মসজিদ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ সিজদার স্থান। ইসলামের পরিভাষায় যে নির্দিষ্ট স্থানে মুসলমানেরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নতশিরে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে তাকেই মসজিদ বলা হয়। মুসলমানেরা শুধু আল্লাহর কাছে মাথা নত করে বা সিজদা করে। সে কারণে, তারা একটি স্থান নির্দিষ্ট করে। আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে যে স্থানে নতশিরে নামাজ আদায় করে সে স্থানকে মসজিদ বলা হয়। মুসলিম সমাজে মসজিদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. আল্লাহর ইবাদত : মসজিদ আল্লাহর ইবাদতের ঘর। মুসলিম সম্প্রদায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে আদায় করে। মসজিদ খুব নিরিবিলি স্থান। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘উৎকৃষ্টতম বসিবার স্থান হইল মসজিদসমূহ।’
২. ধর্মীয় স্থান : ধর্মীয় বিশেষ স্থান হিসেবে মসজিদের ভূমিকা গুরুত্ব রাখে। মুসল্লিরা শুধু আল্লাহর আনুগত্য লাভের জন্যই মসজিদে গমন করে না; বরং সেখানে ধর্মের আইন-কানুন, মাসায়েল ও ধর্মের অন্যান্য বিষয়াদি সম্বন্ধেও আলোচনা করা হয়। ইমাম সাহেব মাঝে মধ্যে নামাজান্তে ধর্মের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন। ফলে উপস্থিত সবাই ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করে।
৩. ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরণ : একটি বিশিষ্ট এলাকার মুসলমানেরা জামাতে নামাজ আদায় করার জন্য দৈনিক পাঁচবার মসজিদে উপস্থিত হন। তা ছাড়া, সপ্তাহে এক দিন জুমার নামাজ পড়ার জন্য বহু মুসল্লি মসজিদে সমবেত হন। রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীবর্গ, প্রভাবশালী ব্যক্তি, সাধারণ লোক, গরিব-ধনী, শুভ্র-কৃষ্ণ, শত্রু-মিত্র বিভিন্ন শ্রেণীর সব লোক মসজিদে নামাজে আসেন। তারা একই কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয় ইমামের সাথে রুকু, সেজদা ইত্যাদি আদায় করে নামাজ শেষ করে, তাদের মধ্যে কোনো বিভেদ থাকে না। মনে হয় যেন সবাই এই ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। তাই দেখা যায় ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরণের ক্ষেত্রে মসজিদের ভূমিকা অতুলনীয়।
৪. সহানুভূতিশীল হওয়া : মুসল্লীগণ দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদ আদায় করার ফলে সবার সাথে পাঁচবার দেখা-সাক্ষাৎ হয় এবং তাদের মধ্যে কতাবার্তাও হয়। ফলে পরস্পরের মধ্যে আন্তরিকতা, স্নেহ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা গড়ে ওঠে। সে কারণে তারা একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।
৫. খোঁজখবর নেয়া : মানুষ কম-বেশি কর্মব্যস্ত থাকে। এই কর্মব্যস্ততার মধ্যে আশপাশের প্রতিবেশীর খোঁজখবর সব সময় নেয়া সক্ষম হয় না এবং সবার সাথে সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু মুসল্লিরা বা প্রতিবেশীরা মসজিদে নামাজে আসার ফলে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসে। একে অপরের খোঁজখবর নেয়ার ক্ষেত্রে মসজিদ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৬. শৃঙ্খলাবোধ জাগরণ : জামাতে নামাজ আদায়ে মসজিদে যে শৃঙ্খলা প্রকাশ পায় তা মুসল্লিদের মধ্যেও শৃঙ্খলাবোধ জাগরণে বিরাট ভূমিকা পালন করে।
৭. আনুগত্য : ইমামের পেছনে জামাতে নামাজ আদায় করার সময় মনে হয় যেন সবাই ইমামের আনুগত্য স্বীকার করেছে। সে কারণে সবাই ইমামের অনুসরণ ও অনুকরণ করছে। অতএব, ইমামের অনুসরণ ও অনুকরণ হবে সঠিক নেতার প্রতি আনুগত্যের শিক্ষালাভ করে।
৮. সময়ানুবর্তিতা : মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নির্ধারিত সময়ে আদায় করা হয়। এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের মধ্যে জাগ্রহ হয় নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতার দায়িত্ব, জ্ঞান ও কর্তব্যবোধ।
৯. জনহিতকর কার্যাবলি : মসজিদে পাঠাগার স্থাপন করে ছোট ছোট শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, সামাজিক সংস্কার কমিটি গঠন করাসহ প্রভৃতি জনহিতকর কার্যাবলি সম্পাদন করা যায়। মসজিদে বসে সামাজিক, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় সমস্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করে একটি সমৃদ্ধিশালী সমাজ, জাতি তথা রাষ্ট্র গঠন করা যেতে পারে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মসজিদগুলো ইবাদতখানা, শিক্ষালয় এবং জাতির পার্লামেন্টরূপে ব্যবহৃত হতো। সেখানে নামাজ হতো, উপরন্তু সমাজ ও জাতির উন্নতিবিষয়ক আলোচনা ও উপায় উদ্ভাবন করা হতো, রাজনীতিও চর্চা করা হতো। পৃথিবীতে বর্তমানে ১২ লক্ষাধিক মসজিদ রয়েছে। বিশ্বের সব মুসলমান এই মসজিদে গমন করে আল্লাহর ইবাদতের সাথে সাথে চরিত্র গঠন, সামাজিক সংস্কার, জেহাদের প্রেরণা এবং ইসলাম প্রচারের অনুপ্রেরণা লাভ করে। এ জন্য আল্লাহতায়ালা মসজিদ নির্মাণে উৎসাহিত করে বলেছেন :“আল্লাহর মসজিদসমূহ শুধু সেই ব্যক্তি নির্মাণ করে থাকে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কিয়ামতের দিনের ওপর ঈমান আনিয়া থাকে, নামাজ আদায় করে, জাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকেও ভয় করে না।’ (আল কুরআন, সূরা-তওবা-১৮)।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য মসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহ তাহার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি ঘর নির্মাণ করিবেন।’
অতএব আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মসজিদের ভূমিকা অবর্ণনীয়। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা মসজিদ নির্মাণে উৎসাহিত করেছেন।