(দৈনিক ইনকিলাব, শুক্রবার ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৯৪) এখন থেকে পাঁচশো বছর আগে আজকের ফিলিপাইন ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট একটা দেশ। সুলতান সুলায়মান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্র ‘মিরদীকাই’ স্পেনীয় দখলকারদের দ্বারা “ম্যানিলায়’ রূপান্তরিত হয়েছে। স্পেনীয় খ্রীষ্টানেরা দেশটি দখল করে নেওয়ার পর কি বীভৎস নির্যাতনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণকে খ্রীষ্টানে পরিণত করেছে, দৃঢ় ঈমানের কত মুসলিমান যে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন অথবা দক্ষিণের গভীর অরণ্য এলাকায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, সে সব হৃদয়বিদারক কাহিনী আজকের সভ্য দুনিয়া হয়ত ভুলে গেছে। শত অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করার পরও যে স্বল্পসংখ্যক মুসলমান এখন ম্যানিলা এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে টিকে আছেন তাদের মধ্যে খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচার করার লক্ষ্যে কয়েকটি আন্তর্জাতিক মিশন বিপুল উদ্যোগ আয়োজন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে আমেরিকা ভিত্তিক একটি মিশনের উদ্যোগই সবচাইতে বেশী। সে মিশনেরই দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকার প্রধান পাদ্রী ডক্টর দীলু সানতোষ। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশী কাল ধরে তিনি কাজ করেছেন মুসলিম এলাকাগুলোর মধ্যে,কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে,একজন মুসলমানকেও তিনি খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ডক্টর দিলুই রূপান্তরিত হয়ে গেলেন ডক্টর খালেদে! কি করে এটা সম্ভব হলো, এ প্রশ্নের জবাবে ড. খালেদ বলেন, দীর্ঘ বারো বছর কাজ করার পর আমার মনে একটা প্রশ্নের উদয় হলো। তা হচ্ছে, মুসলমানগণ এদেশের মজলুম। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তাদের জীবনযাত্রা। এর পরও কোন মুসলমানই কেন খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করতে চায় না? ইসলাম এমন কোন আকর্ষণী শক্তি রয়েছে, যা শত দুঃখ-দুর্দশা বরণ করার পরও তারা আকঁড়ে ধরে আছে। দু’একজন মুসলমানের সাথে আমার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। কোন কোন সময় আমরা পরস্পরের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতাম। ইসলামের রহস্যজনক আকর্ষণীয় শক্তি সম্পর্কে আলোচনার এক পর্যায়ে মুহাম্মদ সাদা তুমেনতু নামক এক বন্ধু আমাকে একদিন দু’টি বই পড়তে দিলেন। এর একটা মুহাম্মদ মার্মাডিউক পিকথল-কৃত পবিত্র কুরআনে ইংরেজী অনুবাদ এবং অন্যটি মালয়ী ভাষায় লিখিত পুস্তিকা। ‘পবিত্র কুরআন হযরত ঈসা (আঃ)। তুমেনতা’ আমাকে বারবার অনুরোধ করলেন আমি যেন গোসল করে পাক পবিত্র হওয়ার পরই কেবল পবিত্র কুরআনের অনুবাদ গ্রন্থটি পাঠ করি। আমি তার কথা রক্ষা করলাম এবং কুরআনের অনুবাদ পাঠ করতে শুরু করলাম। পাঠ শুরু করার পর থেকে অনুভব করছিলাম, এ পবিত্র গ্রন্থের প্রতিটি বক্তব্যই যেন আমাকে আকর্ষণ করছে। কি এক অপার্থিব আকর্ষণী শক্তি যেন লুকিয়ে আছে এ মহাগ্রন্থের প্রতি শব্দের মধ্যে। এভাবে পাঠ করার এক পর্যায়ে সূরা মায়েদার চতুর্থ আয়াতে এসে আমি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার সমগ্র সত্তায় যেন একটা প্রবল ঝাঁকুনী অনুভব করলাম। কি সরল এবং প্রত্যয়দৃঢ় বক্তব্যই না দেয়া হয়েছে আয়াতটিতেঃ “তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে কাফেররা আজ চরমভাবে নিরাশ হয়ে পড়েছে। ওদের আর ভয় করো না আমাকে ভয় কর। আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা বিধান করলাম। আর দ্বীনরূপে একমাত্র ইসলামের প্রতিই আমার সন্তুষ্টি প্রকাশ করলাম।” কুরআন পাঠ করতে শুরু করেছি মাত্র তিন সপ্তাহ ধরে। এরই মধ্যে আমার মনমানসিকতার পরিবর্তন ছিল বিস্ময়কর। ইসলামই যে মহান আল্লাহর মনোনীত একমাত্র সত্য দ্বীন ও অনুভূতি ধীরে ধীরে তীব্রতর হয়ে উঠলো। মনের মধ্যে যখন এমন একটা তোলপাড় অবস্থা, ঠিক সে সময় একরাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিঃ আমার মন যখন সাক্ষ্য দিচ্ছে যে,ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম, তখন ইসলাম গ্রহণ করলে কেমন হয়? কিন্তু পরক্ষণেই নানা চিন্তা এসে আমার চিন্তা-ভাবনা বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে। ভাবছি –ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথে আমার বর্তমান চাকুরী চলে যাবে। পরিবার পরিজনের ভরণ-পোষন নিয়ে আমি মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়বো। নানা ভাবনা চিন্তার মধ্যেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। শেষ রাতের দিকে স্বপ্ন দেখলাম, আমি যেন তৃণলতাহীন এক প্রান্তরে বিপন্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছি। তৃষ্ণায় যেন আমার ছাতি ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি জীবন বের হয়ে যাবে। এমন সময় দেখলামে এক জ্যোতির্ময় পুরুষকে। তিনি যেন আমাকে ভয় দিচ্ছেন। ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে হাত ধরে আমাকে টেনে তুললেন। ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিন্তু তখনও তীব্র পিপাসা অনুভব করতে লাগলাম। সমগ্র শরীর যেন একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। নড়াচড়া করার শক্তিও যেন আমি হারিয়ে ফেলেছি। কিছুক্ষণ নির্জিবের মত পড়ে থাকার পর শুয়ে শুয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম, ইসলামই একমাত্র সত্য দ্বীন। এ সত্য অনুভব করার পর আর তা থেকে দূরে থাকা মোটেও উচিত হবে না। তাই, টুকিটাকি প্রস্তুতির জন্য একদিন সময় নিলাম। পরদিন স্থানীয় মসজিদে হাজির হয়ে প্রকাশ্যেই ইসলামে দীক্ষিত হয়ে গেলাম। এটা ১৯৮৩ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসের ঘটনা। ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পরই আমি অনুভভ করলাম, ফিলিপাইন মূলতঃ ছিল মুসলমানের দেশ। বিশেষতঃ যে মারদেকা বা স্বাধীন মানুষের দেশ আজকের ম্যানিলায় রূপান্তরিত হয়েছে, এর অধিবাসীদের সিংহভাগই তো ছিলেন একদা তওহীদবাদী মুসলমান। এদের রক্তধারায় কি এখনও তওহীদের অনুভূতি লুকিয়ে নেই? নিশ্চয় আছে। আমাদেরকে সে হারিয়ে যাওয়া অতীত অনুসন্ধান করতে হবে। অতীতের সে তওহীদী রক্তের উত্তরাধিকার যারা বহন করছে তাদের কানে আবার ডাক দিতে হবে, বেলালী কন্ঠের সে ডাক“! ডক্টর খালেদ বললেন,উপর্যুক্ত লক্ষ্য সামনে নিয়েই আমি কয়েকজন সঙ্গী-সাথী নিয়ে ১৯৮৪ খ্রীষ্টাব্দে একটা ইসলামী সংগঠন গড়ে তুলি। আমাদের প্রচেষ্টায় গত দু’বছরে দুই লক্ষ আশি হাজার লোক ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে। দাওয়াতের কাজে আমাদের সর্বাপেক্ষা বড় সাফল্য হচ্ছে,কোযান প্রদেশে একই সাথে আটজন খ্রীষ্টান ধর্মযাজকের ইসলাম গ্রহণ। এদের সাথে আমার কিছুটা পূর্ব পরিচয় ছিল। মাত্র কিছুদিন আগ পর্যন্ত আমরা একই সাথে কাজ করেছি। দক্ষিণ আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের কানে ইসলামী দাওয়াত পৌঁছার সাথে সাথে যেমন অদ্ভুত এক প্রাণবন্যার সৃষ্টি হয়েছে,তেমনি ফিলিপাইনের খ্রীষ্ট সমাজের মধ্যেও ইসলামী দাওয়াত নতুন এক গণজোয়ার সৃষ্টি করবে বলে আমার বিশ্বাস। অবশ্য এর বাস্তব আলামতও ইতোমধ্যেই আমরা প্রত্যক্ষ করছি। পাদ্রীরা যখন এসে দল বেঁধে ইসলাম গ্রহণ করছে, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। (মক্কা শরীফ থেকে ‘আখবারুল আলম-আল-ইসলামী’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রতিবেদক আমের উবায়দ কর্তৃক গৃহীত একটি সাক্ষাৎকার।) অনুবাদ: মহিউদ্দীন খান