New Muslims APP

মেরাজ কি? মানবতার কল্যাণে মেরাজের উপহার

242
ইসলামী সংস্কৃতির ঐতিহ্যের ধারায় চন্দ্রবর্ষের ২৭ রজব পবিত্র মেরাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালিত হয়। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সা. ৪০ বছর বয়সে নবুয়াত লাভ করেছিলেন। জন্মভূমি মক্কায় ১৩ বছর কঠিন পরিস্থিতিতে ইসলাম প্রচারের পর তিনি মদীনায় হিজরত করেন এবং ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত ১০ বছর মদীনায় একটি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। মদীনা হিজরতের বছর খানেক আগে সংঘটিত হয়েছিল পবিত্র মে‘রাজ।
মে‘রাজ-এর শাব্দিক অর্থ সিঁড়ি, সোপান, ঊর্ধ্বগমন। তবে পরিভাষায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাত আসমান পাড়ি দিয়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়াকে মে‘রাজ বলা হয়। আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন মজীদে মেরাজের ঘটনার একাধিক বর্ণনা রয়েছে। সূরা বনি ইসরাঈলের ১ নং আয়াতে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন: ‘তিনিই পবিত্র সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের কিছু অংশে মসজিদুল হারাম (কা‘বাঘর বেষ্ঠিত মসজিদ) হতে (বায়তুল মুকাদ্দাস বা বর্তমানে দখলদার ইসরাঈল অধিকৃত জেরুজালেমে অবস্থিত) মসজিদুল আকসায় পরিভ্রমণ করান, যাতে তাকে তাঁর নিদর্শনসমূহ প্রত্যক্ষ করান ’ তা ছাড়া সূরা নাজম এ নবীজি সা. সাত আসমানের ঊর্ধ্বে অবস্থিত ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’য় গমনের স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। তবে মে‘রাজ শব্দটি হাদীস শরীফের পরিভাষা। কুরআন মজীদে এ সম্পর্কিত পরিভাষাটি হচ্ছে ‘ইসরা’।
কুরআন মাজীদের বর্ণনাভঙ্গিতে এ কথা পরিষ্কার যে, এ সফরের সম্পূর্ণ পরিকল্পনা আল্লাহ তাআলার এবং তিনিই প্রিয় হাবীবকে আপন সান্নিধ্যে নিয়ে যাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করেন। হাদীস শরীফের বর্ণনাগুলোও এত বিশদ ও অকাট্য যে, তাতে মেরাজের সম্ভাব্যতা ও সত্যতার ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহ করলে কেউ মুসলমান থাকবে না। আল্লাহর নবীকে আরশ, কলম, লৌহ, বেহেশত, দোযখ পরিদর্শন করানোর উদ্দেশ্য কী ছিল সে সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন: সৃষ্টিজগতে আল্লাহর নিদর্শনসমূহ পরিদর্শন করানোই ছিল এ সফরের উদ্দেশ্য। ’ [সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত ১৭: ১]
রাসূল সা. যে নবুওয়াতী মিশন নিয়ে দুনিয়াতে এসেছিলেন তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ডেকে নিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য, যে অদৃশ্যজগত সম্পর্কে মানুষকে তিনি বলছেন ও সেদিকে ডাকছেন তার বাস্তব ও প্রত্যক্ষ জ্ঞান দান করা, আর মদীনায় ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামোগত রূপরেখা প্রদান ছিল এ সফরের অন্যতম লক্ষ্য। মে‘রাজের আলোচনা সম্পর্কিত সূরা বনি ইসরাঈলে বর্ণিত ইসলামী সমাজের ১৪ দফা মূলনীতি থেকে এর সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবাঘর বেষ্ঠিত মসজিদুল হারাম এলাকার হযরত উম্মে হানীর ঘর থেকে বেহেশতি বাহন বিদ্যুতগতির ‘বোরাক’ নিয়ে মসজিদুল আকসা গমন করেন। সেখান থেকে একে একে সাত আসমান পাড়ি দিয়ে ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’য় উপনীত হন। এ পর্যন্ত হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সফরসঙ্গী ছিলেন নবী-রাসূলগণের কাছে ওহী বাহক ফেরেশতা জিবরাঈল আ.। ইহজগতের প্রান্তসীমা ও ঊর্ধ্বজগতের সূচনা পয়েন্ট ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’য় পৌঁছে জিবরাঈল আ. বিদায় নেন। এরপর ঊর্ধ্বজগতের বিশেষ বাহন রফরফ যোগে তিনি আল্লাহর আরশে গমন করেন। আমাদের জন্য বিশেষভাবে জানার বিষয় হল, এতদূর থেকে গিয়ে গোটা সৃষ্টিজগতের তরফ থেকে তিনি মহান আল্লাহর দরবারে কী নিবেদন করেন? আর আল্লাহর পক্ষ হতে মুসলিম উম্মাহ তথা বিশ্ববাসীর জন্য কি উপহার তাকে দেয়া হয়? আল্লাহর দরবারে উপনীত হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রদ্ধা, দাসত্ব, আনুগত্য ও পবিত্রতার গুণগান নিবেদন করেন। আর আল্লাহর পক্ষ হতে সালাম, শান্তি ও রহমতের উপহার প্রদান করা হয়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের ও সকল সৎকর্মশীল মানুষের পক্ষে আল্লাহর দেয়া রহমত ও সালামের উপঢৌকন বরণ করে নেন। আল্লাহ পাক ও রাসূলের মাঝে এই সংলাপের মধুরতায় বিমুগ্ধ হয়ে আরশ বহনকারী ফেরেশতারা সমস্বরে বলে উঠেন ‘আশহাদু …। অর্থাৎ আল্লাহর একত্ব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের সাক্ষ্য। সম্পূর্ণ বচনমালাটি ‘আত্তাহিয়্যাতু’তে সাজানো আছে, যা আমরা প্রত্যেক নামাযে দুই রাকাত অন্তর অন্তর বৈঠকে পড়ি।
হাদীস শরীফের বর্ণনায় আরো জানা যায়, আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে মে‘রাজে চারটি উপহার প্রদান করা হয় দুনিয়াবাসীর জন্য। (১) পাঁচ ওয়াক্ত নামায। (২) সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত (অর্থাৎ এর ভাব-ঐশ্বর্য)। (৩) আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করে না এমন সব লোককে আল্লাহর পক্ষ হতে মার্জনার সম্ভাবনা এবং (৪) এই ঘোষণা যে, যে ব্যক্তি কোন ভাল কাজ করার চিন্তা করবে তার জন্য তাকে একটি সওয়াব দেয়া হবে। কাজটি বাস্তবে কার্যকরি করলে এর দশগুণ সওয়াব দেয়া হবে আর যদি কেউ কোন মন্দ কাজ করার চিন্তা করে তার জন্য কোন পাপ লেখা হবে না, (তাতে লিপ্ত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। আর যদি সে মন্দ কাজটি করে বসে তার জন্য মাত্র একটি গোনাহ (পাপ) লেখা হবে।
নবুয়াত লাভের পরপর নামায ফরয হয়েছিল এবং নামাযই ইসলামের প্রধান বুনিয়াদ ও স্তম্ভ। মেরাজ রজনীতে যা ফরয হয়েছিল তা ছিল দৈনিক পাঁচ বেলা নামায। আল্লাহর সান্নিধ্য হতে বিদায়কালে নামায কীভাবে পঞ্চাশ ওয়াক্ত হতে পাঁচ ওয়াক্তে হ্রাস করা হল হাদীস শরীফে এ সম্পর্কিত বর্ণনাটি বেশ মনোজ্ঞ ও বিস্তারিত। আল্লাহর সাথে যারা শিরক করেনা তাদের সম্পর্কে যে ঘোষণাটি দেয়া হয়েছে এবং তার যে বিশাল শিক্ষা আমাদেরকে সমাজ জীবনে শান্তি-সুখের পথ দেখাতে পারে তা হল, আল্লাহর সাথে শিরক বাদে অন্যান্য গোনাহখাতায় জড়িত লোকদের সৎপথে ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে। কাজেই কারো মধ্যে আমার বা আমাদের মতের ব্যতিক্রম কিছু দেখলে তাকে যেন ইসলাম থেকে খারিজ বলে মনে না করি। এমন ধারনা যাতে পোষণ না করি যে, তার দোষখাতা সংশোধনের বাইরে চলে গেছে। কারণ, আল্লাহ তাআলার ঘোষণা হল তিনি শিরক ছাড়া অন্য সব গোনাহ তাওবা করলে মাফ করে দিতে পারেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা ও বিশ্বাস হল, যে কোন খারাপ লোক মৃত্যুর আগেও ভাল হয়ে যেতে পারে; কিংবা দৃশ্যত ভাল লোক মৃত্যুর আগে মন্দ হয়ে কাফের মুরতাদও হয়ে যেতে পারে। কাজেই ভাল লোকদের অতিবেশি গর্বিত হওয়া বা মন্দ লোকদের আল্লাহর পথে ফিরে আসার আশা ত্যাগ করা ইসলাম সম্মত নয়। এই ধারনা, মূল্যবোধ ও বিশ্বাস যদি আমরা সমাজে লালন করি তাহলে সমাজ ও জাতি অবশ্যই উপকৃত হবে।
মুসলমানরা দৈনিক খাবার গ্রহণ করে তিন বেলা। আর নামায আদায় করে পাঁচ বেলা। এটা প্রমাণ করে যে, ইসলামের দৃষ্টিতে দেহের চেয়ে আত্মার পরিচর্যা ও উন্নতির গুরুত্ব অনেক বেশি। মানুষ নামাযে যখন দাঁড়ায় তখন সরাসরি আল্লাহর সামনে দাঁড়ায়। যাকিছু পড়ে মূলত আল্লাহর সাথে কথা বলে। আল্লাহকে বারবার স্মরণ করার সূত্রে আরশের মালিকের সাথে যমীনের বান্দার সংযোগ স্থাপিত হয়। কম্পিউটারে মাউসে ক্লিক করলে কার্সরের যে তৎপরতা দেখা যায়, তা টোকাটুকির মতো দেখালেও আসলে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা ‘স্মরণ’-এর সাথে তুলনীয়। মেমোরিতে সিগন্যালকে সাধারণ ভাষায় ‘স্মরণ’ ছাড়া আর কী বলা যায়? ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতিতে রিমোট-এর ব্যবহারের ধরনও তাই। নামাযের মত অন্যান্য ইবাদতেও আল্লাহকে ‘স্মরণ’ করার বিষয়টিই মূখ্য। কুরআন মজীদে বলা হয়েছে ‘আমাকে স্মরণ করার জন্য তোমরা নামায কায়েম কর। ’ এ জন্যে নামাযের অপর নাম মু‘মিনের মে‘রাজ।
প্রার্থনার মাধ্যমে বিশাল সৃষ্টিলোক বা ¯্রষ্টার সাথে ধ্যানগতভাবে একাত্ম ও একাকার হওয়ার গুরুত্ব আধুনিক মনোবিজ্ঞানে প্রমাণিত। এর মাধ্যমে মুসলমানরা সরাসরি আল্লাহর রহমত ও প্রশান্তি লাভ করে। যারা দৈনিক পাঁচবার ওজুতে দেহের মূল পাঁচটি অঙ্গে ওয়াটার থেরাপি দেয় এবং মহান ¯্রষ্টার স্মরণে সমর্পিত হৃদয়ে মানসিক প্রশান্তিÍ লাভ করে, তারা টেনশনজাত ব্লাডপ্রেসার ও অন্যান্য রোগ থেকে অনেকটা নিরাপদ থাকে। এ হলো মেরাজের অন্যতম বড় উপঢৌকন।
সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াতে দুটি বিষয় মূখ্য। এক, সকল নবী-রাসূলগণের প্রতি মুসলমানদের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ। দুই, মোনাজাত- প্রার্থনায় আল্লাহতে সমর্পিত হওয়ার প্রেসক্রাইভড ফর্ম। পৃথিবীতে মুসলমানরা সকল মহাপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে। সেই সূত্রে বিশ্বের সকল নবী-রাসূল আ., তাঁদের আনিত ধর্ম, শিক্ষা ও সৎকর্মশীলদের সাথে একাত্মতার ফল্গুধারা মুসলিম সমাজকে সুবাসিত করে রেখেছে। যে কারণে অন্যান্য নবীদের নামে মুসলিম সন্তানদের নাম রাখা হয়। যা অন্য কোন সমাজ বা সংস্কৃতিতে সাধারণত দেখা যায় না। ইহূদি ও খ্রিস্টান সমাজ থেকে মাঝেমধ্যে মহানবী সা.-এর অবমাননায় যেসব অপকর্ম প্রকাশ পায়, তাদের বা বনি ইসরাঈলের নবী-রাসূল আ.-গণের প্রতি সেরূপ কোন আচরণ মুসলিম উম্মাহর দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে কল্পনাও করা যায় নি।
মেরাজের অরেকটি উপহার, চিন্তা ও কর্মোদ্যোগ সম্পর্কিত। কোন ভালো চিন্তা করলেই সওয়াব, আর মন্দ চিন্তা করলেও কাজটি না করা পর্যন্ত গোনাহ লেখা হয় নাআল্লাহর পক্ষ হতে এমন ঘোষণার তাৎপর্য ও আবেদন অপরিসীম। মানব দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের কোষ দ্বারা। আর মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ থাকে চিন্তার মুঠোয়। কাজেই মানুষের চিন্তা যদি ভাল হয়, তার আচরণ ভাল হবে। এভাবে সব মানুষের চিন্তা ভাল হলে সমাজটাই ভাল ও উন্নত হবে। বস্তুত ভাল চিন্তার উৎকর্ষে মেরাজের এই উপঢৌকনটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও পর্যালোচনা হলে মানব সভ্যতা অনেক উন্নত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
কোন এক পত্রিকায় মহাথির মুহাম্মদের নেতৃত্বে আধুনিক মালয়শিয়ার অভাবনীয় উন্নতির পেছনে উপাদানগুলো সম্পর্কে একটি লেখায় পড়েছিলাম : মহাথির জাতির কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন, প্রত্যেকে যেন নিজ নিজ ভাল ভাল চিন্তাগুলো রোজ ডাইরিতে লিখে রাখে। পরে এই লেখাগুলোই দেশে ভাল চিন্তার বিপ্লব আনে আর তা জাতির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সুফল বয়ে আনে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সূফি কবি ও দার্শনিক মাওলানা রূমী রহ. বলেছেন: প্রত্যেকের নিজস্ব চিন্তাটাই হল আসল মানুষ। (অর্থাৎ প্রত্যেকে যা চিন্তা করে সেটিই মানুষ হিসেবে তার আসল পরিচয়।) তোমার চিন্তা যদি হয় ফুলের মতো তাহলে তুমি ফুলের মত মানুষ। আর যদি তোমার চিন্তা হয় কাঁটার মতো তাহলে তুমি হাম্মামখানার জ্বালানি-লাকড়ি বটে।
আমরা আশা করব, পবিত্র মে‘রাজে নিয়ে, নবীজিকে দেয়া আল্লাহ তাআলার উপহারের মধ্যে সৎ ভাল ও সওয়াবের ঘোষণা নিয়ে প্রত্যেকে চিন্তা করব। বিশেষ করে এই শিক্ষা যেন নতুন প্রজন্মকে দেশ ও জাতি গঠনে ভাল ভাল চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে সেই কামনা করছি। সমাপ্ত

 

Leave a Reply


This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.