Main Menu

ন্যায় বিচার

Originally posted 2013-03-14 07:43:57.

Justice

    জিয়াউল হক

আজ সুধী পাঠককে একটি গল্প শোনাবো। তবে গল্পটি একেবারে নিরেট গল্প নয়। এটি একটি অতি বাস্তব ঘটনা। ইতিহাসের পাতা হতে চয়ন করা হয়েছে। আমি কেবলমাত্র তা আমার নিজস্ব ভাষা আর ভাবে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করব। অবশ্য তার পেছনেও একটি কারণ বা উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। আর তা হলো, আমি নিজেসহ আপনাদের কাছে একটি আহ্বান রাখতে চাই। সে আহ্বানটি রাখার আগে তারই ভূমিকা হিসেবে এই গল্পটির উপস্থাপনা! আশা করি শ্রদ্ধেয় পাঠক আমার অপরাধ নেবেন না!
মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর। প্রবল প্রতাপশালী মোগল সম্রাট বাদশাহ আকবরের সন্তান। বাদশাহ আকবর পুরো ভারত বর্ষে ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে কি ও কেমন আচরণ করেছেন, তা ইতিহাসের পাঠক মাত্রই জানেন। সে কথা উল্লেখ করে সুধী পাঠকের আর ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না!
বাদশাহ আকবরের সেই সব ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড ও সকল পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ভারতীয় সচেতন মুসলমান রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের জান মাল তাঁরা অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, সকল প্রকার নির্যাতন সয়েছিলেন। মুসলমানদের এইসব আন্দোলনের পুরো ভাগে যিনি ছিলেন, তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন ভারতের বিখ্যাত আলেম হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী (র:)।
এই মহাপুরুষের আল্লাহ্ভক্তি, মানবপ্রীতি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস ছিল রূপকথার মত! সারা ভারতবর্ষ জুড়ে কেবল যে মুসলমানদের কাছে, তাই নয় বরং ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে তিনি ছিলেন এক অতি শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর কোন সিংহাসন ছিলনা, তেমনি ছিলনা কোন সৈন্য বাহিনী বা কোন প্রশাসন। তিনি ছিলেন নিতান্তই এক ফকির। অথচ তাঁর প্রভাব ছিল এতটাই যে, তাঁর একটি মাত্র ইশারায় সারা ভারতের কোটি কোটি মুসলমান, এমনকি অনেক হিন্দুও তাদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল।
এরকম এক ফকিরের সাথেই টক্কর লেগে গেল বাদশাহ আকবরের। সম্রাট আকবরের দ্বীন ই ইলাহী নামের এক নতুন ধর্মের বাতাবরণে পুরো ভারত বর্ষ থেকে ইসলাম নির্মূলের উদ্যোগকে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এই নিঃস্ব ফকির। বাদশাহ আকবরও তাঁর সকল রাজকীয় শক্তি আর দম্ভ নিয়ে মুজাদ্দিদে আলফেসানী (র:)-কে শায়েস্তা করতে উঠে পড়ে লাগেন। তাঁকে কারারুদ্ধও করা হয়। কিন্তু অচিরেই সারা ভারতে, এমনকি আকবরের নিজের প্রশাসনের মধ্যেই বিদ্রোহের আভাস পেয়ে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।
আকবরের মৃত্যুর পর তাঁরই পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর ক্ষমতায় বসেন। এবং তিনি তাঁর পিতার সাথে এই ফকিরের সঙ্ঘাতের কথা খুব ভালো করেই জানতেন। পিতার মত তিনিও এই ফকিরকে শায়েস্তা করতে উঠে পড়ে লাগেন, তাঁকে কারারুদ্ধ করেন। এবং সেই একইভাবে জাহাঙ্গীরের সৈন্যবাহিনী, সেনাপতিসহ সভাসদদের মধ্যেই বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠতে থাকে। সম্রাট প্রমাদ গোণেন, তাঁকে মুক্তিও দেন এবং তাঁর মুরীদ হন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি একজন প্রকৃত মুসলমানের ন্যায় দেশ শাসন করবেন। একজন প্রকৃত মুসলমানের ন্যায় জীবন যাপন করবেন! ঘটনাটি এর পরের।
রাণী নুর জাহান। জাহাঙ্গীরের বড় প্রিয়তমা স্ত্রী। খাস্ বাঁদী পরিবেষ্টিতাবস্থায় রাজমহলের একেবারে খাস অন্দর মহলের উঠোনে বসে বসে রাজকীয় হেকিমের তৈরী করে দেয়া বিশেষ ধরনের তেল মাখছিলেন। বনজ ও ভেষজ অনুষঙ্গের সাথে কস্তুরীর মিশ্রণে রাণীর জন্য বিশেষভাবে তৈরী সৌন্দর্য বর্ধক লোশন গায়ে মাখছিলেন। বাঁদী তাঁর পাশেই তাঁর নির্দেশ পালনার্থে তৈরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এমন সময় রাণী দেখলেন এক সৌম্য এবং অপরিচিত যুবক একবারে তাঁর আন্দর মহলে, তাঁরই নিকটে দাঁড়িয়ে আছে! রাণীর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে! অর্ধবসনা রাণী নুরজাহান রাগে, ক্ষোভে আর অপমানে উঠে দাঁড়াতে গিয়েও পারলেন না! কারণ তাতে করে তাঁর পুরো শরীর থেকেই কাপড় আরও বিবস্ত্র হয়ে পড়ার উপক্রম! কিন্তু এ ব্যাটা আগন্তক এতটাই অসভ্য যে, মহারাণীর ক্ষোভ আর লজ্জাকে উপেক্ষা করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে হা করে তাঁর সৌন্দর্য উপভোগ করছে!
এই সেই রাণী নুরজাহান! যার ব্যাপারে বলা হয় যে, তিনি এতটাই অনিন্দ সুন্দরী ছিলেন যে, সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তাঁকে নুরজাহান বা ‘সমগ্র জগতের আলো’ উপাধি দিয়েছিলেন! আর সেই রাণীর প্রতি এই বেয়াদব ব্যাটা এই ভাবে তাকিয়ে আছে!
রাণী খুব শীঘ্রই তাঁর হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। পাশেই পড়ে ছিল সম্রাট জাহাঙ্গীরকে ওলন্দাজ বণীকদের পক্ষ হতে উপহার দেয়া তৎকালীন যুগের সবচেয়ে কার্যকর বন্দুক! বারুদ ভরাই ছিল তাতে! রাণী তা হাতে তুলে নিয়ে ওমনি উক্ত আগন্তককে লক্ষ্য করে চালিয়ে দিলেন গুলি! আর তাতেই যুবকটি পড়ে গেল। কেবল পড়েই গেলনা বরং ঐ এক গুলিতেই ছেলেটি মারাও গেল। সারা রাজবাড়ী জুড়ে হৈ চৈ।
সম্রাট জাহাঙ্গীর কেবল একটু বিশ্রামে গেছেন, এমন সময় তাঁর নির্দেশে রাজবাড়ীর সদর ফটকে সর্বসাধারণের জন্য অতি সম্প্রতি টানিয়ে রাখা ঘন্টায় টান পড়ল। কোন একজন সাধারণ প্রজা সম্রাট জাহাঙ্গীরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়! অতএব তিনি পেয়াদা মারফত তাকে ডাকিয়ে নিলেন তাঁর সভাকক্ষে।
বিচার প্রার্থী হলেন একজন হিন্দু প্রজা। বয়সে বৃদ্ধ এই প্রজার অভিযোগ হলো, তাঁর একমাত্র ছেলে, মস্তিষ্ক বিকৃত তাঁর একমাত্র সন্তানকে রাজবাড়ীর ভেতরেই কেউ একজন গুলি করে হত্য করেছে। তিনি পুত্র হত্যার বিচার চান। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাৎক্ষণিকভাবেই বিষয়টি তদন্ত করতে নির্দেশ দিলেন। সহসাই জানা গেল যে, আর কেউ নন স্বয়ং রাণী নুরজাহানই অনাধিকার প্রবেশের দায়ে ছেলেটিকে গুলি করে মেরেছেন। নিহত ঐ যুবকটিই হলো বৃদ্ধ এই হিন্দু প্রজার সন্তান।
প্রকৃত ঘটনাটি জানতে পেরে সম্রাট জাহাঙ্গীরের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম! আর সেই বৃদ্ধ হিন্দু প্রজাটি কোনমতে পালিয়ে বাঁচার পথ খুঁজতে ব্যস্ত! স্বয়ং রাণীর বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ যাবে, জানলে কি সে আর আসত এখানে বিচার চাইতে! এখন বিচারতো দুরের কথা, নিজের জীবন নিয়েই টানাটানি!
কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীর ভরাট কণ্ঠে ঘোষণা করলেন যে, তিনি এর বিচার করবেনই। হত্যাকারী যেই হোক না কেন, তিনি তার বিচার করবেনই! রাণীকে তলব করা হলে তিনি এলেন। সম্রাটের প্রশ্নের জবাবে তিনি আদ্যোপান্তই জানালেন। তিনি এও বললেন, তিনি জানতেন না যে, ছেলেটি মস্তিষ্ক বিকৃত। তাঁর কথাতে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, রাণী নুরজাহানই ছেলেটিকে গুলী করে হত্যা করেছেন। অতএব আর স্বাক্ষীর কোন প্রয়োজন নেই। সম্রাট জাহাঙ্গীর ভরা এজলাসে চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে রইলেন। এর পরে তিনি তাঁর রায় ঘোষণা করলেন;
‘রানী, যেহেতু তুমি জানতে বন্দুকে গুলী ভর্তি, যেহেতু তুমি তাকে জেনে বুঝেই গুলী করেছ, নরহত্যা করেছ, হোক না সে মস্তিস্ক বিকৃত, তথাপি তুমি তাকে খুন করতে পার না। কিন্তু হায়, তুমি খুনী। রাণী আমি তোমাকে মানুষ খুনের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিচ্ছি।
রাণী নুরজাহান ক‘দিন ধরেই সম্রাট জাহাঙ্গীরের চরিত্রে এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলেন। আজ তার এই রায় যে সেই পরিবর্তনেরই বাস্তব প্রকাশ তা বুঝতে তার এতটুকুও ভুল হলো না। তাঁর অন্তর কেঁপে উঠল। কেঁপে উঠলেন সভাসদরা, মহারাণীর মৃত্যুদণ্ড! আর এক কোণে দাঁড়িয়ে মাঘের শীতে খোলা আকাশের নিচে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় যেমন করে মানুষ কাঁপে, তেমনি কেঁপে যাচ্ছেন বিচারপ্রার্থী সেই বৃদ্ধ!
রাণী নুরজাহান প্রাণের মায়ায় এগিয়ে এলেন। করজোড়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে তাঁর প্রাণ ভিক্ষার আবেদন জানালেন। বললেন, মহারাজ, একবার আপনার প্রতি আমার ভালোবাসার কথা স্মরণ করুন। একবার আপনার প্রতি আমার ত্যাগ, আর, প্রেমের কথা স্মরণ করুন! আমাকে আমার প্রাণ ভিক্ষা দিন।
সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর রাণী নুরজাহানের কথায় মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তাঁর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকে লুকোতে লুকোতে জবাব দিলেন;
‘রাণী তুমি মনে করোনা আমি তোমাকে ভালোবাসিনা, আমি তোমার ভালোবাসার কথা ভুলে গেছি! রাণী, আমি বার বার তোমার ভালোবাসার কথা মনে করছি, আর মনে করেছি আমার প্রতি মহান আল্লাহর নির্দেশ! প্রতিবারেই আমার মনে আল্লাহ্র ভালোবাসাই প্রবল হয়ে উঠছে। আমি তাঁর নির্দেশ অমান্য করতে পারব না। নরহত্যার অপরাধে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড নিতেই হবে। এখানে আমার করার কিছুই নেই। হ্যাঁ, তবে শোন, আমি তোমাকে আজও সেই আগের মতই ভালোবাসি। তোমার অবর্তমানে আমার জীবন মরুভূমি হয়ে যাবে, সে দুঃখটুকুও সইব কিন্তু আমি ন্যায় বিচারের পথ হতে সরে আসতে পারব না!
সম্রাট জাহাঙ্গীর এবারে আর নিজেকে সামাল দিতে পারলেন না। তিনি রাণীর আসন্ন বিয়োগ ব্যথায় ডুকরে কেঁদে উঠলেন। এতক্ষণ রাজসভার এক কোণে নিথর নিশ্চুপ ঠাই দাঁড়িয়ে থাকা সেই বৃদ্ধ বাকরুদ্ধ হয়ে নাটকীয় এই সব দৃশ্য দেখছিলেন। তিনি নিজের চোখকে, নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাঁর চোখ দিয়েও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। এবারে তিনি এগিয়ে এলেন, বললেন;
‘মহারাজ, মাফ করবেন। আমি আমার এই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একি দেখলাম! বিচারক নিজ স্ত্রী, আসামিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ শুনিয়ে দেবার সাথে সাথে একথাটিও বলে দেয় ‘আমি তোমাকে সেই আগের মতই ভালোবাসি, তোমার অবর্তমানে আমার জীবন মরুভূমি হয়ে যাবে, সে দুঃখও আমি সইব কিন্তু অবিচার করতে পারব না!’ মহারাজ আমার কলিজার টুকরো সন্তানকে আমি আর পাব না, কিন্তু মহারাজ আমি এমন ন্যায় বিচারক বাদশাহ, এমন পতীভক্তা রাণীর জীবনকে মরভূমি হতে দিতে পারি না। মহারাজ, আমি রাণীকে ক্ষমা করে দিলাম! মহারাজ আপনি তাঁর প্রাণ ভিক্ষা দিন। ধন্য এমন ধর্ম, যেখানে আসামি আর বিচারক একই সাথে গলা ধরাধরি করে কাঁদে!
দুঃখের বিষয় হলো এই যে, সম্রাট জাহাঙ্গীর বেশি দিন তাঁর এই অবস্থানকে ধরে রাখতে পারেন নি। তবে যে স্বল্পকাল তিনি ইসলামের নিষ্ঠাবান অনুসারী ছিলেন, তারই মাঝে ঘটেছিল এই চিত্তাকর্ষক ঘটনাটি!
সূধী পাঠক, আমাদের সমাজের আমরা সবাই যদি ইসলামের সঠিক শিক্ষা আর দর্শনের কাছে সম্রাট জাহাঙ্গীরের মত করে নিজেদেরকে সঁপে দিতে পারতাম! কতই না ভালো হতো! কল্পনা করুনতো, এই বিশ্বের সকল প্রেসিডেন্ট, প্রাইমিনিষ্টার, রাজনীতিবিদসহ সকল স্তরের মানুষই সম্রাট জাহাঙ্গীরের মত ইসলামের শিক্ষা আর দর্শনের কাছে নিজেদেরকে সেই একইভাবে সমর্পন করে দিয়েছে! পৃথিবীটা কেমন হবে তখন?

RoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRoseRose

Related Post