মুসলিম সমাজ তথা মুসলিম জাতির পরিপূর্ণতার জন্য এমন রক্ষণশীল আদর্শ নারীর প্রয়োজন, যে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জানে এবং তার উপর অর্পিত আমানতকে অনুধাবন করে; যে নিজের পথ দেখতে পায় এবং অন্য কেও পথ দেখাতে পারে ,আর এ ক্ষেত্রে সে সবার আগে যার ওপর পূর্ণ অধিকার রাখে তা হল তার সন্তান । যার প্রতি পরিপূর্ণ দায়িত্ব- কর্তব্য পালন করার পরই আল্লাহ্ চাইলে নিজেকে একজন সার্থক মা হিসেবে নিজেকে দেখতে পাবেন ।
নারীর এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্যের সূচনার প্রথম ধাপ হল তার শিশু সন্তানদের পিতা গ্রহণের ক্ষেত্রে বর বাছাইয়ের জটিল ধাপ বা স্তরটি। যে কেউ তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছা পোষণ করে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করলেই সে তা গ্রহণ করবে না; বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহণযোগ্য স্বামী নির্বাচনের জন্য সুস্পষ্ট মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন:
«إذا أتاكم من ترضون خلقه ودينه فزوجوه . إلا تفعلوا تكن فتنة في الأرض وفساد عريض » ( أخرجه الترمذي و ابن ماجه ).
“যখন তোমাদের নিকট এমন কোন ব্যক্তি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে, যার চরিত্র ও দীনদারীতে তোমরা সন্তুষ্ট, তবে তোমরা তার বিয়ের ব্যবস্থা করে দাও। যদি তোমরা তা না কর, তবে তা পৃথিবীর মধ্যে বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং ব্যাপক বিশৃঙ্খলার কারণ হবে।” – (ইমাম তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন)
মানদণ্ড হল তিনটি বিষয়: দীন, চরিত্র ও আকল ,যখন এই তিনটি বিষয় ব্যক্তির মধ্যে দেখবে তখন তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে। । সৌভাগ্য, পবিত্র বা উত্তম জীবন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে উত্তম পরিণতি এই মানদণ্ডের মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
সন্তান কে যথাযথ ইসলামিক বিধি-বিধানের উপর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি অনেক গুরুত্ত পূর্ণ ।
একজন মায়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য যা উল্লেখ করার মত, তা হল নিম্নরূপ:
–
১)- তাওহীদ তথা একত্ববাদের ভিত্তিতে কথা বলার উপর তাকে অভ্যস্ত করানো এবং তার প্রাণে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বিষয়াদির বীজ বপন করা; বিশেষ করে প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যেই তা করতে হবে। সুতরাং গবেষকদের কেউ কেউ উল্লেখ করেন যে, শিশু তার প্রথম বছরগুলোতেই তার পূর্বপুরুষদের অধিকাংশ চিন্তাচেতনার আলোকে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে; কারণ, ৯০% শিক্ষা-বিষয়ক কার্যক্রম তার প্রথম বছরগুলোতেই সম্পন্ন হয়। সুতরাং গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল এই সময়কালকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো।
ইবনুল জাউযী র. বলেন: ছোট বয়সে যা হয়, তাকেই আমি বেশি মূল্যায়ন করি; কেননা যখন সন্তানকে তার স্বভাবের উপর ছেড়ে দেয়া হয়, তখন সে তার উপরই বেড়ে উঠে; আর স্বভাব একটি কঠিন বিষয় ।
২) শিশুকে নিম্নোল্লেখিত যিকিরসমূহ উচ্চারণে অভ্যস্ত করা: لا إله الا الله, محمد رسول الله (আল্লাহ ছাড়া কোন প্রকৃত ইলাহ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল ), سبحان الله (আল্লাহ পবিত্র), الحمد لله (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য), الله أكبر (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ), لا حول و لا قوة إلا بالله ( আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত কোন ক্ষমতা নেই এবং কোন শক্তি নেই ), ইত্যাদি।
৩) শিশুর মনে আল্লাহর ভালবাসার বীজ রোপন করা।
৪) শিশুর মনে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও তার ভয়ের অপরিহার্যতার বীজ বপন করা।
৫) শিশুর মনে মানুষের উপর আল্লাহর নজরদারী ও খবরদারীর বীজ রোপন করা।
৬) শিশুকে ভাল কথা বলার অভ্যাসে অভ্যস্ত করা, যেমন: أحسنت (তুমি সুন্দর করেছ), شكرا (ধন্যবাদ), جزاك الله خيرا (আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন)।
৭) গুরুত্বপূর্ণ দো‘আসমূহ, ঘুম, খাওয়ার (পূর্বাপর) এবং বিভিন্ন স্থানে প্রবেশের যিকির তথা দো‘আসমূহ পাঠ অভ্যস্ত করা।
৮) শিশুদেরকে (আল্লাহর) আশ্রয়ে দেয়া, যেমনটি করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ও হোসাইনের সাথে [23]; যেমন অভিভাবক বলবে:
«أعيذك بكلمات الله التامة من كل شيطان وهامة ومن كل عين لامة»
“আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমাসমূহের অসীলায় প্রত্যেক শয়তান, বিষাক্ত প্রাণী এবং প্রত্যেক কুদৃষ্টিসম্পন্ন চোখ থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে দিচ্ছি।”
যাতে শয়তান তাদেরকে শিকার করতে পারে না।
– আরও বিশেষভাবে যা উল্লেখ্য তা হল, তাকে শুরুতে ঘরের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব (আল-কুরআনুল কারীম) মুখস্থ করাবে এবং তাকে তা শুনাবে। আর অনুরূপভাবে সুন্নাতে নববী তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস থেকে কিছু মুখস্থ করাবে, বিশেষ করে ছোট ছোট হাদিসসমূহ।
– শিশুদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনীসমূহ থেকে কিছু আলোচনা করা; বিশেষ করে সীরাতে নববী তথা নবীর জীবনী থেকে ঐ পর্যায়ের বিষয়গুলো থেকে আলোচনা করা, যা সে বয়সের যে স্তরে জীবনযাপন করছে, তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কারণ, ঐ কাহিনীসমূহ তার মধ্যে বড় রকমের শিক্ষামূলক প্রভাব ফেলবে এবং তার মনে উন্নত ও শক্তিশালী চরিত্রের বীজ বপন করবে; আর সে প্রত্যাশা করবে, সে যেন ঐসব ব্যক্তিবর্গের মত হতে পারে, যাদের কাহিনী সে শ্রবণ করেছে।
– শিশুর মধ্যে তার ছোটকাল থেকেই উন্নত মানের ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের ব্যাপারে আশা-আকাঙ্খা জাগিয়ে তোলা এইভাবে যে, সে মনে মনে পরিকল্পনা স্থির করবে যে, সে অমুকের মত আলেম (বিদ্বান) হবে, অথবা অমুকের মত ডাক্তার হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
– শিশুর আগ্রহ ও ইচ্ছাসমূহ প্রকাশ করতে এবং তার আল্লাহ প্রদত্ত মেধাসমূহের বিকাশে উদ্যোগ গ্রহণ করা; সুতরাং উদাহরণস্বরূপ বলা যায়: যখন দেখা যায় যে, সে পড়ার প্রতি আগ্রহী, তখন সে তাতেই তাকে নিয়োগ করে দেবে এবং তার জন্য সংশ্লিষ্ট বইপত্রের ব্যবস্থা করে দেবে; আর যখন সে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী হবে, তখন তাকে ঐ খেলাধুলার ব্যবস্থা করে দেবে, যা তার শক্তি ও মেধা বিকাশে ভূমিকা রাখবে … অনুরূপভাবে আরও অন্যান্য বিষয়ও হতে পারে।
– আর সাত বছর বয়সের সময় শিশুর সাথে আচার-আচরণের ক্ষেত্রে নতুন আরেক ধাপের সূচনা হয়; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কতগুলো মৌলিক সাইনপোস্ট (Signpost) ঠিক করে দিয়েছেন তাঁর বাণীর মাধ্যমে, তিনি বলেছেন:
«مروا أبناءكم بالصلاة لسبع سنين واضربوهم عليها لعشر سنين وفرقوا بينهم في المضاجع ». (أخرجه الإمام أحمد و أبو داود).
“তোমাদের সন্তানদেরকে তোমরা সালাতের নির্দেশ দাও, যখন তারা সাত বছর বয়সে উপনীত হয় এবং তার কারণে তাদেরকে প্রহার কর, যখন তারা দশ বছর বয়সে উপনীত হয়। আর তাদের শোয়ার স্থান পৃথক করে দাও।” ( ইমাম আহমদ ও আবূ দাউদ র. হাদিসখানা বর্ণনা করেন) [24]
আর এগুলি হল——
– শিশুকে সালাতের নির্দেশের দ্বারা শুরু করা, যা ইবাদতসমূহের মধ্যে প্রধান এবং তাকে এই দিকে মনোযোগী করা ও তার প্রতি উৎসাহিত করা। আর এই নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত হবে সাওমের (রোযার) মত অপরাপর সকল ইবাদতও। আর তাকে এই কাজে অভ্যস্ত করে তোলা। আর সে উপলব্ধি করবে যে, তার সকল কার্যক্রমই ইবাদত, যার মাধ্যমে সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করবে।
আল্লাহ্ তায়ালা প্রতিটা মুসলিম নারীকে আল্লাহ্র দেয়া সবচেয়ে বড় নেয়ামত তার সন্তানকে নেক ভাবে গড়ে তোলার তৌফিক দান করুক ,এবং এ সন্তান তাকে যেন দুনিয়াতে এবং আখিরাতে শান্তি দেয় ও সম্মানিত করে —আমীন ।