হজরত ইমাম ইবনে কাসির (রহ.) স্বীয় তাফসির গ্রন্থে আলোচ্য আয়াতের তাফসির এবং সংশ্লিষ্ট হাদিসগুলো বিস্তারিত বর্ণনা করার পর বলেন, সত্য কথা এই যে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসরা সফর জাগ্রত অবস্থায় করেন, স্বপ্নে নয়। মক্কা মুকাররমা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত এ সফর বোরাকযোগে করেন। বায়তুল-মুকাদ্দাসের দ্বারে উপনীত হয়ে তিনি বোরাকটি অদূরে বেঁধে দেন এবং মসজিদে আকসায় (বায়তুল মোকাদ্দাসে) প্রবেশ করেন। মসজিদের কেবলার দিকে মুখ করে দু’রাকআত তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামাজ আদায় করেন। অতঃপর সিঁড়ি আনা হয়, যাতে নিচ থেকে ওপরে যাওয়ার জন্যে ধাপ বানানো ছিল। তিনি সিঁড়ির সাহায্যে প্রথমে প্রথম আকাশে, অতঃপর অবশিষ্ট আকাশগুলোতে গমন করেন। এ সিঁড়িটি কী এবং কী ধরনের ছিল, তার প্রকৃত স্বরূপ আল্লাহ তায়ালাই জানেন। আজকালও অনেক ধরনের সিঁড়ি পৃথিবীতে প্রচলিত রয়েছে। স্বয়ংক্রিয় লিফটের আকারে সিঁড়িও আছে। এই অলৌকিক সিঁড়ি সম্পর্কে সন্দেহ ও দ্বিধা করার প্রয়োজন নেই। প্রত্যেক আকাশে সেখানকার ফেরেশতারা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান এবং প্রত্যেক আকাশে সেসব পয়গম্বরের সঙ্গে সাক্ষাত্ হয়, যাঁদের স্থান কোনো নির্দিষ্ট আকাশে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ষষ্ঠ আকাশে হজরত মুসা (আ.) এবং সপ্তম আকাশে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাত্ হয়। অতঃপর তিনি পয়গম্বরদের স্থানগুলোও অতিক্রম করে যান এবং এক ময়দানে পৌঁছেন, যেখানে ভাগ্যলিপি লেখার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তিনি ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ দেখেন, যেখানে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে স্বর্ণের প্রজাপতি এবং বিভিন্ন রঙের প্রজাপতি ইতস্তত ছোটাছুটি করছিল। ফেরেশতারা স্থানটিকে ঘিরে রেখেছিল। এখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত জিবরাইলকে তাঁর স্বরূপে দেখেন। তাঁর ছয়শ’ পাখা ছিল। সেখানেই তিনি একটি দিগন্তবেষ্টিতে সবুজ রঙের রফরফ দেখতে পান। সবুজ রঙের গদি ও শ্যামল পাল্কিকে রফরফ বলা হয়। তিনি বায়তুল মামুরও দেখেন। বায়তুল মামুরের কাছেই কাবার প্রতিষ্ঠাতা হজরত ইবরাহিম (আ.) প্রাচীরের সঙ্গে হেলান দিয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। এই বায়তুল মামুরে দৈনিক সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের পুনর্বার প্রবেশ করার পালা আসবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বচক্ষে জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন করেন। সে সময় তাঁর উম্মতের জন্য প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার নির্দেশ হয়। অতঃপর তা হ্রাস করে পাঁচ ওয়াক্ত করে দেয়া হয়। এ থেকে সব ইবাদতের মধ্যে নামাজের বিশেষ গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়।
অতঃপর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন আকাশে যেসব পয়গম্বরের সঙ্গে সাক্ষাত্ হয়েছিল তাঁরাও তাঁর সঙ্গে বায়তুল মুকাদ্দাসে অবতরণ করেন। তাঁরা (যেন) তাঁকে বিদায় সম্বর্ধনা জানানোর জন্য বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত আগমন করেন। তখন নামাজের সময় হয়ে যায় এবং তিনি সব পয়গম্বরের সঙ্গে নামাজ আদায় করেন। (এ নামাজে ইমামতির দায়িত্বও তিনিই পালন করেন।) সেটা সেদিনকার ফজরের নামাজও হতে পারে। ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, নামাজে পয়গম্বরদের ইমাম হওয়ার এ ঘটনাটি কারও কারও মতে আকাশে যাওয়ার আগে সংঘটিত হয়। কিন্তু বাহ্যত এ ঘটনাটি প্রত্যাবর্তনের পর ঘটে। কেননা আকাশে পয়গম্বরদের সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনায় এ কথাও বর্ণিত রয়েছে যে, হজরত জিবরাইল সব পয়গম্বরের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন। ইমামতির ঘটনা প্রথমে হয়ে থাকলে এখানে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এ ছাড়া সফরের আসল উদ্দেশ্য ছিল ঊর্ধ্বজগতে গমন করা। কাজেই এ কাজটি প্রথমে সেরে নেয়াই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। আসল কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর সব পয়গম্বর বিদায়দানের জন্যে তাঁর সঙ্গে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত আসেন এবং জিবরাঈল (আ.)-এর ইঙ্গিতে তাঁকে সবার ইমাম বানিয়ে কার্যত তাঁর নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দেয়া হয়।
এরপর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে বিদায় নেন এবং বোরাকে সওয়ার হয়ে অন্ধকার থাকতে থাকতেই মক্কা মুকাররমা পৌঁছে যান।
মিরাজের ঘটনা সম্পর্কে একজন অমুসলিমের সাক্ষ্য
তাফসির ইবনে কাসিরে বলা হয়েছে, হাফেজ আবু নুয়াইম ইস্পাহানি (রহ.) ‘দালায়েলুন্নবুওয়াত’ গ্রন্থে মুহাম্মাদ ইবনে উমর ওয়াকেদির সনদে মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কুরাজি বর্ণিত নিম্নোক্ত ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন : ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোমসম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে পত্র লিখে হজরত দিহইয়া ইবনে খলিফাকে প্রেরণ করেন। এরপর দিহইয়ার পত্র পৌঁছানো, রোমসম্রাট পর্যন্ত পৌঁছা এবং তিনি যে অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ সম্রাট ছিলেন, এসব কথা বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে, যা সহিহ্ বুখারি শরিফ ও হাদিসের অন্যান্য নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে বিদ্যমান রয়েছে।
এ বর্ণনার উপসংহারে বলা হয়েছে, রোমসম্রাট হিরাক্লিয়াস পত্র পাঠ করার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থা জানার জন্য আরবের কিছুসংখ্যক লোককে দরবারে সমবেত করতে চাইলেন। আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও তাঁর সঙ্গীরা সে সময় বাণিজ্যিক কাফেলা নিয়ে সে দেশে গমন করেছিলেন। নির্দেশ অনুযায়ী তাদের দরবারে উপস্থিত করা হলো। হিরাক্লিয়াস তাদের যেসব প্রশ্ন করেন, সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ সহিহ বুখারি শরিফ, সহিহ মুসলিম শরিফ ইত্যাদি গ্রন্থে বিদ্যমান রয়েছে। আবু সুফিয়ানের আন্তরিক বাসনা ছিল, সে এই সুযোগে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে এমন কিছু কথাবার্তা বলবেন যাতে সম্রাটের সামনে তাঁর ভাবমূর্তি সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আবু সুফিয়ান নিজেই বলেন যে, আমার এই ইচ্ছাকে কাজে পরিণত করার পথে একটিমাত্র অন্তরায় ছিল। তা এই যে, আমার মুখ দিয়ে কোনো সুস্পষ্ট মিথ্যা কথা বের হয়ে পড়লে সম্রাটের দৃষ্টিতে হেয়প্রতিপন্ন হব এবং আমার সঙ্গীরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে ভর্ত্সনা করবেন। তবে তখন আমার মনে মিরাজের ঘটনাটি বর্ণনা করার ইচ্ছা জাগে। এটা যে মিথ্যা ঘটনা, তা সম্রাট নিজেই বুঝে নেবেন। আমি বললাম, আমি তাঁর ব্যাপারটি আপনার কাছে বর্ণনা করছি। আপনি নিজেই উপলব্ধি করতে পারবেন যে, ব্যাপারটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনাটি কী? আবু সুফিয়ান বললেন, নবুওয়াতের এই দাবিদারের উক্তি এই যে, সে এক রাতে মক্কা মুকাররমা থেকে বের হয়ে বায়তুল-মুকাদ্দাস পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং সে রাতেই প্রত্যুষের আগে মক্কায় আমাদের কাছে ফিরে এসেছে।
ইলিয়ার (বায়তুল মুকাদ্দাসের) সর্বপ্রধান যাজক ও পণ্ডিত তখন রোমসম্রাটের পেছনেই দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বললেন, আমি সে রাত সম্পর্কে জানি। রোমসম্রাট তার দিকে ফিরলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এ সম্পর্কে কীরূপে জানেন? তিনি বললেন, আমার অভ্যাস ছিল যে, বায়তুল মুকাদ্দাসের সব দরজা বন্ধ না করা পর্যন্ত আমি শয্যাগ্রহণ করতাম না। সে রাতে আমি অভ্যাস অনুযায়ী সব দরজা বন্ধ করে দিলাম, কিন্তু একটি দরজা আমার পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব হলো না। আমি আমার কর্মচারীদের ডেকে আনলাম। তারা সম্মিলিতভাবে চেষ্টা চালালো, কিন্তু দরজাটি তাদের পক্ষেও বন্ধ করা সম্ভব হলো না। (দরজার কপাট স্বস্থান থেকে মোটেই নড়ছিল না।) মনে হচ্ছিল যেন আমরা কোনো পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লাগাচ্ছি। আমি অপারগ হয়ে কর্মকার ও মিস্ত্রিদের ডেকে আনলাম। তারা পরীক্ষা করে বলল, কপাটের ওপর দরজার প্রাচীরের বোঝা চেপে বসেছে। এখন ভোর না হওয়া পর্যন্ত দরজা বন্ধ করার কোনো উপায় নেই। সকালে আমরা চেষ্টা করে দেখব, কী করা যায়। আমি বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম এবং দরজার কপাট খোলাই থেকে গেল। সকাল হওয়া মাত্র আমি সে দরজার কাছে উপস্থিত হয়ে দেখি যে, মসজিদের দরজার কাছে অবস্থিত বড় পাথরটি ছিদ্র করা। এবং তাতে জন্তু বাঁধার চিহ্নও রয়েছে। তখন আমি সঙ্গীদের বলেছিলাম, আল্লাহ তায়ালা এ দরজাটি এ কারণে বন্ধ হতে দেননি যে, কোনো নবী এখানে আগমন করবেন। রাতে তাই ঘটেছে এবং সে নবী আমাদের মসজিদে নামাজও পড়েছেন। অতঃপর তিনি আরও বিশদ বর্ণনা দিলেন।
ইসরা ও মিরাজের তারিখ
ইমাম কুরতুবি (রহ.) স্বীয় তাফসির গ্রন্থে বলেন, মিরাজের তারিখ সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়েত বর্ণিত রয়েছে। মুসা ইবনে উকবার রেওয়ায়েত এই যে, ঘটনাটি হিজরতের ছয় মাস আগে সংঘটিত হয়। হজরত আয়েশা (রাজি.) বলেন, হজরত খাদিজার ওফাত নামাজ ফরজ হওয়ার আগেই হয়েছিল। ইমাম জুহরি বলেন, হজরত খাদিজার ওফাত নবুওয়াতপ্রাপ্তির সাত বছর পরে হয়েছিল।
কোনো কোনো রেওয়ায়েতে আছে, মিরাজের ঘটনা নবুওয়াতপ্রাপ্তির পাঁচ বছর পরে ঘটেছে। ইবনে ইসহাক বলেন, মিরাজের ঘটনা তখন ঘটেছিল, যখন ইসলাম আরবের সাধারণ গোত্রগুলোতে বিস্তৃতি লাভ করেছিল। এসব রেওয়ায়েতের সারমর্ম এই যে, মিরাজের ঘটনাটি হিজরতের কয়েক বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল।
হারবি বলেন, ইসরা ও মিরাজের ঘটনা রবিউস সানি মাসের ২৭তম রাতে হিজরতের এক বছর আগে ঘটেছে। ইবসে কাসেম জাহাবি বলেন, নবুওয়াতপ্রাপ্তির আঠার মাস পর এ ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু এ বক্তব্যটি সঠিক নয়। মুহাদ্দিসরা বিভিন্ন রেওয়ায়েত উল্লেখ করার পর কোনো সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেননি। (যদিও) সাধারণভাবে খ্যাত এই যে, রজব মাসের ২৭তম রাত মিরাজের রাত্রি। হ
অনুবাদ : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান
[তাফসীরে মাআরেফুল কোরআন থেকে