সংকলন : সুলাইমান বিন সালেহ আল খারাশী
অনুবাদ : আলী হাসান তৈয়ব
জান্নাতে নারীদের অবস্থা কী হবে, জান্নাতে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে
– এ ব্যাপারে প্রায়শই আমাকে নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। তাই ভাবলাম সঠিক প্রমাণ ও আলেমদের অভিমতের আলোকে এমন কয়েকটি পয়েন্ট একত্রিত করে দেই যা থেকে তারা এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণায় উপনীত হতে পারবেন। চলুন আল্লাহর ওপর ভরসা করে শুরু করা যাক :
ফায়দা : ১
আমাদের উচিত হবে নারীরা জান্নাতে তাদের জন্য অপেক্ষমান নেকী ও নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তাদেরকে হতোদ্যম না করা। কারণ, মানব প্রকৃতি তার আগামী ও ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে পছন্দ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সাহাবা রাদিআল্লাহু আনহুমের জান্নাত ও জান্নাতের নেয়ামত সংক্রান্ত এ ধরনের প্রশ্ন শুনে অপছন্দ করেন নি। যেমন তাঁরা জিজ্ঞেস করেছেন। যেমন আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! জান্নাত সম্পর্কে আমাদের ধারণা দিন। কী দিয়ে জান্নাত নির্মিত হয়েছে? তিনি বললেন, ‘তার দেয়ালের একটি করে ইট সোনা দিয়ে এবং আরেকটি ইট রুপা দিয়ে নির্মিত। তার সিমেন্ট হলো উন্নত মৃগনাভী, তার প্লাস্টার ইয়াকূত ও মোতি এবং তার মাটি ওয়ারছ (নামের সুগন্ধি) ও জাফরান। যারা এতে প্রবেশ করবে তারা অমর হবে; কখনো মারা যাবে না। সুখী হবে; অসুখী হবে না। তাদের যৌবন শীর্ণ হবে না। আর তাদের কাপড় ছিন্নভিন্ন করা হবে না।’ [মুসনাদ আহমদ: ৯৭৪৪; মুসনাদ দারেমী : ২৮৬৩]
আরেকবার তাঁরা জিজ্ঞেস করেন, যেমনটি বর্ণিত হয়েছে আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করা হলো, জান্নাতে আমরা কি আমাদের স্ত্রীদের কাছে পৌঁছতে পারব? তিনি বললেন, ‘কোনো কোনো ব্যক্তি (জান্নাতে) দিনে একশত জন কুমারীর কাছে পৌঁছবে।’ [তাবরানী, আল-মু‘জামুল কাবীর : ১৩০৫]
ফায়দা : ২
মানব মন বলতেই- চাই তা নর বা নারী হোক- জান্নাত ও জান্নাতের মনোরম নেয়ামতসমূহের আলোচনা শুনতেই তা আগ্রহী ও প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। নেক আমল বাদ দিয়ে কেবল স্বপ্ন বিলাস না হলে তা উত্তম বৈ কি। কারণ আল্লাহ তা‘আলা মু‘মিনদের উদ্দেশে বলেন, ‘আর এটিই জান্নাত, নিজেদের আমলের ফলস্বরূপ তোমাদেরকে এর অধিকারী করা হয়েছে।’ [সূরা আয্-যুখরুফ, আয়াত : ৭২]
তাই দেখা যায় সাহাবায়ে কিরাম রাদিআল্লাহু আনহুম জান্নাতের বিবরণ শুনে নিজেদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর আমলের মাধ্যমে সেগুলোকে কার্যে পরিণত করেছেন।
ফায়দা : ৩
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে, যার পরিধি আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৩}
এ আয়াত থেকে অনুধাবিত হয় যে জান্নাতকে প্রস্তুত করা হয়েছে মুক্তাকীদের জন্য। জান্নাত ও জান্নাতের নেয়ামতসমূহ নারী বাদে কেবল পুরুষদের জন্য নয়। বরং তা উভয় শ্রেণীর মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এ বিষয়টিকে দ্ব্যর্থহীন করে আল্লাহ সুবহানুহু ওয়া তা‘আলা বলেন, ‘আর পুরুষ কিংবা নারীর মধ্য থেকে যে নেককাজ করবে এমতাবস্থায় যে, সে মুমিন, তাহলে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি খেজুরবীচির আবরণ পরিমাণ যুলমও করা হবে না।’ {সূরা আন-নিসা : ১২৪}
ফায়দা : ৪
নারীদের কর্তব্য হবে জান্নাতে প্রবেশের বিস্তারিত তথ্যানুসন্ধান আর এ সংক্রান্ত অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নের তুবড়ি না ছুটানো। যেমন : জান্নাতে তাদের কী করা হবে, তারা কোথায় থাকবে ইত্যাকার প্রশ্ন। ভাবখানা এমন যে সে যেন কোনো জীবননাশা মরুতে পা রাখতে যাচ্ছে তার জন্য এ কথা জানাই যথেষ্ট হওয়া উচিত যে শুধু জান্নাতে প্রবেশের বদৌলতেই তার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাবৎ দুঃখ ও গ্লানী দূর হয়ে যাবে। সেসব রূপান্তরিত হবে অপার্থিব সৌভাগ্য এবং অনন্ত শান্তিতে। জান্নাত সম্পর্কে আল্লাহর এ বিবরণই তার জন্য যথেষ্ট হতে পারে, যেখানে তিনি ইরশাদ করেন : ‘সেখানে তাদেরকে ক্লান্তি স্পর্শ করবে না এবং তারা সেখান থেকে বহিষ্কৃতও হবে না।’ {সূরা আল-হিজর: ৪৮}
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘স্বর্ণখচিত থালা ও পানপাত্র নিয়ে তাদেরকে প্রদক্ষিণ করা হবে, সেখানে মন যা চায় আর যাতে চোখ তৃপ্ত হয় তা-ই থাকবে এবং সেখানে তোমরা হবে স্থায়ী।’ {সূরা আয্-যুখরুফ: ৭১}
এসবের আগে তার জন্য যথেষ্ট হতে পারে জান্নাতের অধিবাসীদের সম্পর্কে আল্লাহর এই বাণী, যেখানে তিনি বলেন: ‘আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। এটা মহাসাফল্য।’ {সূরা আল-মায়িদা: ১১৯}
ফায়দা : ৫
বাকি থাকে কেবল এই প্রশ্ন, আল্লাহ তো পুরুষদেরকে ডাগর চোখ বিশিষ্ট হূর ও অপরূপা নারীদের কথা বলে জান্নাতের প্রতি আগ্রহী ও অনুপ্রাণিত করেছেন। অথচ নারীদের প্রলুব্ধকর এমন কিছু বলেন নি। নারীরা সাধারণ এরই কারণ জানতে চান। এর জবাবে আমি বলি :
১- প্রথমত আল্লাহর এই বাণীটি আমাদের মাথায় রাখতে হবে : ‘তিনি যা করেন সে ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা যাবে না; বরং তাদেরকেই প্রশ্ন করা হবে।’ {সূরা আল-আম্বিয়া: ২৩}
তবে শরী‘আতের সুনির্দিষ্ট উদ্ধৃতি এবং ইসলামের মূলনীতির আলোকে এর হিকমত ও তাৎপর্য অনুধাবনের মানসিকতায় কোনো দোষ নেই।
২- এটা সুবিদিত যে নারী প্রকৃতি বলতেই লজ্জার ভূষণে শোভিত। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সে নেয়ামতের বর্ণনা দিয়ে জান্নাতের প্রতি লালায়িত করেন নি যা তাদেরকে লজ্জায় আশক্ত করে।
৩- এটাও সুবিদিত যে নরের প্রতি নারীর আকর্ষণ ঠিক তেমন নয় যেমন নারীর প্রতি নরের আকর্ষণ। তাই দেখা যায় আল্লাহ জান্নাতে নারীর কথা বলে পুরুষদের আগ্রহী করেছেন যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নোক্ত বাণীকেও সপ্রমাণ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘আমার পরে আমি পুরুষের জন্য নারীর চেয়ে ক্ষতিকর আর কিছু রেখে যাই নি।’ [বুখারী : ৫০৯৬; মুসলিম : ৭১২২]
পক্ষান্তরে পুরুষের প্রতি আকর্ষণের চেয়েও নারীদের আকর্ষণ বেশি অলংকার ও পোশাকের সৌন্দর্যের প্রতি। কারণ এটি তাদের সহজাত প্রকৃতি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর যে অলংকারে লালিত পালিত হয়।’ {সূরা আয্-যুখরুফ, আয়াত : ১৮}
৪- শায়খ উসাইমীন রহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা স্ত্রীদের কথা উল্লেখ করেছেন স্বামীদের জন্য। কারণ, স্বামীই হলেন স্ত্রীর কামনাকারী এবং তার প্রতি মোহিত। এ জন্যই জান্নাতে পুরুষদের জন্য স্ত্রীদের কথা বলা হয়েছে আর নারীদের জন্য স্বামীদের ব্যাপারে নিরবতা অবলম্বন করা হয়েছে। কিন্তু এর দাবী কিন্তু এই নয় যে তাদের স্বামী থাকবে না। বরং তাদের জন্যও আদম সন্তানদের মধ্য থেকে স্বামী থাকবে।
ফায়দা : ৬
দুনিয়ায় নারীদের অবস্থা নিম্নোক্ত প্রকারগুলোর বাইরে নয় :
১- হয়তো সে বিয়ের আগেই মারা যাবে।
২- কিংবা সে মারা যাবে তালাকের পর অন্য কারো সাথে বিয়ের আগে।
৩- কিংবা সে বিবাহিতা কিন্তু আল্লাহ রক্ষা করুন- তার স্বামী তার সঙ্গে জান্নাতে যাবে না।
৪- কিংবা সে তার বিয়ের পরে মারা যাবে।
৫- কিংবা তার স্বামী মারা গেল আর সে আমৃত্যু বিয়ে ছাড়াই রইল।
৬- কিংবা তার স্বামী মারা গেল। তারপর সে অন্য কাউকে বিয়ে করল।
দুনিয়াতে নারীদের এ কয়টি ধরনই হতে পারে। আর এসবের প্রত্যেকটির জন্যই জান্নাতে স্বতন্ত্র অবস্থা রয়েছে :
১- যে নারী বিয়ের আগে মারা গেছেন আল্লাহ তাকে জান্নাতে দুনিয়ার কোনো পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেবেন। কারণ আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘কিয়ামতের দিন যে দলটি সর্বপ্রথম জন্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের চেহারা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্জ¦ল; আর তৎপরবর্তী দলের চেহারা হবে আসমানে মুক্তার ন্যায় ঝলমলে নক্ষত্র সদৃশ উজ্জ¦ল। তাদের প্রত্যেকের থাকবে দু’জন করে স্ত্রী, যাদের গোশতের ওপর দিয়েই তাদের পায়ের গোছার ভেতরস্থ মজ্জা দেখা যাবে। আর জান্নাতে কোনো অবিবাহিত থাকবে না।’ [মুসলিম :৭৩২৫]
শায়খ উসাইমীন বলেন, যদি ইহকালে মহিলার বিয়ে না হয়ে থাকে তবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে এমন একজনের সঙ্গে বিয়ে দেবেন যা দেখে তার চোখ জুড়িয়ে যাবে। কারণ, জান্নাতের নেয়ামত ও সুখসম্ভার শুধু পুরুষদের জন্য নয়। বরং তা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য বরাদ্দ। আর জান্নাতের নিয়ামতসমূহের একটি এই বিয়ে।
২- তালাক প্রাপ্ত হয়ে আর বিয়ে না করে মারা যাওয়া মহিলার অবস্থাও হবে অনুরূপ।
৩- একই অবস্থা ওই নারীর, যার স্বামী জান্নাতে প্রবেশ করেন নি। শায়খ উসাইমীন বলেন, ‘মহিলা যদি জান্নাতবাসী হন আর তিনি বিয়ে না করেন কিংবা তাঁর স্বামী জান্নাতী না হন, সে ক্ষেত্রে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করলে সেখানে অনেক পুরুষ দেখতে পাবেন যারা বিয়ে করেন নি।’ অর্থাৎ তাদের কেউ তাকে বিয়ে করবেন।
৪- আর যে নারী বিয়ের পর মারা গেছেন জান্নাতে তিনি সেই স্বামীরই হবেন যার কাছ থেকে ইহলোক ত্যাগ করেছেন।
৫- যে নারীর স্বামী মারা যাবে আর তিনি পরবর্তীতে আমৃত্যু বিয়ে না করবেন, জান্নাতে তিনি এ স্বামীর সঙ্গেই থাকবেন।
৬- যে মহিলার স্বামী মারা যায় আর তিনি তার পরে অন্য কাউকে বিয়ে করেন, তাহলে তিনি যত বিয়েই করুন না কেন জান্নাতে সর্বশেষ স্বামীর সঙ্গী হবেন। কারণ, আবূ দারদা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মহিলা তার সর্বশেষ স্বামীর জন্যই থাকবে।’ [জামে‘ ছাগীর : ৬৬৯১; আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীস আস-সাহীহা : ৩/২৭৫]
হুযায়ফা রাদিআল্লাহু আনহু তাঁর স্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘যদি তোমাকে এ বিষয় খুশী করে যে তুমি জান্নাতে আমার স্ত্রী হিসেবে থাকবে তবে আমার পর আর বিয়ে করো না। কেননা জান্নাতে নারী তার সর্বশেষ দুনিয়ার স্বামীর সঙ্গে থাকবেন। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীদের জন্য অন্য কারো সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে জড়ানো হারাম করা হয়েছে। কেননা তাঁরা জান্নাতে তাঁরই স্ত্রী হিসেবে থাকবেন।’ [বাইহাকী, আস-সুনান আল-কুবরা : ১৩৮০৩]
মাস’আলা : কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেন, জানাযার দু‘আয় এসেছে আমরা যেমনটি বলে থাকি, ‘আর তার স্বামীর পরিবর্তে তাকে আরও উত্তম স্বামী দান করুন’। এর আলোকে তিনি যদি বিবাহিতা হন তাহলে আমরা কিভাবে তার জন্য এ দু‘আ করি? কারণ আমরা জানি, দুনিয়াতে তার স্বামী যিনি হবেন জান্নাতে তিনিই তার স্বামী থাকবেন? আর যদি তার বিয়ে না হয় তবে তার স্বামী কোথায়?
শায়খ ইবন উসাইমীনের ভাষায় এর জবাব : যদি মহিলা বিবাহিতা না হন তবে দু‘আর উদ্দেশ্য হবে ‘তার জন্য বরাদ্দ পুরুষ’। আর যদি বিবাহিতা হন তবে তার জন্য আরও উত্তম স্বামীর উদ্দেশ্য হবে ‘দুনিয়ার স্বামীর চেয়ে গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যে উত্তম স্বামী’। কারণ, বদল দুই ধরনের। এক হলো সত্তার বদল। যেমন কেউ ছাগলের বিনিময়ে উট কিনল। দুই হলো গুণের বদল। যেমন আপনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যক্তির কুফরকে ঈমানে বদলে দিয়েছেন। এখানে কিন্তু ব্যক্তি একইজন। পরিবর্তন কেবল তার বৈশিষ্ট্যে।
ফায়দা : ৭
আব্দুল্লাহ ইবন ওমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার ঈদের সালাতে খুতবায় নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হে নারী সম্প্রদায়, তোমরা বেশি বেশি সদকা করো। কেননা, আমি জাহান্নামের অধিবাসী বেশি তোমাদের দেখেছি।’ মহিলারা বললেন, কেন হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, ‘তোমরা অধিকহারে অভিশাপ দাও এবং স্বামীর অকৃজ্ঞতা দেখাও। বুদ্ধিমান পুরুষকে নির্বুদ্ধি বানাতে অল্প বুদ্ধি ও খাটো দীনদারির আর কাউকে তোমাদের চেয়ে অধিক পটু দেখিনি।’ তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের জ্ঞান ও দীনদারির ঘাটতি কী? তিনি বললেন, ‘মহিলাদের সাক্ষী কি পুরুষদের সাক্ষীর অর্ধেক নয়?’ তাঁরা বললেন, জী, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘এটিই তাদের জ্ঞানের অল্পতা। যখন তাদের মাসিক শুরু হয় তখন কি তারা সালাত ও সাওম (রোজা) বাদ দেয় না?’ তাঁরা বললেন, জী, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘এটিই তাদের দীনদারিতে স্বল্পতা।’ [বুখারী : ৩০৪]
আরেক হাদীসে বলা হয়েছে, ইমরান ইবন হুসাইন রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘জান্নাতের সবচে কম অধিবাসী হবে নারী।’ [মুসলিম : ৭১১৮; মুসনাদ আহমদ : ১৯৮৫০]
অন্যদিকে আরেক সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে জান্নাতে দুনিয়াবাসীর স্ত্রী হবে তার দুনিয়ার স্ত্রী থেকে দু’জন। যেমন ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমার কাছে আমর নাকেদ ও ইয়াকূব ইবন ইবরাহীম দাওরাকী ইবন উলাইয়া থেকে বর্ণনা করেন, আর শব্দগুলো ইয়াকূবের। উভয়ে বলেন, আমাদের কাছে ইসমাঈল ইবন উলাইয়া বর্ণনা করেন, আমাদেরকে আইয়ূব মুহাম্মদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, জান্নাতে পুরুষ না নারীর সংখ্যা বেশি হবে তা নিয়ে তারা পরস্পর গর্ব বা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তখন আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, আবুল কাসেম (রাসূলুল্লাহ) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বলেন নি, ‘কিয়ামতের দিন যে দলটি সর্বপ্রথম জন্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের চেহারা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্জ¦ল; আর তৎপরবর্তী দলের চেহারা হবে আসমানে মুক্তার ন্যায় ঝলমলে নক্ষত্রের মতো উজ্জ¦ল। তাদের প্রত্যেকের থাকবে দু’জন করে স্ত্রী যাদের গোশতের ওপর দিয়েই তাদের পায়ের গোছার ভেতরস্থ মজ্জা দেখা যাবে। আর জান্নাতে কোনো অবিবাহিত থাকবে না।’ [মুসলিম : ৭৩২৫]
ইমাম মুসলিম রহ আরও বলেন, আমার কাছে ইবন আবী উমর বর্ণনা করেন, তাঁর কাছে সুফইয়ান আর সুফইয়ান ইবন সীরীন থেকে বর্ণনা করেন, পুরুষ ও নারীদের মধ্যে কারা বেশি জান্নাতী হবে এ নিয়ে নারী ও পুরুষদের মধ্যে তর্ক শুরু হলো। তারা আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহুর কাছে গিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলেন। তিনি তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন, আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: অতপর তিনি ইবন উয়াইনা বর্ণিত (পূর্বোক্ত) বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেন।
এ কারণে আলিমগণ এই হাদীসগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানে নানা মত ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ নারীরা কি অধিকাংশে জান্নাতে নাকি জাহান্নামে যাবে? জান্নাতে নারীর সংখ্যা বেশি হবে না জাহান্নামে?
কোনো কোনো আলিম বলেছেন, নারীরা অধিকাংশ জান্নাতবাসী হবে। আবার জাহান্নামের অধিবাসীর অধিকাংশও হবে নারী। কেননা কাযী ‘ইয়ায রহ বলেন, আদম সন্তানের মধ্যে অধিকাংশই নারী।
অনেকে বলেছেন, পূর্বোক্ত হাদীসগুলোর ভিত্তিতে বুঝা যায়, জাহান্নামের অধিবাসীদের সিংহভাগহই হবেন নারী। তেমনি ‘ডাগর চোখবিশিষ্ট হূর’দের যোগ করলে জান্নাতের অধিকাংশ অধিবাসীও হবেন নারী।
অন্য আরেকদল আলিম বলেছেন, হ্যাঁ শুরুতে নারীরাই হবেন জাহান্নামের অধিবাসীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। পরবর্তীতে মুসলিম নারীদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করানোর পর জান্নাতে তারাই হবেন সংখ্যাগুরু।
‘হে নারী সম্প্রদায়! তোমরা বেশি বেশি সদকা করো। কেননা, আমি তোমাদের বেশি জাহান্নামের অধিবাসী দেখেছি।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ বাণীর ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী রহ বলেন, ‘হতে পারে জাহান্নামে নারীদের সংখ্যা বেশি হবার বিষয়টি তারা জান্নাতে প্রবেশের আগের কথা। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলনেওয়ালা সবাই সুপারিশ লাভ ও আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির পর জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করলে জান্নাতে নারীর সংখ্যাই হবে বেশি।’ সারকথা, নারীদের প্রত্যাশা ও আত্মবিশ্বাস রাখা উচিত যে তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবেন না।
ফায়দা : ৮
নারীরা যখন জান্নাতে প্রবেশ করবেন, আল্লাহ তাঁদের যৌবন ফিরিয়ে দেবেন। আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার এক আনছারী বৃদ্ধা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কাছে দু‘আ করেন তিনি যেন আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘জান্নাতে তো কোনো বৃদ্ধ মানুষ প্রবেশ করবে না।’ এ কথা শুনে বৃদ্ধা বড় কষ্ট পেলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ যখন তাদের (বৃদ্ধদের) জান্নাতে দাখিল করাবেন, তিনি তাদের কুমারীতে রূপান্তরিত করে দেবেন।’ [তাবরানী, আল-মু‘জামুল ওয়াছিত : ৫৫৪৫]
ফায়দা : ৯
কোনো কোনো সাহাবীর উক্তি থেকে জানা যায় যে, আল্লাহর ইবাদতের অনুপাতে দুনিয়ার স্ত্রীগণ জান্নাতে ডাগরচোখা হূরদের চেয়েও দেখতে অনেক সুন্দরী হবে।
ফায়দা : ১০
ইবনুল কায়্যিম রহ বলেন, জান্নাতে প্রত্যেক অধিবাসীর জন্য অন্যের স্ত্রীদের কাছে ঘেঁষাও নিষিদ্ধ থাকবে।
শেষ কথা হলো, হে নারী সম্প্রদায়, এ জান্নাতকে আপনাদের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে যেমন একে সুসজ্জিত করা হয়েছে পুরুষদের জন্য। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় মুত্তাকীরা থাকবে বাগ-বাগিচা ও ঝর্ণাধারার মধ্যে। যথাযোগ্য আসনে, সর্বশক্তিমান মহাঅধিপতির নিকটে।’ {সূরা আল-কামার, আয়াত : ৫৫}
অতএব হেলায় সুযোগ হারাবেন না। কারণ, এ নশ্বর জীবন আর কয় দিনের? এটা তো দেখতে দেখতেই বয়ে যাবে। আর এরপর অবশিষ্ট থাকবে কেবল অনন্ত জীবন। সুতরাং জান্নাতের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হবার চেষ্টা করুন। আর জেনে রাখুন, অতিরিক্ত কল্পনা ও প্রত্যাশা নয়; জান্নাতের মোহরানা হলো ঈমান ও নেক আমল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীটি সর্বদা মনে রাখবেন। তিনি বলেন, ‘যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে, রমযানের সিয়াম পালন করে, আপন সতীত্ব রক্ষা করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, তাকে বলা হবে, যে দরজা দিয়ে ইচ্ছে জান্নাতে প্রবেশ কর।’ [মুসনাদ আহমাদ : ১৬৬১]
আপনাদেরকে সকল বিশৃঙ্খলাকারী ও বিনাশকারীদের আহ্বান সম্পর্কে পুরোপুরি সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। যারা চায় আপনাদের ক্ষতি করতে। আপনাদের অশ্লীল বানাতে। যাদের লক্ষ্য জান্নাতের নিয়ামত লাভে ধন্য হওয়া থেকে আপনাদের বিচ্যুত করা। এসব তথাকথিত স্বাধীন নারী ও পুরুষ, লেখক-লেখিকা এবং টিভি চ্যানেলের লোকদের চাকচিক্য ও শ্লোগানে প্রতারিত হবেন না। কারণ তারা হলো আল্লাহ যেমন বলেন, ‘তারা কামনা করে, যদি তোমরা কুফরী করতে যেভাবে তারা কুফরী করেছে। অতঃপর তোমরা সমান হয়ে যেতে।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৮৯}
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন মুসলিম নারীদেরকে জান্নাতুন নাঈম দানে কামিয়াবী করেন। আল্লাহ তাদেরকে হেদায়াতের পথের পথিক ও পথিকৃত বানিয়ে দেন এবং তাদের কাছ থেকে নারীর শত্রু ও ধ্বংসকারী নারী ও পুরুষ শয়তানকে দূরে সরিয়ে রাখেন। সবশেষে আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মদ (সাঃ), তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর শান্তি বর্ষণ করুন। আমীন।