Main Menu

নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু তাআলা আনহু

বিশিষ্ট সাহাবী নুমান ইবন বাশীর

বিশিষ্ট সাহাবী নুমান ইবন বাশীর

পূর্বেপ্রকাশিতের পর

নুমান আলী রাদি আল্লাহু আনহুর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করতেন
এ সংশয়ের আলোকে নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহু আলী রাদি আল্লাহু আনহু সম্পর্কে বিদ্বেষ পোষণকারী ও শত্রুতাবশত তার থেকে ভিন্নপথ অবলম্বনকারী।
আল-মাজলিসী বলেন, নুমান ইব্ন বাশীর আনসারী তাঁর (আলী) থেকে ভিন্নমত অবলম্বনকারী এবং ইয়াযিদ নিযুক্ত শাসকদের একজন ছিলেন।
আল-আমিনী বলেন, নুমান ইব্ন বাশীর তার সময়ের শাসকের অন্তর্গত থেকে খারিজ ছিলেন এবং বিদ্রোহী একটি দলের সাথী হয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
ইব্ন আবু হাদীদ বলেন, নুমান ইব্ন বাশীর তাঁর অর্থাৎ আলী রাদি আল্লাহু আনহু থেকে ভিন্নপথ ও শত্রুতা অবলম্বনকারী ছিলেন। তিনি মুআবিয়ার সাথে মিলে রক্তপাতে নিমগ্ন হন ও তার পুত্র ইয়াযিদের শাসকদের অন্যতম ছিলেন এবং সে অবস্থায় নিহত হন। ইত্যাদি বর্ণনা।
উত্তর :
১. নিঃসন্দেহে সাহাবীগণের মধ্যে সংঘটিত ফিতনা ও হত্যাকা- এক দুঃখজনক বিষয় এবং কেউ এমনটি প্রত্যাশাও করেনি। কিন্তু মহান আল্লাহ এটি নির্ধারণ করেছিলেন। অতএব আমরা বলতে পারি, সাহাবীগণের মধ্যে যা ঘটেছে সে বিষয়ে মুসলমানদের আকীদা হল, তাঁদের মধ্যকার বিষয় নিয়ে তারা চুপ থাকবেন। সাথে সাথে এ বিশ্বাসও রাখবেন তাঁরা সকলেই মর্যাদার অধিকারী। অগ্রগামী, তাকওয়াবান, তাপস যদিও ক্ষেত্র বিশেষে তাঁদের একজনের মর্যাদা অন্যজনের চেয়ে বেশিও হতে পারে। অতঃপর তাঁদের বিষয় আল্লাহর উপর সমর্পণ করবে। এটি প্রথম কথা।
২. সাহাবীগণের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে কোন অবস্থাতেই তাঁদের পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ, ঘৃণা ও খারাপ সম্পর্ক প্রমাণিত হয় না। এর প্রমাণ-
(ক)  ইব্ন আবু শায়বা ও তাঁর সূত্রে বায়হাকী আবুল বাখতারী থেকে বর্ণনা করেন, আলী রাদি আল্লাহু আনহুকে উস্ট্রের যুদ্ধে তাঁর প্রতিপক্ষ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তারা কি মুশরিক ছিলেন? তিনি বললেন, তারাতো শিরক থেকেই বিচ্ছিন্ন ছিলেন। তাঁকে বলা হল, তবে কি তারা মুনাফিক? তিনি বলেন, মুনাফিকরা অল্প পরিমাণেই আল্লাহকে স্মরণ করে, তাকে বলা হল, তাহলে তারা কারা? তিনি বললেন, তাঁরা আমাদেরই ভাই কিন্তু তারা আমাদের উপর বাড়াবাড়ি করেছে।
এই হাদীসটির বর্ণনাসূত্রে কোন দুর্বল বর্ণনাকারী থাকলেও তার অর্থ অকাট্য। কেননা আমীরুল মুমিনীন আলী রাদি আল্লাহু আনহু এ জাতীয় আরও কিছু অবস্থান গ্রহণ করেন। যেমন-
– মারুযী তার ‘তাজীমে কাদরুস সালাহ’ গ্রন্থে নিজ সূত্রে ইমাম বাকের রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আলী রাদি আল্লাহু আনহু উষ্ট্রের যুদ্ধ বা সিফ্ফীন যুদ্ধের দিন এক ব্যক্তিকে ভাষার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করতে দেখলেন, তখন তিনি বললেন, এমন বল না, তারা এমন দল যারা মনে করছে আমরা তাদের উপর বাড়াবাড়ি করছি আর আমরা ধারণা করছি তারা আমাদের উপর বাড়াবাড়ি করছে।
আবু জাফরকে বলা হল, তাদের থেকে কিছু অস্ত্র নিয়ে নেয়া হয়েছে, তখন তিনি বললেন, ওগুলো আমাদের কোন কাজে আসবে না।
– তার সনদে মাহকুল থেকে বর্ণিত, আলী রাদি আল্লাহু আনহুর সাথীরা তাঁকে মুআবিয়া রাদি আল্লাহু আনহুর দলের যারা নিহত হয়েছিলেন তাঁদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তাঁরা মুমিন। এছাড়া অন্যান্য হাদীস।
– আলী রাদি আল্লাহু আনহু থেকে আহলুন্ নাহার খারিজীদের ব্যাপারেও একই উত্তর বর্ণিত হয়েছে। সন্দেহ নেই উষ্ট্রের যুদ্ধের প্রতিপক্ষ আলী রাদি আল্লাহু আনহুর কাছে আহলুন নাহার থেকে সম্মানিত ও প্রিয় ছিলেন। অতএব এসব বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয়, আলী রাদি আল্লাহু আনহু তাঁর সাথে যুদ্ধ করা স্বত্ত্বেও উষ্ট্রের যুদ্ধের প্রতিপক্ষকে তাঁর ভাই মনে করতেন। জ্ঞাতব্য যে, ভ্রাতৃত্বের জন্য ভালবাসা আবশ্যক।
খ. যখন উষ্ট্রের যুদ্ধ সমাপ্ত হয় তখন আলী রাদি আল্লাহু আনহু নিহতদের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তখন তালহা ইব্ন উবায়দুল্লাহর লাশ দেখতে পেয়ে তাঁর কাছে বসলেন তাঁর মুখম-ল থেকে ধূলা মুছে দিয়ে বললেন, আবু মুহাম্মদ! আমার কাছে কষ্টকর যে আমি আপনাকে আকাশের তারকার নিচে জমিনের উপর এভাবে পতিত দেখছি। অতঃপর তিনি বললেন, আল্লাহর কাছে আমার সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে আমি অভিযোগ পেশ করব। অতঃপর তালহা রাদি আল্লাহু আনহুর উপর সহানুভূতি প্রকাশ করে আলী রাদি আল্লাহু আনহু বলেন, হায় আফসোস আমি যদি এই দিনের বিশ বছর আগে মারা যেতাম।
এছাড়াও অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে যা থেকে প্রমাণিত হয় সাহাবীগণের মধ্যে যুদ্ধ সংগঠিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তাদের প্রত্যেকেই অপর ভাইয়ের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। অতএব যুদ্ধ তাদের মধ্যকার বিদ্বেষ ও শত্রুতার নির্দেশক নয়।
পক্ষান্তরে যারা আলী রাদি আল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন তারা সবাই তাঁর প্রতিপক্ষ বা তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী বা শত্রু নয়। এমনটি শর্তও নয়।
অতএব, সাহাবাগণের মধ্যে যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল তাতে পতিত উভয় পক্ষই এ ধারণা করেছিলেন যে, তারা সত্যের পক্ষে রয়েছেন।
এ কারণে নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহুকে আলী রাদি আল্লাহু আনহুর প্রতিপক্ষ ও তাদের সেনাবাহিনীর কাতারে পাওয়ায় কোন অবস্থাতেই আলী রাদি আল্লাহু আনহুর উপর তার শত্রুতা ও বিদ্বেষ প্রমাণিত হয় না। বরং নুমান রাদি আল্লাহু আনহু থেকে যা বর্ণিত হয়েছে তা এর বিপরীত সাক্ষ্য প্রদান করে। যেমন-
বর্ণিত হয়েছে, আম্মার ইব্ন ইয়াসীর রাদি আল্লাহু আনহু নিহত হলে নুমান রাদি আল্লাহু আনহু ফিরে আসেন এবং বলেন, আল্লাহর শপথ! আমরা লাত ও উয্যার ইবাদাত করতাম আর আম্মার আল্লাহর ইবাদাত করতেন। তাকে মক্কার মুশরিকরা উত্তপ্ত মরুভূমিতে রোদে পুড়িয়ে ও অন্যান্যভাবে শাস্তি দিত। তিনি আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা করতেন ও এর উপর ধৈর্যধারণ করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, “হে ইয়াসীর পরিবার! ধৈর্য ধারণ কর, নিশ্চয়ই তোমাদের স্থান জান্নাত।” তখন তাকে বলা হল, আম্মার মানুষকে জান্নাতের দিকে আহবান করত অথচ তারা তাকে দোযখের দিকে আহ্বান করত।
নুমান রাদি আল্লাহু আনহু যিনি আলী রাদি আল্লাহু আনহুর সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন তিনি আম্মার ইব্ন ইয়াসীর রাদি আল্লাহু আনহুর মর্যাদার স্বীকৃতি প্রদান করছেন অথচ আম্মার আলী রাদি আল্লাহু আনহুর পক্ষে যুদ্ধ করছিলেন। অতএব নুমান রাদি আল্লাহু আনহুকে সত্য কথা ও তার প্রতিপক্ষের মর্যাদার স্বীকৃতি প্রদান করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সুতরাং এ ঘটনা যদি কোন কিছু নির্দেশ প্রদান করে তা ঐটিই যা আমরা ইতিপূর্বে বলেছি যে, যুদ্ধের অর্থ শত্রুতা ও বিদ্বেষ নয়। নুমান রাদি আল্লাহু আনহুর পক্ষ থেকে আম্মার রাদি আল্লাহু আনহুর সম্পর্কে এ মন্তব্য মূলত আলী রাদি আল্লাহু আনহুরই পক্ষে।
৩. নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহু বলেন, আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করলেন, তখন তিনি আয়িশা রাদি আল্লাহু আনহুকে উচ্চ আওয়াজে কথা বলতে শুনলেন, ‘আমি জানি আলী আপনার কাছে আমার পিতা ও আমার থেকে অধিক প্রিয়।’ একথা তিনি দুইবার অথবা তিনবার বললেন। বর্ণনাকারী বলেন, আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে আয়িশা রাদি আল্লাহু আনহাকে ধমকের সূরে বললেন, হে অমুকের মেয়ে! আমি শুনলাম তোমার আওয়াজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপরে উঠেছে।
হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়, নুমান রাদি আল্লাহু আনহু আলী রাদি আল্লাহু আনহুর মর্যাদা সংক্রান্ত হাদীস বর্ণনা করতেন। যদি তিনি তাঁর সাথে বিদ্বেষ পোষণকারী হতেন যেমনটি কেউ কেউ ধারণা করে, তবে তিনি এসব হাদীস গোপন করতেন এবং তা বর্ণনা করতেন না। যেহেতু তিনি সেগুলো বর্ণনা ও প্রচার করেছেন সেহেতু তা তাদের মধ্যকার বিদ্বেষ ও শত্রুতার অবর্তমানতার নির্দেশনাই দেয়। কেননা এটি যুক্তিগ্রাহ্য নয় যে, বিদ্বেষপোষণকারী যার সাথে বিদ্বেষভাব রাখে তার সম্মান মর্যাদা প্রচার করবে বরং সে তার কুৎসাই প্রচার করে যেমন কবি বলেছেন-
সন্তষ্টির চোখ ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষেত্রে দৃষ্টিহীন হয়ে যায়
অসন্তোষের চোখ শুধু দোষ-ত্রুটি দিয়েই শুরু করে।
হাফেজ্ ইব্ন হাজর বলেন, নুমান আলী রাদি আল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে মুআবিয়ার পক্ষে ছিলেন তবুও তা তাঁকে আলী রাদি আল্লাহু আনহুর মর্যাদা বর্ণনা করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
৪. এ প্রসংগে নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহু সম্পর্কে অনেক বর্ণনা রয়েছে যা থেকে প্রমাণিত হয়, তিনি আহলে বাইতকে সম্মান ও ভালবাসার খাতিরে তাদের খিদমাত করার চেষ্টা করতেন। যার অবস্থা এমন হয় তিনি কখনই তৎকালীন আহলে বাইতের মহান ব্যক্তি তথা আমীরুল মুমিনীন আলী রাদি আল্লাহু আনহুর প্রতি বিদ্বেষভাব ও শত্রুতাপোষণ করতে পারেন না। তিনি যদি তার সাথে শত্রুতা পোষণ করতেন তবে তিনি অবশ্যই তার সন্তানদের সাথে শত্রুতা ও বিদ্বেষপোষণ করতেন। কেননা তাঁরাও তাঁদের পিতার অনুসৃত পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন।
যেহেতু নুমান আলী রাদি আল্লাহু আনহুর সন্তানদের সম্মান ও ভালবাসা প্রদর্শন করতেন সেহেতু এ থেকে প্রমাণিত হয় তিনি তাঁদের পিতার সাথে বিদ্বেষপোষণ করতেন না।
তৃতীয় সংশয় আলোচনার ক্ষেত্রে এসব বর্ণনার বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশাল্লাহ।
সমাপ্তি:
এই সংশয়ে আরও একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয় যা তাসতারী তার কামসুর রিজাল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। নুমান ইব্ন বাশীর রাদি আল্লাহু আনহুর প্রতি সম্পৃক্ত একটি আরবী কবিতা যাতে বলা হয়েছে:
দূর থেকে খিলাফতের প্রত্যাশা ভুল পথে দ্রুত অগ্রসর হয়েছিল আবু তুরাব
মুআবিয়া ছিল ইমাম আর তুমি ছিলে তার পক্ষ থেকে এক পার্শ্বে বিছিন্ন মরিচীকা।
উত্তর:
এটি নুমান রাদি আল্লাহু আনহুর ব্যাপারে একটি মিথ্যা কবিতা। যা ইব্ন আবু হাদীদ ও জাহেয কোন প্রকার সূত্র ছাড়াই বর্ণনা করেছেন। যা থেকে প্রমাণিত হয় এসব বর্ণনার উদ্দেশ্য আহলে বাইত বিশেষত: আলী রাদি আল্লাহু আনহুর ব্যাপারে সাহাবীগণের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিকৃত করে উপস্থাপন করার মাধ্যমে মিথ্যা ও বানোয়াট বর্ণনা রচনা করা।

Related Post