New Muslims APP

বাংলা ভাষার জন্ম

বাংলা ভাষার জন্ম

বাংলা ভাষার জন্ম

আমাদের বাংলা ভাষার জন্ম কখন এবং কোন পদ্ধতিতে হয়েছে, এ সম্পর্কে ভাষা গবেষক ও পণ্ডিতদের বিভিন্ন মতপার্থক্য রয়েছে। শতাধিক বছর পূর্বেও এ সম্পর্কে কারো কোন সুস্পষ্ট ধারণা ছিলো না।
বর্তমান যুগের পণ্ডিতদের মতে আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে এদেশে বাংলা ভাষার জন্ম হয়। বাংলা ভাষা মূলত আর্য ভাষার বিবর্তিত রূপ। এই বিবর্তনের ইতিহাস যেমন দীর্ঘ তেমনি বৈচিত্র্যময়।
হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর জন্মের দেড় হাজার বছর পূর্বে মধ্য ইউরোপ থেকে কিছু লোক পূর্ব দিকে আসেন। পথে একদল রয়ে গেলেন ইরানে, আর অন্যদল চলে গেলেন ভারতবর্ষে। তাদেরকেই বলা হয় আর্য এবং তাদের ভাষার নাম হচ্ছে ‘আর্যভাষা’।
হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর জন্মের পূর্ব থেকেই ভারতীয় আর্যভাষার তিনটি স্তরের সন্ধান পাওয়া যায়।
প্রথম স্তর: বৈদিক, এ ভাষার কাল হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দ পর্যন্ত। আর ‘বেদ’ হচ্ছে এ ভাষার প্রচীনতম নিদর্শন। বেদের ভাষা ছিল আর্যদের প্রচীনতম সাহিত্যিক ভাষা। সেকালে তাদের একটা কথ্য ভাষাও ছিল। সাহিত্যিক বৈদিক ভাষা, কথ্য ভাষার চাইতে মার্জিত ও শালীন ছিল।

 দ্বিতীয় স্তর: সংস্কৃত, এ ভাষার কাল হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দ পর্যন্ত, সেকালে তাদের কথ্য ভাষার সাথে ‘বেদের’ ভাষার সংমিশ্রণের ফলে বৈদিক ভাষার কিছুটা অশুদ্ধ ও বিকৃতরূপ প্রকাশ পায়। যার কারণে এ বৈদিক ভাষার সংস্কার করা হয়। তৈরি হয় ‘সংস্কৃত ভাষা’।
অনেকেই ধারণা করেন যে, এ সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। কিন্তু আধুনিক যুগের পণ্ডিতদের মতে এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ তদানিন্তনকালে সাধারণ মানুষ সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতো না। সংস্কৃত ভাষা হচ্ছে ভারতবর্ষের একটি পবিত্র ভাষা। তা ছিল হিন্দু সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষের লেখার ভাষা, কথ্য ভাষা ছিল না। সাধারণ মানুষের নানা রকম প্রাকৃত ভাষায় বলতো।

 তৃতীয় স্তর: অপভ্রংশ, এ ভাষার কাল হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এ ভাষাগুলো কথ্য ও লিখিতরূপে ভারতে বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত ছিল। মানুষের ব্যবহৃত প্রাকৃত ভাষাগুলো শেষ স্তরের নামই হচ্ছে ‘অপভ্রংশ’।
ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী দীন মুহাম্মাদ এবং অন্যান্য ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে এই অপভ্রংশ ভাষার পূর্বরূপ বা গৌড়ীয় অপভ্রংশ থেকেই প্রচীন বাংলা ভাষার জন্ম।
ড. মুহাম্মাদ এনামুল হক অবশ্য একটু ভিন্ন  মত পোষণ করেছেন, তিনি বলেন: খ্রীস্টীয় নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বাংলা ভাষা স্থায়ীরূপ লাভ করেছিল। এ চারশ’ বছরই বাংলা ভাষার সৃজ্যমান কাল।
এ সময়কার একেবারে গোড়ার দিকে বঙ্গদেশে ‘সংস্কৃত’ ছাড়া আরো দু’টি ভাষা প্রচালিত ছিল। তার একটি হচ্ছে, ‘সৌরসেনীপ্রাকৃত’ বা সৌরসেনী-অপভ্রংশ আর অপরটি হচ্ছে ‘মাগধী-অপভ্রংশ’। এ মাগধী অপভ্রংশের বিবর্তিত রূপ ‘বাংলা ভাষা’।
ড. সুনীত কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন: অপভ্রংশের একটার নাম হচ্ছে ‘মাগধী অপভ্রংশ’, এর আবার তিনটি শাখা রয়েছে, যথা ‘পূর্ব মাগধী অপভ্রংশ ‘মধ্য মাগধী অপভ্রংশ’ এবং ‘পশ্চিম অপভ্রংশ’। পূর্ব মাগধী অপভ্রংশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে ‘বাংলা ভাষা’।
এমনিভাবে জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন বলেন: বহু প্রাকৃতের একটি নাম ‘মাগধী প্রাকৃত’। ঐ মাগধী প্রাকৃতের কোন পূর্বাঞ্চলীয় রূপ থেকে জন্ম হয় ‘বাংলা ভাষা’।
ভাষা চলে নদীর স্রোতের মতো। এভাবেই কতো চড়াই-উতরাই ভেঙে ভাষা নদ-নদী পেরিয়ে এসেছে কত দীর্ঘ পথ। এইভাবে প্রাচীন ভারতীয় আর্য থেকে জন্ম মধ্য-ভারতীয় আর্য ভাষার। এবং তা থেকে জন্ম নবীন ভারতীয় আর্য ভাষার। বলা দরকার, এসব নাম কিন্তু হাল-আমলের পণ্ডিতদের দেওয়া নাম। এখন মধ্যযুগের যে ভাষা তা হচ্ছে পালি আর প্রাকৃত। বুদ্ধ-অশোকের আমলে পালির খুব প্রসার হয়েছিলো। পরের যুগ প্রাকৃত, এই সময় নাগাদ তা থেকে আমাদের বাংলা ভাষার জন্ম। তবে পণ্ডিতরা বলেন, প্রাকৃত থেকে সরাসরি বাংলাভাষার জন্ম হয়নি। পূর্বের প্রাকৃত ভেঙে অপভ্রংশ, তা  থেকে বাংলা। এই বাংলা তো মাত্র হাজার বছরের পুরোনো। তাই এ ভাষা হচ্ছে নবীন ভারতীয় আর্য ভাষা। বাংলার সাথে  তেমনি আরো রয়েছে- হিন্দি, উর্দু, আসামি, উড়িয়া, বিহারী ইত্যাদি উপমহাদেশের আধুনিক ভাষাগুলি।
এই নতুন যুগেই বাংলা ভাষার সাহিত্যকে দুনিয়ার দরবারে পৌঁছে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলা ভাষার আশ্চর্য ক্ষমতা আবিস্কার করলেন নজরুল ইসলাম। তিনি লিখেছেন বিদ্রোহের আগুন ছড়ানো গান।
আর আজ যে আমরা স্বাধীন হয়েছি তা তো বাংলা ভাষার জন্যই, আমাদের গর্ব মায়ের ভাষা বাংলাকে নিয়েই।

Leave a Reply


This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.