মহান আল্লাহর বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি রহস্যের একটি হলো জবান বা বাকশক্তি। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে একমাত্র মানুষই এ নিয়ামতের অধিকারী। এর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ অপরের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও দোয়া পেয়ে থাকে। অন্য দিকে এর অপব্যবহারের মাধ্যমে অপমান, ঘৃণা ও বদদোয়া অর্জন করে। মানুষের বেশির ভাগ পাপ-পুণ্যের মূল উৎস এ বাকশক্তিই। মহানবী সা: বলেছেন, ‘মন্দকথা মানুষকে জাহান্নামে উপুড় করে নিপে করে’ (তিরমিজি)। তিনি আরো বলেছেন, মুসলমানদের সুন্দর বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থহীন কথা ও কাজ পরিত্যাগ করা’ (তিরমিজি)। আল্লামা ইবনে কাইয়্যিম রহ: বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে দেখি, যারা সর্বদা বিভিন্ন রকম অশ্লীল ও বানোয়াট কথাবার্তায় লিপ্ত থাকে। অথচ, জীবন-মরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা কোনো গুরুত্বই দেয় না। নিজেরা কী বলে, সে বিষয়টি একবারও খতিয়ে দেখে না; উপলব্ধি করে না যে, জবানের একটিমাত্র বাক্য তাদের আজীবনের অর্জিত নেক আমল ধ্বংস করে তাদেরকে দ্বীন থেকে খারিজ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
মুখের ভাষাই হলো জবান। আরবিতে বলে ‘লিসান’। জবান বা জিহ্বা হাড়বিহীন এক টুকরো মাংস হলেও আল্লাহপাক এর ভেতরে রেখে দিয়েছেন হাজার প্রকারের স্বাদ গ্রহণের মতা। মূলত জবান হচ্ছে মানুষের মুখ থেকে উচ্চারিত বাক্য, বিবৃতি, ভাষণ, বক্তব্য, উক্তি, বুলি, সংলাপ, সম্বোধন ইত্যাদি। সর্বাবস্থায় মন্দকথা, কটূক্তি, খোঁটা, পরচর্চা, গালি, অভিশাপ, অশ্লীল কথা, ঠাট্টা-বিদ্র প, ব্যঙ্গোক্তি, অবজ্ঞা, ধিক্কারবকাবকি, ধাপানি, দাবড়ি, ভেটকি, খ্যাঁকখ্যাঁক, হম্বিতম্বি, বাগাড়ম্বর, হুংকার প্রভৃতি পরিহার করে শৈল্পিক ভাষায়, নরম সুরে ও দরদমাখা কণ্ঠে কথা বলা ইবাদতের শামিল। অফিস-আদালত, পরিবার-পরিজন, লোকালয়-সমাজ, ব্যবসায়-বাণিজ্যে, বন্ধু-বান্ধবের অড্ডা সর্বাবস্থায় সুভাষী, মিষ্টভাষী, সুবক্তা, মৃদুভাষী, কোমলভাষী, স্পষ্টভাষী, মিতভাষী, হিতভাষীর পরিচয় দেয়াই একজন মুমিনের কথা বলার শৈল্পিক কারুকার্য।
আমাদের চরিত্রে এ বিষয়টি লণীয় যে, আমরা অযথা বাড়াবাড়ি, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে মাতামাতি কিংবা সন্দেহ-সংশয় বা কল্পনাপ্রসূত বিষয়াদি নিয়ে বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দিতে পছন্দ করি। অথচ প্রতিটি মুহূর্ত যে এক একটি হিরকখণ্ড সমতুল্য তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। অত্যন্ত পরিতাপের সাথে ল করছি, আমরা আজ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পাপাচার, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি, কুসংস্কার, চলচাতুরী ও অশ্লীলতায় ডুবে আছি। জবানের যথাযথ সংরণের মাধ্যমে নৈতিক চরিত্রে বলীয়ান হওয়া এখন সময়ের অনিবার্য দাবি।মহান প্রভুর অসীম অনুগ্রহপ্রাপ্ত মানবজাতি তাদের জবানের জন্য ধন্য। জবান এমন একটি যন্ত্র, যে যন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ ভালো-মন্দ দুটোই চর্চা করতে পারে। এর সর্বোত্তম ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন : * হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। (আহজাব : ৭০) * এমন কোনো শব্দ মানুষের মুখ থেকে বের হয় না, যা সংরতি করার জন্য একজন সদা প্রস্তুত রক উপস্থিত থাকে না। (কাফ : ১৮) * মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র; যারা অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত (আল-মুমিনুন : ১-৩) * যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার পেছনে পড়ো না। (আল-ইসরা : ৩৬) * হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বলো, যা নিজেরা করো না? আল্লাহর কাছে এটা অপছন্দনীয় কাজ যে, তোমরা এমন কথা বলো যা করো না। (আস-সফ : ২) * ধ্বংস এমন সব ব্যক্তির জন্য যে (সামনাসামনি) লোকদের ধিক্কার দেয় এবং পেছনে নিন্দা করতে অভ্যস্ত (আল-হুমাজাহ : ০১) * মানুষের সাথে ভালো কথা বলো, সুন্দর কথা বলো তাদের সাথে দয়া, সহানুভূতি ও নম্রভাবে কথা বলো। (২: ৮৩) * তাদের সাথে সম্মানের সাথে কথা বলো। (১৭:২৩)।
আয়াতগুলো থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, কথা বলার মতা আছে বলেই যা ইচ্ছা তাই বলার নৈতিক অধিকার মানুষের নেই। যা কিছু কল্যাণকর এবং শরিয়াহ সমর্থিত তাই বলতে হবে। কেননা জবানের সুন্দরতম ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ যেমনি জান্নাতের দরজায় পৌঁছে যায়, তেমনি এর অপব্যবহারের মাধ্যমে জাহান্নামের কিনারায় এসে হাজির হয়। সুতরাং জবানের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রত্যেকেরই কর্তব্য। মানুষ তার হৃদয়ে যেসব ছবি বা কল্পনা ধারণ করে, তা কথা হয়ে প্রকাশ পায়। মানুষ মনে মনে যাই ভাবুক না কেন, তা যদি মুখে প্রকাশ না করে তাহলে ধীরে ধীরে তা অন্তর থেকে অস্তমিত হয়ে যায়।
মুমিন জীবনের সার্বিক আচার-আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ইসলামী শরিয়াহ সুস্পষ্ট নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। তাদের কাজকর্ম, কথাবার্তা, ওঠাবসা, চলাফেরা, চিন্তাচেতনা, আবেগ-অনুভূতি এমনকি আনন্দ-উল্লাস পর্যন্ত ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হবে মাবুদের শেখানো কথামালা ও মানবতার জয়গান। শয়তানি, তাগুতি এবং কুপ্রবৃত্তিজনিত কথাবার্তা থেকে তারা সদা সর্বদা বিরত থাকবে। পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব প্রকাশক জ্ঞানগর্ভ বাক্যই উচ্চারিত হবে তাদের বাকযন্ত্রে। হককে হক এবং বাতিলকে বাতিল বলতে তারা কখনো বিচলিত হবে না। মহান আল্লাহর শান আজিমত মতা কর্তৃত্ব সদাসর্বদা তাদের হৃদয়ে থাকবে জাগরুক। তাই তাদের জবান দ্বারা শুধু পবিত্র, সুন্দর এবং কল্যাণধর্মী কথামালাই উচ্চারিত হবে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর অসংখ্য হাদিস দ্বারা মুমিন ব্যক্তির জবানের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি ফুটে উঠেছে। নিম্নে তার কিছু চিত্র তুলে ধরা হলো :
হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেন, নিশ্চয়ই বান্দা এমন সব কথাবার্তা বলে, যার পরিণামের প্রতি ভ্রƒপে করে না অথচ তা দ্বারা আল্লাহ পাক তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে থাকেন। আবার কখনো কখনো বান্দা এমন সব কথাবার্তা বলে থাকে, যার পরিণামের প্রতি সে ভ্রƒপে করে না, অথচ তা দ্বারা আল্লাহর অসন্তোষ অর্জিত হয়, যার ফল অবশেষে তাকে জাহান্নাম পর্যন্ত নিয়ে যায়। (সহিহ বুখারি)। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত রাসূল সা: বলেন, যখন বনি আদম ভোরে উপনীত হয়, তখন প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জবানের ব্যাপারে চিন্তিত থাকে। তারা বলে আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। কেননা আমরা তোমারই অধীনস্ত, সুতরাং তুমি যদি সঠিক হয়ে যাও আমরাও সঠিক হয়ে যাবো, আর তুমি যদি বিগড়ে যাও, আমরাও বিগড়ে যাবো। (সহিহ তিরমিজি)। হজরত আনাস বিন মালিক রা: থেকে বর্ণিত রাসূল সা: বলেন, মানুষের মধ্যে যেমনি ভালোর চাবিকাঠি রয়েছে, তেমনি মন্দের চাবিকাঠিও রয়েছে। সৌভাগ্যবান হলো তারা, যাদেরকে আল্লাহ পাক কল্যাণের চাবিকাঠি দান করেছেন। আর অভিশাপ ও দুর্ভাগ্য ওই ব্যক্তির জন্য, যার হাতে আল্লাহ পাক মন্দের চাবিকাঠি তুলে দিয়েছেন। সৌভাগ্যবানকে তার জবান কল্যাণের পথে সহায়তা দান করে। আর দুর্ভাগাকে মন্দের পথে সহায়তা দান করে। (আহমাদ, ইবনে হিব্বান)।
রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর সাহাবিদের জবানের খারাপি থেকে আশ্রয় চাওয়ার দোয়া এ বলে শিা দিতেন। বলো : হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট শ্রবণশক্তির খারাবি থেকে, দৃষ্টিশক্তির খারাবি থেকে, বাকযন্ত্রের খারাবি থেকে, অপরিচ্ছন্ন অন্তর থেকে এবং নিকৃষ্ট বীর্য থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (সুনানে নাসায়ি)। বান্দা তার অন্তরের ওয়াসওয়াসা অথবা হৃদয়ে উদিত কথামালার জন্য ততণ পর্যন্ত পাকড়াও হবে না, যতণ পর্যন্ত না সে তা বাস্তবে পরিণত করবে অথবা মুখে প্রকাশ করবে। (বুখারি ও মুসলিম)। যে ব্যক্তি তার দুই চোয়াল এবং দুই ঊরুর মধ্যবর্তী স্থান আমার উদ্দেশে সংরণ করল, আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদারি গ্রহণ করব। (বুখারি)। রাসূলুল্লাহ সা: এ মর্মে জিজ্ঞাসিত হলেন যে, কোন কারণে অধিকাংশ মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে? তিনি বললেন : আল্লাহভীতি এবং উত্তম চরিত্র। অতঃপর জিজ্ঞাসিত হলেন কোন কারণে অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে নিপ্তি হবে? উত্তরে তিনি বললেন : দুটি শর্ত, একটি হলো জবান অপরটি হলো লজ্জাস্থান (ইবনে মাজাহ)। মুমিন সে নয়, যে উপহাস করে, অভিশাপ দেয়, অশ্লীল ভাষায় কথা বলে এবং বাচাল। (তিরমিজি)। তোমরা অনুমান করে কথা বলো না, কারণ অনুমান হচ্ছে জঘন্যতম মিথ্যা কথা (বুখারি ও মুসলিম)। এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। সে তার ভাইকে অপমান করবে না। (মুসলিম)। তোমার ভাইয়ের বিপদে আনন্দ করো না (তিরমিজি)। মুসলমান ভাইকে হেয় করাই পাপী হওয়ার জন্য যথেষ্ট। (মুসলিম)। মুসলমানদের গালি দেয়া ফাসেকি (বুখারি ও মুসলিম)। ইবনে ওমর রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : মুমিনের উদাহরণ হলো মৌচাকের মতো, তুমি তা থেকে ঠিক যতটুকু গ্রহণ করবে ততটুকুই তোমাকে ফায়দা দেবে (ইবসে হিব্বান ও ইবনে আসাকের)। সুফইয়ান বিন আবদুল্লাহ আসসাকাফি রা: বলেন, আমি বললাম : হে আল্লাহর রাসূল সা: আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলে দিন, যা পরিপালনের মাধ্যমে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন : তুমি বলো : আল্লাহ আমার রব এবং এ কথার ওপর অটল থাকো। অতঃপর তিনি তার জিহ্বাকে ধরলেন এবং বললেন : এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখো। (মুসলিম ও তিরমিজি)। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : যে চুপ থাকল সে নাজাত পেল। (তিরমিজি, দারেমি)। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন : মুমিন হলো ওই ব্যক্তি, যার অনিষ্ট থেকে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা লাভ করে, মুসলিম হলো সে, যার জবান এবং হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপত্তা লাভ করে, মুহাজির হলো সে, যে মন্দ কাজ পরিহার করে। আল্লাহর কসম! ওই ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরপত্তা পায় না। (ইবনে হিব্বান)। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে, সে যেন উত্তম কথা বলে, নতুবা চুপ থাকে। (মুসলিম)। ইবনে আব্বাস রা: বলেন হে জিহ্বা ! তুমি ভালো কথা বলো, তাহলে তুমি কল্যাণপ্রাপ্ত হবে। অথবা মন্দ বলা থেকে চুপ থাকো, তাহলে তুমি নিরাপত্তা পাবে। (আহমাদ)।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এ মহাসত্যটিই আমাদের সামনে পরিষ্কার হয় যে, জবান আল্লাহর দেয়া সাময়িক ব্যবহারের জন্য একটি বিশেষ উপহার। এটা ব্যবহারের পরিপূর্ণ এখতিয়ার মানুষকে দেয়া হয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত কথা বলার আগে সূদুরপ্রসারী চিন্তাভাবনা করা, কথাকে শরয়ি তুলাদণ্ডে মেপে মানব কল্যাণের বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলা। নচেৎ চুপ থাকা, কেননা এতে রয়েছে মুক্তি এবং বরকত।