি এতে আমাদের অনেকেরই উপকার হবে ইনশা-আল্লাহ।

সাহিত্যের ঠিকানা অশ্লীলতা নয়:

সাহিত্যে উত্তীর্ণ হতে কেবল শব্দ ও বাক্যের গাঁথুনি, নাকি বিষয়েরও কিছু ভূমিকা আছে-এ তর্ক পুরনো। কেউ বলেন, অনুভূতির রূপময় ও হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া বর্ণনাই সাহিত্য। সে বর্ণনার বিষয়বস্তু কী, তা মুখ্য নয়। পক্ষান্তরে কারো কারো বক্তব্য হচ্ছে-মহৎ সুন্দর বিষয়ের উপস্থাপনাই সাহিত্য। মন্দ ও নিন্দিত বিষয়ের বর্ণনা আর যাই হোক; সাহিত্য হতে পারে না।

দু’ধারার এই দু’ভাষ্যে পাওয়া যায় কিছু প্রান্তিকতা। আসলে শব্দ কিংবা বিষয়ের দুর্বলতা যেকোন বর্ণনাকেই সাহিত্যের সীমানা থেকে বাইরে ফেলে দিতে পারে। অপর দিকে বর্ণনার মাধুর্যের পাশাপাশি বিষয়ের মহত্ত্ব পারে শব্দের যেকোন বিন্যাসকেই সাহিত্যে উত্তীর্ণ করতে এবং এটাই সত্য, এটাই স্বাভাবিক ও যুক্তিযুক্ত। সে হিসেবে সাহিত্য হচ্ছে সুন্দর বিষয়ের সুন্দর বর্ণনা। সাহিত্যের এই যুক্তিযুক্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ ধারণা আরবী সাহিত্যের পরিচয়জ্ঞাপক শব্দ ‘আদব’ এবং তার সংজ্ঞা থেকেও ফুটে ওঠে। আরবী সাহিত্যের দীর্ঘকালীন বাস্তবতা এবং তার স্থিত উপাদানও এ ধারণাকে অনেকটা সত্যায়িত ও সুসংবদ্ধ করে তোলে। সামান্য ব্যতিক্রম বাদে ইসলামপূর্ব ও ইসলামপরবর্তী যুগের সাড়া জাগানো গোটা আরবী সাহিত্যের সমৃদ্ধি মূলত মহৎ ও কল্যাণকর বিষয় দ্বারাই সূচিত। বাংলায় সাহিত্য কথাটি যে ‘হিতের সঙ্গদানের’ পরিচয় দেয়, তারও নজির আরবী ভাষার মতই হওয়ার কথা ছিল। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের শুরু, মধ্য ও আধুনিক যুগের সূচনাপর্বে, সিংহভাগের বৈশিষ্ট্যও ছিল ভাল বিষয়ের ভাল বর্ণনা। কিন্তু পরবর্তীতে এ বৈশিষ্ট্যের ব্যত্যয় ঘটতে থাকে। এক পর্যায়ে সাহিত্য হয়ে দাঁড়ায় কেবল রোমাঞ্চধর্মী রচনা। প্রেম-বিরহ এবং কখনো অশ্লীলতার মোড়কে উপস্থাপিত নেতিবাচক বিষয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ। (জাম্বিল-জহুরী)

বাংলায় ‘কথাসাহিত্য’ কথাটির মানেই হল প্রেমকাহিনী এবং প্রেম-বিরহের উপন্যাস ও গল্প। কবিতা, নাটক, ভ্রমণকাহিনী, আত্মকথা, প্রবন্ধ, কলাম আর সাহিত্যিকদের কথাসাহিত্য নিয়ে বাংলা সাহিত্যের যে বিকৃত অঙ্গ, সেখানেও সবটুকু বর্গক্ষেত্রজুড়ে আছে নারী-পুরুষের প্রেম পর্ব। অবশ্য এ কথা অনস্বীকার্য যে, সাম্প্রতিক সময়ের সব ভাষার সাহিত্যেই এই নেতিবাচক প্রবণতা প্রবল এবং একই সঙ্গে এটি কেবল সাহিত্যের মধ্যেই যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রকাশ, উপস্থাপন, বর্ণনা ও বিবরণযোগ্য সকল মাধ্যম ও গণমাধ্যমেই পাকাপোক্তভাবে জায়গা দখল করে নিয়েছে-এ সত্যও অস্বীকার করা যাবে না। ইংলিশ, ফরাসী ও পাশ্চাত্যের অপরাপর ভাষার সাহিত্যচরিত্রের কথা না হয় বাদ থাক, নাগিব মাহফুজদের যুগে আরবী সাহিত্যেও যে অশ্লীলতার সয়লাব নেমেছে এটাও আর নতুন কোন তথ্য নয়। অপরদিকে টিভি মাধ্যমে প্রচারিত অনুষ্ঠান আর প্রিন্ট মিডিয়ার ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে পড়ছে নর-নারীর আব্রুঢাকা জীবনের খোলামেলা দাস্তান। চিত্তাকর্ষক ও সুড়সুড়িমূলক ভঙ্গিতে নিষিদ্ধ ও গুপ্ত জীবন জগতের মানচিত্র উন্মুক্তভাবে তুলে ধরা হচ্ছে দর্শক-পাঠকদের সামনে। আমাদের সাহিত্যেও তাই দেখা যাচ্ছে সেই কালচারের রমরমা পদচারণা। এর প্রধান কারণ বাছ-বিচারহীন, অনিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি। সেই সঙ্গে আছে মানবীয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পর্কে অজ্ঞতা কিংবা বক্রতা এবং আত্মার সুস্থ উপাদান সরবরাহ ও গ্রহণের ধর্যপূর্ণ আয়োজনের পরিবর্তে শরীর ও প্রবৃত্তির কাম নিবারনের সস্তা মাল-মসলা জোগান দেওয়া। এ কারণেই নর-নারীর প্রেম ও অশ্লীলতাই মুখ্য হয়ে উঠেছে সাহিত্যের উপাত্তে। কামোদ্দীপক শব্দের নিবেদন ও শৈল্পিক বর্ণনাই শুধু প্রকাশ পেয়ে চলছে জীবনের গুপ্ত পাতাগুলো। ব্যবহার ও অনুশীলনে এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাভাবিক ও নিত্য ব্যাপার। যেন সাহিত্য মানেই এই, অন্য কিছু নয়।

আজকের সাহিত্যের অসামঞ্জস্য ও নেতিবাচ্য দু’পর্যায়ের। এক. সাধারণভাবে প্রেম-রোমান্স, নর-নারীর মাঝের সম্পর্ক, মন দেওয়া-নেওয়া এবং এ বিষয়ক বিবিধ মনোজটিলতা ও নানা পর্বের কাল্পনিক বিন্যাস। দুই. এ পর্যায়টি উপর্যুক্ত পর্যায়ের চেয়ে আরেকটু অগ্রসর। এ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত থাকে নারী-পুুরুষের সম্পর্কের শরীরী ও অপ্রকাশযোগ্য দৃশ্যের ছোট বা বিস্তারিত বর্ণনা। বর্তমানে এ দু’টি ধারাই সচল এবং এর পক্ষে সাম্প্রতিক সময়ের শক্তিধর লেখক সাহিত্যিকদের যুক্তিরও কোন অভাব নেই। কেউ কেউ বলেন, নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং তাদের শরীর তো কোন মিথ্যা ও অলীক বস্তু নয়। এগুলো সাহিত্যে উঠে আসাই স্বাভাবিক। কারো কারো যুক্তি এরূপ-এধরনের সম্পর্কের বর্ণনা, পাঠক যদি পছন্দ না করত, তাহলে তো আর এসব বর্ণনা চলত না। মানুষ যা পছন্দ করে কলমের ভাষায় তা লিখে দিলে অসুবিধার তো কিছু নেই। ঢালাওভাবে মানুষের পছন্দ-অপছন্দকে এভাবে যৌক্তিকতার মাপকাঠি বানানো হলে তার চেয়ে ঠুনকো যুক্তি দুনিয়াতে আর দ্বিতীয়টি হবে না। এমন হলে পতিতাবৃত্তি, মদ্যপান, মদব্যবসা প্রভৃতি জগতের সবচেয়ে জঘন্য কাজগুলোকেও যুক্তিযুক্ত বলতে হবে। কারণ কিছু না কিছু মানুষের পছন্দ হয় বলেইতো এগুলো চলছে।

সাহিত্যে অশ্লীলতার প্রসঙ্গটিও এই অসৎ যুক্তির জোরেই টিকে যাচ্ছে। শিল্প, সাংস্কৃতি ও সুকুমার বৃত্তির নামেও বহু ক্ষেত্রে অশ্লীলতার বন্দনা গাওয়া হয়ে থাকে। এটাও একটা যুক্তি! রিপুর জোয়ারে কত স্রোতইতো আসে। সেইসব স্রোতের সবক’টির মাঝেই নির্মল আবেগের তরঙ্গ খুঁজতে যাওয়ার মত বোকামি যারা করেন, তাদের কাছে সুস্থ যুক্তির চিৎকার কোন আবেদন রাখতে সক্ষম হয় না। অথচ সাহিত্য আত্মার সুস্থ আকুতি ও সুর্নিমল ভাবব্যঞ্জনাই ভাষায় প্রস্ফুটিত হওয়ার কথা ছিল। সব অনুভূতিই তো কাব্য হতে পারে না। অনুভূতিময় কল্যাণই তো মহৎ কাব্য। শিল্পিত ও সুকৌমার্যমণ্ডিত নেতিবাচকতা এবং অশ্লীলতাও কি সাহিত্য পদবাচ্য ধারণ করার যোগ্য? হৃদয়ের আবিলতা ধুয়ে ফেলার কোন প্রেরণা, আত্মাকে জাগিয়ে তোলার কোন চেতনাই যে বর্ণনায় নেই, যেখানে কেবলই কাম- লোলুপ দৃষ্টি ও প্রবৃত্তি তাড়িত মগজকে উদ্বেলিত করার তাৎক্ষণিক নিষিদ্ধ আবেগ স্ফুটিত গদ্য বিদ্যমান, সেটাকেও কি সাহিত্য বলতে হবে? নিশ্চয়ই সাহিত্য এতটা বারোয়ারী ও পাইকারী কোন পণ্যসামগ্রী নয়। সাহিত্য যদি অনুভূতির সূক্ষ্ম ও মাধুর্যপূর্ণ মহৎ কোন বাহন হয়েই থাকে, তাহলে তার গতিপথেরও মাত্রা থাকা উচিত, থাকা উচিত তার একটি তাৎপর্যপূর্ণ গন্তব্য ও ঠিকানা। সে ঠিকানা হবে বিশ্বাস ও নৈতিকতার এবং সে ঠিকানা হবে জীবন সংসার পাড়ি দেওয়া পরকালের এক মহৎ গন্তব্যের। লক্ষ্য ও গন্তব্যহীন ভোগবাদী জীবন তো দুনিয়ার এ রঙিন ফানুস। সে জীবনের সাহিত্যও তাই। দেখতে থাকার মধ্যেই স্থায়িত্ব ও মাধুর্র্যহীন সুখ। এরপর আর কিছুই নেই। সেই ক্ষণিক চমকের ছাপ নিয়ে বাংলা সাহিত্যের কোন অমর অধ্যায় রচিত হতে পারবে না। বাংলাভাষীদের তা অত্যন্ত উদ্বেগ ও দুঃখের কারণ। আমরা এ অবস্থান পরিবর্তন চাই। বিশেষত যে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই হয়েছে, জীবনদানের ঘটনা ঘটেছে, সেই ভাষার ক্ষেত্রে এ ধরনের লক্ষ্যভ্রষ্টতা অব্যাহত থাকা কোনক্রমেই সহনীয় হতে পারে না। তাই আজকের মহান শব্দের কারিগরদের প্রতি আমাদের আবেদন- আমাদেরকে এবং সাহিত্যকে একটি সুন্দর গন্তব্যের পথ দেখান। এ দায়িত্ব আপনাদেরই।

Leave a Reply


This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.