এই মাত্র কয়েক মাস পূর্বে ১৯৮৬ সালের ১০ই মে ভারতে অর্ধশত কোটি হিন্দুদের এককালের ধর্মগুরু ড. শিবশক্তি বাবু রমজানের চাঁদ দেখার সাথে সাথে তাঁর স্ত্রী ও এক যুবতী কন্যাসহ ইসলাম গ্রহণ করলেন। এখন তার নাম ড. মোঃ ইসলামুল হক। তিনি কেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন তার কারণ বলতে গিয়ে যা কিছু বলেছেন তা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সারা দুনিয়া তা পড়েছে। সম্প্রতি গত ৭ই মে (১৯৮৭) রোজ বৃহস্পতিবার তাঁর এক সাক্ষাৎকার দৈনিক ইত্তেফাকে বেরিয়েছে। আমরা হুবহু সেই সাক্ষাৎকারটি এখানে তুলে ধরছি। যে কথাগুলি সংরক্ষিত হতে পারে এবং তা সারা দুনিয়ার অমুসলিমদের জন্য বিশেষ করে পৃথিবীর তামাম হিন্দুদের চিন্তার রাজ্যে এক আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে এবং হাজার হাজার বণি আদম যার ধর্মীয় ব্যাপারে ভুল পথে চলছেন তারা সঠিক পথের সন্ধান পেতে পারেন।
ড. ইসলামুল হক সাহেবের সাক্ষাৎকারের পর পরই আমরা তুলে ধরব আরেকটি চিত্র যা প্রকাশিত হয়েছে ২২শে মে শুক্রবার দৈনিক ইনকিলাবে। সেখানে দেখতে পাবেন ৮ জন খ্রীষ্টান ধর্ম যাজকসহ মাত্র দুই বৎসরে ৮০ হাজার লোক ইসলাম গ্রহণ করেছে ফিলিপাইনে। ফিলিপাইন হতে চলেছে নির্ভেজাল মুসলমানের দেশ।
এসব ঘটনাকে সামনে রেখে আমরা নতুন করে চিন্তা ভাবনা করতে বলব সারা দুনিয়ার অমুসলিম ভাইদেরকে বিশেষকরে ড. ইসলামুল হক সাহেবের কাহিনী থেকে পৃথিবীর সকল হিন্দু ভাইদেরকে এবং ফিলিপাইনের ঘটনা থেকে পৃথিবীর সকল খ্রীষ্টান ভাইদেরকে বলব আসুন নতুন করে ধর্মকে বুঝুন এবং নিজের স্বার্থেই ধর্ম বেছে নিন।
ডঃ শিবশক্তি স্বরূপজীব একটি সাক্ষাৎকার
গত ১০ই মে (১৯৮৬) ভারতের সাম্প্রতিক কালের এক মহাত্মা ধর্মগুরু যিনি সেদিন পর্যন্ত সেদেশের সর্বত্র ‘ভগবান’ নামে পরিচিত ও পূজিত ছিলেন সেই ডঃ শিবশক্তি স্বরূপজী মহারাজ উদাসেন নিজ স্ত্রী ও কন্যাসহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাহার নতুন নাম রাখা হয় ইসলামুল হক, পত্নীর নাম খোদেজা হক আর কন্যা নাম রাখা হয় আয়েশা হক। গুজরাটের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ‘শাহীন’ এর তরফ হইতে সম্প্রতি ডঃ ইসলামুল হকের এক সাক্ষাৎকর গ্রহণ করা হয়। [১ মার্চ ৮৭ তারিখে সাপ্তাহিক ‘শাহীন] এর প্রকাশিত উক্ত সাক্ষাৎকরটি ইত্তেফাকের পাঠক-পাঠিকা বর্গের নিকট প্রেরণ করিয়াছেন মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, পোষ্ট বক্স নং-২৫, জেদ্দা-২১৪১, সৌদি আরব হতে।
প্রশ্নঃ ইসলাম গ্রহণের পর আপনি কি অনুভব করছেন?
উত্তরঃ আল্লাহর হাজার শোকর যে, তিনি আমাকে ঈমানের অমূল্য সম্পদ প্রদান করেছেন। আমি নিজকে পৃথিবীর এক ভাগ্যবান ও বিজয়ী পুরুষ বলে মনে করি। অজ্ঞানতার দুনিয়ায় আমি ‘ভগবান’ হিসেবে পূজিত ছিলাম, আলোকিত বিশ্বে আমি নিজকে মানুষ হিসেবে খুঁজে পেয়েছি।
প্রশ্নঃ আপনাকে ধন্যবাদ। এখন আপনি মেহেরবানী করে আপনার আগের নাম ও পরিচয় সম্বন্ধে কিছু বলুন?
উত্তরঃ আমার নাম মহানত, ডঃ শিবশক্তি স্বরূপজী মহারাজ উদাসেন, ধর্মচারিয়া, আদ্যশক্তিপীঠ। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আমার পেশা মহানতগিরি। বৃন্দাবনে ‘অনাখন্ড আশ্রম’ নামে আমার এক বড় আশ্রম ছিল। দ্বিতীয় আশ্রম ছিল বোম্বাইয়ের মুলুনডে। আর তৃতীয় দেবালেইনে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এই আশ্রমটির নির্মাণ কাজ প্রায় ৫০ একর জমির উপর চলছিল। ‘খারাপ পথে’ চলা মানুষের সুপথে আনার উদ্দেশ্যে শিক্ষাদান’ পথ প্রদর্শন ও শিষ্য তৈরী করা ছিল আমার প্রাত্যাহিক কাজ।
প্রশ্নঃ আপনার পান্ডিত্যের খ্যাতি সর্বত্র। আপনি আপনার নিজের সম্পর্কে, নিজের শিক্ষা জীবন ও ধর্মজীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তরঃ আশ্রমেই আমার শিক্ষার সূচনা হয়। পরে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওরিয়েন্টালিজমে এম. এ। গুরুকুল কাংডি থেকে ‘আচারিয়া’ (আচার্য) পদবী লাভ। বৃটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্বের দশটি প্রধানতম ধর্মের উপর ডক্টর অব ডিভাইনিটি এবং সেই সাথে ওরিয়েন্টালিজমে আরেক পি. এইচ. ডি। পোপ পল-৬ এর আহবানে ইতালী যাই। সেখানে সাতটি বিভিন্ন বিষয়ে ভাষণ দান করি। আমাকে এক মহাসম্মান ভাটিকানের নাগরিত্ব দান করা হয়। এবং খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণের জন্য বিশেষ অনুরোধ জানান হয়। আমি তদের অনুরোধ উপেক্ষা করে ভারতে এসে বিধিমত মুকুট ধারণ করে আশ্রমের গদিতে বসে পড়ি। আমার জন্ম ১৯৩৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারী। জন্মস্থান মথুরা, বৃন্দাবন। আমি প্রায় ১২টি ভাষা জানি, এর মধ্যে ইংরেজী, সংস্কৃত, গ্রীক, হিন্দি, পালি, গোরমুখী, মারাঠী, গুজরাতি, উর্দু ও আরবী আমার ভাল লাগে। … আগেই বলেছি, আমি দুনিয়ার দশটি প্রধানতম ধর্মের উপর তুলনামূলক পড়াশুনা ও গবেষণা করেছি। সে জন্য সত্য স্বীকারে আমার কোন সংকোচ ছিল না। আমার সমকালীনদের মধ্যে হিন্দু জগতের বড় বড় জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিত্ব ও পন্ডিত রয়েছেন। যেমন জগৎগুরু শংকরাচার্য, রামগোপাল শারওয়ালে, পুরীর শংকরাচার্য, মহামন্ডেলশ্বর স্বামী অখন্ডানন্দজী, গুরু গোলওয়ালকার বাবা সাহেব দেশমুখ, বালঠাকুর, অটলবিহারী বাজপায়ী, নানা সাহেব, দেশমুখ, বিনোবা ভাবে এবং অন্যান্য। একবার তিনি তার “পরমধাম” আশ্রমে আমাকে বক্তৃতাদানের বিশেষ আমন্ত্রণ জানান। সেখানে উপস্থিত লোকজনের সামনে দাদা ধর্মাধীকারী আমাকে জিজ্ঞাসা করে বসেনঃ “আপনি পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম সম্বন্ধে পড়াশুনা করেছেন, মানুষের জন্য কোন ধর্ম শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়? আমি জবাবে বলেছিলাম,‘ইসলাম’ আমার জওয়াবে দাদা খুশী হন নাই। তিনি বলেন, উঠেন, “ইসলাম নানা বাধা-বন্ধন আরোপ করে।” আমি জবাব দিলাম, “যে বন্ধন বাঁধে, সেই বন্ধনই মুক্তি দিতে পারে। আর যে প্রথম থেকে স্বাধীন, তার সারা জীবনের জন্য বন্ধন সৃষ্টি প্রবণতা থেকে যাবে। এ ধরনীতে মানুষকে এক সাথে বেঁধে রাখার জন্য বন্ধনকারী ধর্মের প্রয়োজন রয়েছে, যা তাদের পৃথিবীতে ভাল করে বেঁধে রাখবে এবং পরলোকে মুক্ত করে দেবে। আর এ রকম ধর্ম আমার মতে একমাত্র ইসলামেই রয়েছে। ইসলাম ছাড়া এরকম ধর্ম আমি আর দেখি না।”
প্রশ্নঃ নিজের ইসলাম গ্রহণের কারণ সম্পর্কে কিছু বর্ণনা করুন।
উত্তরঃ ১৯৮৪’র জানুয়ারীর কথা। এক রাত্রে আমি স্বপ্ন দেখলাম। একদল লোক আমাকে ধাওয়া করছে। আমি দৌড়াচ্ছি তারাও দৌড়াচ্ছে। আমি দাঁড়াই, তারাও দাঁড়ায়। হঠাৎ আমি ধাক্কা খেলাম এবং মাটিতে পড়ে গেলাম। দু’টি অজানা হাত আমাকে ধরে দাঁড় করালো। দাঁড়িয়ে এক নূরানী চেহারার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ইনি হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)। আমার শরীর কাঁপতে শুরু করল। নবীজী বললেন, ‘‘কলমা পড়।” আমি কলমা পড়লাম। তিনি আমার ডান হাত নিজের পবিত্র হাতের মধ্যে রেখে যা যা পড়াতে লাগলেন, আমি তা পড়তে লাগলাম। এমনি করে পড়া শেষ হলো। তার পর তিনি আমাকে আলিঙ্গন করলেনঃ আর বললেন, “এ দেশকে কলমা পড়াও।” আমি কতক্ষণ ধরে এ স্বপ্ন দেখেছিলাম, তা আমার মনে নেই। যখন চোখ খুললাম, দেখলাম রাত তিনটা বাজে। একই রাতে, একই সময়ে আমার স্ত্রীও এ ধরনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। … আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই নিজেদের প্রথম শতাব্দীর মুসলমান বলে ভাবতে লাগলাম। আমি বিধিসম্মতভাবে মুসলমান হবার উপায় খুঁজতে লাগলাম, এখানে সেখানে ঘুরি, আর মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক বাড়াই। চুপিসরে নামায পড়ি। এবাদত বন্দেগী করি। পরিশেষে ভাগ্যক্রমে আলেমদের শহর ভুপাল পৌঁছি। ১৯৮৬-এর ০ই মে, রমজান মাসের চাঁদ দেখার সাথে সাথে আমি আমার স্ত্রী আর আমার যুবতী কন্যা প্রকাশ্যভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি।
প্রশ্নঃ আপনি বহু ধর্ম অধ্যায়ন করেছেন। ইসলামের পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থে আল্লাহ, কুরআন, মোহাম্মদ (সাঃ) অথবা ইসলাম সম্পর্কে কোন বর্ণনা দেখতে পেয়েছেন?
উত্তরঃ বৌদ্ধ ও জৈন মতবাদ ছাড়া বাকী সব ধর্ম গ্রন্থে আল্লাহ, মোহাম্মদ (সাঃ) অথবা আহমদ নাম পাওয়া যায়। বেদে খুবই স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়।
প্রশ্নঃ আপনি লাখ লাখ টাকার সম্পদের মোহ ছেড়ে দিয়ে ইসলাম কবুল করেছেন। বর্তমানে আপনি কিভাবে জীবন নির্বাহ করছেন?
উত্তরঃ আমি সমগ্র বিশ্বের রাজত্বও ইসলামের এই মহান উপহারের বদলে ত্যাগ করতে দ্বিধা বা কুন্ঠাবোধ করতাম না। ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে যে তৃপ্তি আমি পেয়েছি সাতরাজ্যের ধন সম্পদ লাভ করেও তা পাওয়া সম্ভব নয়। আমি আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা করি। আল্লাহ তায়ালার কৃপায় প্যারা মাইক্রো পন্থায় দুরারোগ্য ব্যাধির উপশম ঘটাই। এতেই আমার, আমার পরিবারের ডাল রুটির ব্যবস্থা হয়ে যায়।
প্রশ্নঃ সারওয়ারে কায়েনাত হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?
উত্তরঃ আমি আল্লাহ তায়ালাকে চিনতাম না। আমার জানের কসম, তিনি আমাকে রাব্বে জুলজালালকে চিনিয়ে দিয়ছেন…..।
প্রশ্নঃ ইসলামের সিপাহী হিসেবে আপনি দুনিয়ার মুসলমানদের উদ্দেশ্যে কি বাণী রাখতে চান। …. আপনার মতে মুসলমানদেরকেমন হওয়া উচিত?
উত্তরঃ এ ব্যাপারে নবীজি যা বলেছেন তার চেয়ে ভাল কিছু আর কে বলতে পারে? তিনি মুসলামনকে এমন সোনার টুকরার সাথে তুলনা করেছেন কোন অবস্থায়ই যার ঔজ্জ্বল্য কমে না। আরেক জায়গায় তিনি মুসলমানদের তুলনা করেছেন মধুমক্কীকার সাথে, যা ফুলের উপর গিয়ে বসে, নোংরা জায়গায় বসে না। ফুল থেকে রস চুষে মধু বানায়, বিষ তৈরী করে না। আর তা সে নিজের জন্য নয়, অপরের জন্য তৈরী করে। সে ডালে বসে, সে ডালের কোন ক্ষতি করে না। অন্যত্র তিনি বলেছেন, মুসলমান সেই, যার হাত ও কথা থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।
প্রশ্নঃ আপনার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তরঃ স্বার্থপরতার জাল হঠাতে হবে। মুসলিম মুজাহিদদের নতুন শপথ নিয়ে মঠে নামতে হবে। সাহস, নিঃস্বার্থ ঈমান, আর মন-প্রাণ ঢেলে কাজে নামতে হবে। আমার নিজের তরফ থেকে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টায় আছি। সমগ্র মুসলিম সমাজকে এক দেহ আর এক প্রাণে পরিণত করতে হবে। এ বিষয়ে আমার কার্যক্রম নিম্নরূপ:
(১) ইসলামের সুরক্ষা
(২) মুসলমানদের দ্বীন-দুনিয়ার মূল্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা
(৩) সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তারে ভাষায় ইসলামের দাওয়াত পৌঁছান।
(দৈনিক ইত্তেফাক, বৃহস্পতিবার, ২৩ বৈশাখ ১৩৯৪)
তিনি সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন, উর্দুতে। তার নাম দিয়েছেন “লিজিয়ে আপভি সোঁচে” এর বাংলা অর্থ- নিন আপনিও চিন্তা করুন। আশা করি হিন্দু বাইয়েরা সত্যই চিন্তা করবেন।